একটা জিনিষ খেয়াল করেছেন কি, যে গত কয়েক বছরে পা’কিস্তানের জনগণের ভেতরে ১৯৭১ এর ইতিহাস নিয়ে একটি ব্যপক সচেতনতা এসেছে? একই রকম আরো একটি বিষয় হল ২০১৩-১৪ সাল থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে তরুণ সমাজের মধ্যে একটি ব্যপক আগ্রহ জন্মেছে এবং ১৯৭৫ পরবর্তী যে মিথ্যা, প্রপাগান্ডা ও কুৎসা রটানো হয়েছিল সেগুলো অনেকটাই কর্পুরোর মত উবে গেছে? আমাদের প্রিন্ট ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়া কর্পোরেট সুবিধাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে ও সস্তা বিনোদনের বোজো বেনিয়াদের হাতে চলে যাবার পর গত প্রায় দুই দশকে ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি এই তিনটি বিতর্কিত ও অতিগুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়গুলো থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে নিয়েছে। উপরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অর্ধ শতাব্দি আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে যে সচেতনতার কথা বললাম, সেটা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার কৃতিত্ব নয়। এই কৃতিত্ব বেড়ে ওঠা নকুন প্রজন্মের সুপার সাইবর্গদের।
মুখস্ত করা বিদ্যা, কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তির বিস্তার, আমাদের বড় শহরগুলোর তরুণ সমাজের জীবনধারা ও নতুন যে প্রযুক্তি উৎপাদন দাসত্ব - এগুলো বিশাল এক শ্রেণীকে নিজ পেশাগত কর্মটুকু ছাড়া, পুরো দুনিয়া কিভাবে চলে সেটাতে নির্বোধ বা বোজোতে পরিণত করছে। শিশুতোষ সস্তা আবেগে তারা চলে সেই কারণে সমাজে ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতির গভীর তাৎপর্য তারা আসলে বোঝে না। ধর্ম যে শুধু আচার-আনুষ্ঠানিকতা নয়, দর্শন যে শুধু কঠিন কঠিন শব্দ নয় এবং রাজনীতি মানে দলবাজী নয় এটা তাদের বোধের বাইরে। বোঝে না বলেই পপুলার কালচার থেকে এগুলোকে তারা সরিয়ে দিয়েছে।
এরাই সাংস্কৃতিক বোজো শ্রেণী। হুমায়ুন-মিলনের সময় থেকে এই বোজো বিপ্লবের শুরু যেটা আমাদের তরুণ সমাজের সকল মানসিক প্রখরত্ব নষ্ট করে দিয়েছে যার ফলে এখন তারা হাদিস চর্চাকে ধর্ম আর বিসিএস চর্চাকে তারুণ্যের সফলতার জয়গান বলে মনে করে। বোজো বিপ্লবের সবচেয়ে বড় বিপদ হল মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার নিজস্ব মানসিক ক্ষমতা লুপ্ত হওয়া। এই বোজো বিপ্লবই জনতোষনকারি পপুলিস্টিক শাসনব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়েছে যেটি প্রথাগত রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক বোজো শ্রেণী চিন্তাগতভাবে অক্ষম (কগনিটিভলি ইনকেপেবল) একটি শ্রেণী যাদের হাতে আমাদের গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি যেটা একটি জাতীর প্রথ প্রদর্শনের মশাল যা পুরো সমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের পূর্বসূরীদের সত্য অনুধাবনের অক্ষমতা, তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারীতা এবং প্রতিদিনের ডায়েরি রাখার মত সামান্য শৃঙ্খলাবোধ না থাকার কারণে আমাদের জাতীগত ইতিহাসে আছে বড় বড় সব ফাঁক ও মিথ্যা। এই ফাঁক ও মিথ্যাগুলো ভেঙে ফেলছে নতুন একটি প্রজন্ম যারা ইলন মাস্কের সাইবর্গ। সাইবর্গ বা cyborg কথাটি হল সাইবারনেটিক অর্গ্যানিজম এর সংক্ষিপ্ত রূপ। প্রকৃত সাইবর্গ এখনও তৈরি হয়নি। তবে এর মধ্যেই একটি শ্রেণী তাদের চিন্তা ভাবনার অংশ হিসাবে নিজের স্মৃতির