প্রেশার কুকারের পিঁপড়ারা

চীন থেকে কি পেলাম?

ভারতের তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের বৈশালী এবং প্রজ্ঞানন্দ দুই ভাই বোনই দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার। তারা যখন বাড়িতে গ্র্যান্ডমাস্টার লেভেলের দাবা অনুশীলন করে তখন নিশ্চয়ই সাথে চা বিস্কুট খায়। সেই চা বিস্কুট খেতে গিয়ে নিশ্চয়ই দাবার বোর্ডে চিনির দানা বা বিস্কুটের গুঁড়া পড়ে। হয়ত কোন দিন খেলা শেষ না হলে, সেই অবস্থায় তারা বোর্ডটি রেখে ঘুমাতে যায় পরের দিন খেলা শেষ করবে বলে। তারপর রাতে সেই বোর্ডে নিশ্চয়ই পিঁপড়ার দল আসে চিনি বিস্কুটের লোভে। তারা তখন সেই চিনির দানা বা বিস্কুটের গুঁড়ো নিজেদের গুহায় নিয়ে যায়। সকালে পিঁপড়াদের পত্রিকা বের হলে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা পিঁপড়েরা কতগুলো চিনি বিস্কুটের গুঁড়া আনল, আগের তুলনায় কম না বেশী সেটা নিয়ে গরম গরম সব খবর বের হয়, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ চলে কে ভাল কে মন্দ যাদের ঐ দুই গ্রান্ড মাস্টারের মূল্যবান খেলাটি সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। 
       
বৈশালী এবং প্রজ্ঞানন্দের মত নির্দোষ দাবা নয়, রিয়ালপলিটিক বা ক্ষমতার রাজনীতির মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করার এক রাজনৈতিক দাবা খেলা শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউরোপীয় দেশগুলো গত ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করা শুরু করেছে যা অত্যন্ত ভ্রান্ত এবং নৃশংস। এই কৌশলের উদ্ভাবক প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিউ ব্রজেজিনস্কি। তিনি দাবী করেছিলেন ইউরেশিয়া (ইউরোপ ও এশিয়া) মহাদেশ বিশ্ব শক্তির চাবিকাঠি। তিনি ইউরেশিয়াকে একটি "বিশাল দাবার বোর্ড" হিসেবে দেখিয়েছেন। বলেছেন ইউরেশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রভাব প্রয়োগ করতে করতে হবে এবং সেখানে রাশিয়া বা চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য রোধ করে তাদের শক্তিহীন করতে হবে। ব্রজেজিনস্কি ১৯৯৭ সালে এটি নিয়ে একটি বই লেখেন যার নাম হল "দ্য গ্র্যান্ড চেসবোর্ড: আমেরিকান প্রাইমেসি অ্যান্ড ইটস জিওস্ট্র্যাটেজিক ইম্পেরেটিভস"। ব্রজেজিনস্কির পরিকল্পনা এই বইতে লেখা, সেই পরিকল্পনা অনুসারেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার পরের ধাপ অনুযায়ী তাইওয়ান নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকান্ড ২০২৭ সালেই সম্ভাব্য যুদ্ধের আভাস দিয়েছিল চিনকে। এটি নিয়েই প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কোরের ইন্দো-প্যাসিফিক কম্যান্ডের উপ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিফেন স্কেনকা। এই পরিকল্পনার সাথেই জড়িত বাংলাদেশের ২০২৪ সালের সরকার পরিবর্তন।

ব্রজেজিনস্কি মনে করেন যে ইউরেশিয়ার নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণ করবে। তিনি বলেছেন, "ইউরেশিয়ায় যে শক্তি আধিপত্য ধরে রাখবে, সেই শক্তি বিশ্ব আধিপত্য ধরে রাখবে।" তিনি ইউরেশিয়াকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করেন: 

১. পশ্চিম ইউরেশিয়া (ইউরোপ): ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা। 
২. মধ্য ইউরেশিয়া (রাশিয়া ও প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চল): রাশিয়ার পুনরুত্থান রোধ করা। 
৩. পূর্ব ইউরেশিয়া (চীন ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল): চীনের উত্থান নিয়ন্ত্রণ করা।

ব্রজেজিনস্কি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেন, তুরস্ক, ইরান এবং তাইওয়ানের মতো "পিভটাল স্টেটস" (নির্ধারণী রাষ্ট্র) গুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যারা তাদের ভূ-অবস্থানের কারণে ইউরেশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশগুলোকে প্রভাবিত করে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করতে পারে।

ইউক্রেন রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত এবং ব্রজেজিনস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ "পিভটাল স্টেট"। তিনি বলেছিলেন যে, ইউক্রেনের পশ্চিমা ধারার স্বাধীনতা এবং পশ্চিমের সঙ্গে একীভূত হওয়া রাশিয়ার ইউরেশিয়ায় প্রধান শক্তি গয়ে ওঠার প্রচেষ্টাকে নষ্ট করবে। ইউক্রেনের রাশিয়ার সাথে সকল চুক্তি ভঙ্গ এবং ইউক্রেনে রাশিয়ান ভাষাভাষীদের নিপীড়ন ২০১৪ সালে রাশিয়াকে ক্রিমিয়া দখলে বাধ্য করে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি ২০২২ সালে রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় বাধ্য করে। বাইডেন প্রশাসন, যারা ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসে, তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। যেটি ছিল ব্রজেজিনস্কির কৌশল, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে রাশিয়াকে ইউক্রেনের মতো অঞ্চলে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে তাকে দুর্বল করা বা তার শক্তি ক্ষয় করা যাবে।

বাইডেন প্রশাসনের প্ররোচনার ফল ছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কতৃক চীনের গণবাহিনীকে (পিপলস লিবারেশন আর্মি) ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেওয়া। চীন বুঝে গিয়েছিল রাশিয়াকে দুর্বল করতে যেটা ইউক্রেনকে নিয়ে করা হচ্ছে চীনকে দুর্বল করতে সেটা তাইওয়ানকে নিয়ে করা হবে। সেটা হলে চীনকে তাইওয়ান আক্রমণ করতে প্রস্তুত হতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বংলাদেশ হয়ে উঠবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেই যুদ্ধ শুরু হলেই চীনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের জ্বালানি পরিবহন বন্ধ করা হবে। এবং এর সাথে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মিয়ানমারের কিয়াউকফিউ বন্দর হয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের কুনমিং এর সাথে সংযোগে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের সাথে চীনের বিকল্প সংযোগ বন্ধ করা তার আগেই হবে গুরুত্বপূর্ণ। অপর দিকে একই রকম সমস্যা ভারতের সাথে শুরু করা বাংলাদেশকে নিয়ে যেটা তারা ইউক্রেনকে নিয়ে রাশিয়ায় করেছে ও তাইওয়ানকে নিয়ে চীনের সাথে করবে। এই রকম আন্তর্জাতিক মরণ খেলায় কিছু লোক বাংলাদেশকে বিক্রি করে দিয়েছে জাতির সাথে মিথ্যা ও প্রতারণা করে।

খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীনের অবস্থান রহস্য জনক। এই রহস্যের কারণ হল তাইওয়ানকে দাবার গুটি বানানোর আগে মিয়ানমারকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল মার্কিন ডিপ স্টেট। মিয়ানমারে রঙিন বিপ্লব করে নোবেল জয়ী সু কি কে ক্ষমতায় বসিয়ে যে চেষ্টা পশ্চিমারা করেছে, তারই ফল হচ্ছে পরবর্তীতে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এবং সামরিক শাসন। মিয়ানমারের সেই সামরিক শাসকদের পেছনের শক্তি অবশ্যই চীন সরকার। মিয়ানমারের চীনপন্থী সরকারের শত্রু যারা তারা চীনেরও শত্রু। সেই কারণে রোহিঙ্গাদের নিয়ে চীনের দৃষ্টি সবসময়ই শীতল। রোহিঙ্গাদের জন্য যেখানে ৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্য এসেছে সেটাতে চীনের এসেছে মাত্র ০.৪ মিলিয়ন ডলার তাও কোভিডের সময়। এর অর্থ চীন রোহিঙ্গাদের কোন রকম আর্থিক সহায়তা করেনি। 

চীন রাখাইন ও রোহিঙ্গা নিয়ে এই অঞ্চলে একটি দ্বিমুখী খেলা খেলছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে হাতে রাখতে ও তার মাধ্যমে মিয়ানমারের সম্পদ ব্যবহারে দক্ষিন এশিয়ার দক্ষিনপূর্ব অঞ্চল নিয়ে সে নির্বিকার। এই অঞ্চল যদি স্থিতিশীলতা হারায় তাহলে তার এশীয় প্রতিদ্বন্দী ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা তার চেয়ে হাজার গুন বেশী যেটা তাকে একটি কৌশলগত সুবিধা এনে দেবে ভারতের সাথে তার সীমান্ত বিবাদ নিয়ে। অপরদিকে এই সমস্যা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তাহলে সেটা তার স্বার্থের বিপক্ষে যাবে। সুতরাং চীন চায় এই অঞ্চলে সমস্যা প্রেশার কুকার পদ্ধতি মেনে চলুক। যেন সমস্যাটা এমন পর্যায় থাকে যেন ভারত চাপে থাকে আবার এত বেশী না হয়ে যায় যে আমেরিকা সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়।     

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের শেকড় ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে অনেক গভীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করলেও, চীন ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে একটি অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং "এক চীন নীতি" মেনে তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, কিন্তু তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট এর মাধ্যমে তাইওয়ানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখে।

২০১০-এর দশক থেকে চীনের উত্থান ব্যাপকতর হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), দক্ষিণ চীন সাগরে আঞ্চলিক দাবি, এবং উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, চীনের উত্থান এশিয়ায় তার প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে, চীন মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র তার উন্নয়নকে "নিয়ন্ত্রণ" করতে চায় এবং তাইওয়ানের মতো বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তার অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বে হুমকি সৃষ্টি করতে চাইছে।

২০২৫ সালে এসে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, এবং সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যেমন সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি রপ্তানিতে বিধিনিষেধ, এবং চীন তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাইওয়ান স্ট্রেইটে চীনের সামরিক মহড়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি এই সংঘাতকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