সাথে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলোকে স্মৃতি হিসাবে ব্যবহার করে নিজের কগনিটিভ দক্ষতা বাড়িয়ে ফেলতে পারে। সেটাকেই উদ্দেশ্য করে ইলন মাস্ক বলেছিলেন “আমরা অলরেডি সাইবর্গ”, যার অর্থ, আমরা যারা কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষ, তারা এর মধ্যেই আমাদের সকল কাজকর্মে ইন্টারনেটে থাকা তথ্যকে আমাদের স্মৃতির অংশ হিসাবে ব্যবহার করি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ছিল না। কিন্তু তখনকার অনেক সংবাদ ও তথ্যই প্রিন্ট মিডিয়া ও ভিডিও থেকে এখন ইন্টারনেট তথ্যে পরিণত হয়েছে। যেগুলোকে নিজের মগজে ইনডিক্সিং করে এরা মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার নিজস্ব মানসিক ক্ষমতা অর্জন করেছে।
বিষয়টা শুধু আমাদের দেশে ঘটেছে তাই নয়। ইরাক যুদ্ধের উপর সম্প্রতি দুটো সিনেমা দেখলাম। একটি সত্য ঘটনার উপরে বায়োগ্রাফিক ফিল্ম ‘আমেরিকান স্নাইপার’ (২০১৪), ও অপরটি টান টান উত্তেজনার সিনেমা ‘দ্য হার্ট লকার’ (২০০৮)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এবং তার পরবর্তী অনেক যুদ্ধভিত্তিক ছবি মানেই ছিল যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতাকে ঢেকে রেখে জাতীয়তাবাদ ও হিরোইজমকে ফুটিয়ে তোলা। বর্তমানের এইসব ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি এইসব যুদ্ধে যারা নায়ক, যারা আমেরিকার ‘নিরাপত্তার’ জন্য জীবন বাজি রেখে ইরাক বা আফগানিস্তানে লড়েছে, তাদের যে আগে থেকেই মানসিক সমস্যা ছিল, সেটাই যেন ফুটে উঠেছে। লক্ষনিয় যে টান টান উত্তেজনার সিনেমা ‘দ্য হার্ট লকার’ পরিচালনা করেছেন একজন নারী পরিচালক ক্যাথরিন বিগেলো। ছবিটি নয়টি বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করে এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্যসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত নারী পরিচালক পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এছাড়া ক্যাথরিন বিগেলো প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘দ্য হার্ট লকার’ ২০০০ এবং ২১ শতকের সেরা যুদ্ধ চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। ছবিটি ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ" হিসাবে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস দ্বারা জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
আমরা যারা সাইকোলজি জানি এবং কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়েও জানি আমরা এই জ্ঞানটাকে বলি সাইবার সাইকোলজি। সাইবার সাইকোলজি বলে, যারা কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষ, তারা কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তিকে নিজেদের মস্তিষ্কের এক্সটেনশন হিসাবে ব্যবহার করতে শিখে যায়। এরাই হল ইলন মাস্কের সেই সাইবর্গ। কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তির সাথে নিজের মস্তুিষ্কের সাথে যারা সুপার সংযোগ তৈরি করতে পারছে এবং বর্তমানে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে তাকে মহা শক্তিশালি করতে পারছে, তারা সংখ্যায় কম হলেও, গড়পড়তা মেধার মানুষের চেয়ে তারা শতগুন বা হাজারগুন ক্ষমতাসম্পন্ন সুপার সাইবর্গ শ্রেণী হিসাবে তৈরি হবে। এই সুপার সাইবর্গ শ্রেণী তাদের পূর্ববর্তি প্রজন্মগুলোর নয়কে ছয় করা ধামা ধরা মিথ্যাবাদী সুবিধাবাদী বোজো শ্রেণীকে একেবারে উলঙ্গ করে ফেলবে। সেই সময় এসে গেছে, সাধুু সাবধান।