২০১৪ থেকে উত্যক্ত করে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে বাধ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেছে রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য। একইভাবে, তাইওয়ানকে চীনের বিরুদ্ধে একটি অনুরূপ ফ্ল্যাশপয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া যেতে পারে, এটাই মার্কিন পরিকল্পনা যা চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তিকে শেষ করে ফেলতে পারে। 

তাইওয়ান পূর্ব ইউরেশিয়ায় একটি "পিভটাল স্টেট" হিসেবে ব্রজেজিনস্কির তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন যে, চীনের উত্থান নিয়ন্ত্রণে তাইওয়ানের মতো অঞ্চলগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা জরুরি। তাইওয়ান শুধু ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জন্য নয়, চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে তার আধিপত্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

তাইওয়ান চীনের একটি "অবিচ্ছেদ্য অংশ" হিসেবে বিবেচিত, এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) এর প্রধান লক্ষ্য হলো তাইওয়ানের সঙ্গে পুনঃএকত্রীকরণ। অন্যদিকে, তাইওয়ান বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের প্রায় ৬০% নিয়ন্ত্রণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সমর্থন করে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে, তবে এটি একটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইউক্রেনের মতো, যেখানে রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে, তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও চীন একই পরিণতির সম্মুখীন হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত "কৌশলগত অস্পষ্টতা" নীতি অনুসরণ করে, যেখানে তারা তাইওয়ানের প্রতিরক্ষার জন্য সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেয় না, কিন্তু অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন ও নানা রকম উস্কানি অব্যাহত রাখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে উচ্চ-পর্যায়ের যোগাযোগ বাড়িয়েছে এবং সামরিক সহায়তা জোরদার করেছে। এটি চীনকে উস্কানি দিচ্ছে এবং একটি সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউক্রেনে যেমন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সৈন্য পাঠায়নি কিন্তু অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে রাশিয়াকে কোণঠাসা করেছে, তেমনি তাইওয়ানে একটি প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে চীনকে দুর্বল করার পরিকল্পনা স্পষ্ট হচ্ছে।

যদিও শেষের দিকে বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ানের প্রতি "কৌশলগত অস্পষ্টতা" থেকে সরে এসে স্পষ্ট সমর্থন দেখিয়েছে। ২০২২ সালে বাইডেন বলেন, চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে। তাইওয়ানকে উন্নত অস্ত্র সরবরাহ এবং তাইওয়ান স্ট্রেইটে নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি এই নীতির প্রতিফলন। এটি ব্রজেজিনস্কির কৌশলের সঙ্গে মিলে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে চীনকে তার নিজস্ব "নিরাপত্তা পরিধি"তে ব্যস্ত রেখে তার উত্থান রোধ করা যায়।

তাইওয়ানে যুদ্ধ শুরু হলে, এটি ইউক্রেনের মতো চীনের জন্য ফাঁদ হতে পারে। চীনকে একটি ব্যয়বহুল সংঘাতে জড়িয়ে ফেলা হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক চাপের মাধ্যমে চীনের শক্তি ক্ষয় করতে পারে। ব্রজেজিনস্কির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি পূর্ব ইউরেশিয়ায় চীনের আধিপত্য রোধ করার কৌশল হবে।

জানুয়ারি ২০২৫-এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন (ট্রাম্প ২.০) যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রশাসন ডিপ স্টেট নামে পরিচিত স্থায়ী আমলাতন্ত্র, বাম ডেমোক্র্যাট ও অলিগার্কদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং যুক্তরাষ্ট্রের "নরম আক্রমণ নীতি", অর্থাৎ গণতন্ত্র, লিঙ্গ রাজনীতি, অভিবাসন ও সীমান্ত নীতির মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যাগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ভেঙে ফেলার ওপর জোর দিয়েছে।

এখন নতুন ট্রাম্প প্রশাসন বা ট্রাম্প-২.০ চীনের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য কোন পথ অবলম্বন করে সেটার উপর নির্ভর করবে চীনের প্রেশার কুকার নিরাপদ থাকবে নাকি বিস্ফোরিত হবে। ট্রাম্প ২.০ প্রশাসন বাইডেন নীতির সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে যেমন চীন ও ইসরায়েলের প্রতি অবস্থান সাদৃশ্য বজায় রাখতে পারে, তবে "ডিপ স্টেট" এবং "নরম আক্রমণ" এর প্রশ্নে মৌলিকভাবে ভিন্ন পথে যাবে। অভিবাসন, ফেডারেল আমলাতন্ত্র, ইউক্রেন, এবং জলবায়ু নীতিতে ট্রাম্প-২.০ সরকার খুব কঠোর। এই পরিবর্তনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। তবে সেই অনিশ্চয়তার আগেই আমরা বেকুবের মত সরকার পরিবর্তন ঘটিয়ে চীনের প্রেশার কুকারের ভেতরে ঢুকে গেছি। সেই প্রেশার কুকারের মধ্যে বসে এখন হিসাব করছি চিনির দানা বা বিস্কুটের গুঁড়া কে কয়টা আনল।