গেল ৭ আগস্ট ২০২৩ সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় পেছাল ১০০ বার। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হন। সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন ও মেহেরুন রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।
কেন হয় না সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত? খুন হওয়া সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি উভয়েই ছিলেন পেশাদার সংবাদকর্মী। কেন হয় না সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার এটা নিয়ে শত শত প্রবন্ধ বিশ্লষণ ও সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে গত এক যুগ ধরে। হত্যার তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না কিন্তু কেন তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না সেটা খুঁজতে কি আমরা যথেষ্ট সিরিয়াস? মনে হয় না।
আমরা যারা সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করি তারা কোন বিষয়ের মূল কারন (রুট কজ) অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নেই যেটা সামাজিক বা ব্যক্তিগত বিভিন্ন ভ্রান্তি বায়াসকে শুদ্ধ করে। এমনই পদ্ধতি হল জাপানের কাওয়াসাকি শিপইয়ায়ার্ডের কাউরু ইশিকাওয়ার উদ্ভাবিত ইশিকাওয়া ডায়াগ্রাম বা সাকিচি টয়োদার 'পাঁচটি কেন পদ্ধতি (Five Why Technique)' যেটি টয়েটা মোটর কোম্পানী ব্যপকভাবে ব্যবহার করে এসেছে। এগুলোর পরিশোধিত সংস্করণ হল 'পাঁচটি কেন-কিভাবে পদ্ধতি' অথবা 'কেন-কারণ বিশ্লেষণ' (Why-Because Analysis)।
সামাজিক সমস্যা সমাধানে কারন অনুসন্ধানে আমি আর একটি পদ্ধতি তৈরি করেছি যেটি বাংলাদেশের মত হুজুগে দেশের জন্য এবং বর্তমানের মিডিয়া প্রভাব কাটাতে প্রয়োজনীয় সরে মনে করি। এটি হল প্রধান বা প্রাথমিক কারণ বাদ দেওয়া পদ্ধতি। যেমন যদি আপনি খুঁজতে যান যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয়। বেশীরভাগ ব্যক্তি এই মত দেবে যে চালকের দোষ এবং তাদের লাইসেন্স নাই সেই কারনে। আমরা জানি মিডিয়া এবং পাবলিক ইনফর্মেশনে এই কারনটি বহুল প্রচারিত হবার ফলে এটির বায়াস এমন যে এটি অন্য সব কারনকে গৌন করে ফেলে। এখন যদি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয় এর রুট কজ এনালিসিস করি তাহলে আমরা যখন “চালকের দোষ” বিষয়টাকে বাদ দিয়ে বিশ্লেষণ করবে তখন বাকি কারনগুলো বেরিয়ে আসবে।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত কেন হয় না এর বিশ্লষণ করলে আমরা দেখি “চালকের দোষের” মত “৪৮ ঘন্টা” বা “বেডরুমের নিরাপত্তা” এগুলো সবার উপরে স্থান পেয়ে সেটা বাকি কারনগুলোকে ঢেকে ফেলেছে। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছর একটি বিষয় প্রকটভাবে দৃশ্যমান যে অতি ধনী গোষ্ঠী, সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা (অবসরপ্রাপ্ত সহ), সরকারী বিভাগগুলো, পুলিশ বিভাগ এদের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধ যেমন হত্যা, দুর্ঘটনাজনিত হত্যা এমনকি খুনের মামলারও তদন্ত এগোচ্ছ না, তদন্তে এদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে না অথবা তদন্তকারীরা তদন্ত করার সাহসই পাচ্ছে না।
নানা দেশে নানা সময়ে একনায়কতন্ত্র কায়েম হলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীদের আইনের বাইরে রাখা নতুন কিছু নয়। একনায়কতন্ত্র কায়েম হলে দেশের আইন কানুন শুধু একনায়কতন্ত্রের বিরোধিদের ও সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতদের উপর প্রয়োগিত হয়। ক্ষমতাশীলেরা একনায়কতন্ত্রের পক্ষে থাকলে তারা আইন কানুন এমনকি সংবিধানেরও ঊর্ধ্বে উঠে যায় এটা নতুন কিছু নয়।
এখন প্রশ্ন হল এই পরিস্থিতিতে মানুষ কি করে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বাস করে এসেছে। হিংস্র জীব জন্তুর মত মানুষের হিংস্র আচরণ, শক্তিশালী নখ দন্ত থাবা নেই। তাই একা মানুষ এই পৃথিবীতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বাস করা এবং সমষ্টিগত কৌশল ও বলই মানুষকে রক্ষা করেছে। সেই কারনে মানুষের মধ্যে গোষ্ঠি সংযুক্তি ভ্রাতৃত্ববোধ প্রবল। ইতিহাসে সকল সমাজের সকল সময়ের বিশ্লেষণে দেখা যায় মানুষ কখনও ভাইয়ের হত্যার বদলা না নিয়ে ছাড়েনি কারন এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন। ভাইয়ের হত্যা অথবা ভাইয়ের মৃত্যু যে সাহসী ও সর্বহারা মানুষকে কত বিচলিত করে সেটা সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় আমরা পাই:
“পাঠানের ভিতর বুর্জুয়া প্রলেতারিয়ায় যে তফাৎ, সেটুকু সম্পূর্ণ অর্থ নৈতিক। অনুভূতির জগতে তারা একই মাটির আসনে বসে, আর চিন্তাধারায় যে পার্থক্য সে শুধু কেউ খবর রাখে বেশী, কেউ কম। কেউ সেক্সপীয়র পড়েছে, কেউ পড়েনি। ভালোমন্দ বিচার করার সময় দুই দলে যে বিশেষ প্রভেদ আছে, মনে হয়নি। আচার-ব্যবহারে এখনো তারা গুষ্ঠির ঐতিহ্যগত সনাতন জান-দেওয়া-নেওয়ার পন্থা অনুসরণ করে।
এসব তত্ত্ব আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন ইসলামিয়া কলেজের এক অধ্যাপক। অনেকক্ষণ ধরে নানা রঙ, নানা দাগ কেটে সমাজতাত্ত্বিক পটভূমি নির্মাণ করে বললেন–
এই ধরুন আমার সহকর্মী অধ্যাপক খুদাবখশের কথা। ইতিহাসে অগাধ পণ্ডিত। ইহসংসারে সব কিছু তিনি অর্থনীতি দিয়ে জলের মত তরল করে এই তৃষ্ণার দেশে অহরহ ছেলেদের গলায় ঢালছেন। ধর্ম পর্যন্ত বাদ দেন না। যীশু খ্রীস্ট তার ধর্ম আরম্ভ করেছিলেন ধনের নবীন ভাগবণ্টনপদ্ধতি নির্মাণ করে; তাতে লাভ হওয়ার কথা গরীবেরই বেশী তাই সবচেয়ে দুঃখী জেলেরা এসে জুটেছিল তাঁর চতুর্দিকে। মহাপুরুষ মুহম্মদও নাকি সুদ তুলে দিয়ে অর্থবণ্টনের জমিকে আরবের মরুভূমির মত সমতল করে দিয়েছিলেন। এসব তো ইহলোকের কথা–পরলোক পর্যন্ত খুদাবখশ অর্থনৈতিক বাঁদা চালিয়ে চিকণ মসৃণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু থাক এসব কচকচানি মোদ্দা কথা হচ্ছে ভদ্রলোক ইতিহাসের দূরবীনে আপন চোখটি এমনি চেপে ধরে আছেন যে অন্য কিছু তার নজরে পড়ে কিনা সে বিষয়ে আমাদের সকলের মনে গভীর সন্দেহ ছিল।
মাসখানেক পূর্বে তার বড় ছেলে মারা গেল। ম্যাটিক ক্লাশে পড়ত, মেধাবী ছেলে, বাপেরই মত পড়াশুনায় মশগুল থাকত। বড় ছেলে মারা গিয়েছে, চোট লাগার কথা, কিন্তু খুদাবখশ নির্বিকার। সময়মত কলেজে হাজিরা দিলেন। চায়ের সময় আমরা সন্তর্পণে শোক নিবেদন করতে গিয়ে আরেক প্রস্থ লেকচর শুনলুম, জরথুস্ত্র কোন্ অর্থনৈতিক কারণে রাজা গুশআপকে তার নূতন ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। তিন দিন বাদে দুসরা ছেলে টাইফয়েডে মারা গেল–খুদাবখশ বৌদ্ধ ধর্মের কি এক পিটক, না খোদায় মালুম কি, তাই নিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য। এক মাস যেতে না যেতে স্ত্রী মারা গেলেন পিত্রালয়ে-খুদাবখশ তখন সিন্ধুর পারে পারে সিকন্দর শাহের বিজয়পন্থার অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধানে নাককান বন্ধ করে তুরীয়ভাব অবলম্বন করেছেন।
আমরা ততদিনে খুদাবখশের আশা ছেড়ে দিয়েছি। লোকটা ইতিহাস করে করে অমানুষ হয়ে গিয়েছে এই তখন আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর পাঠানসমাজ যখন মনুষ্যজাতির সর্বোচ্চ গৌরবস্থল তখন আর কি সন্দেহ যে খুদাবখশের পাঠানত্ব সম্পূর্ণ কপূর হয়ে গিয়ে তার ঐতিহাসিক টেলিস্কোপের পাল্লারও বহু উধ্বে দূরদূরান্তরে পঞ্চেন্দ্ৰিয়াতীত কোন্ সূক্ষ্মলোকে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় মারা গেল তাঁর ছোট ভাই— পল্টনে কাজ করত। খুদাবখশের আর কলেজে পাত্তা নেই। আমরা সবাই ছুটে গেলুম খবর নিতে। গিয়ে দেখি এক প্রাগৈতিহাসিক ছেড়া গালচের উপর খুদাবখশ গড়াগড়ি দিচ্ছেন। পুথিপত্র, ম্যাপ, কম্পাস চতুর্দিকে ছড়ানো। গড়াগড়িতে চশমার একটা পরকলা ভেঙে গিয়েছে। খুদাবখশের বুড়া মামা বললেন, দুদিন ধরে জল স্পর্শ করেননি।
হাউ হাউ করে কাঁদেন আর বলেন, আমার ভাই মরে গিয়েছে। শোকে যে মানুষ এমন বিকল হতে পারে পুর্বে আর কখনো দেখিনি। আমরা সবাই নানারকমের সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু খুদাবখশের মুখে ঐ এক কথা, আমার ভাই মরে গিয়েছে।
শেষটায় থাকতে না পেরে আমি বললুম, আপনি পণ্ডিত মানুষ, শোকে এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? আর আপনার সহ্য করবার ক্ষমতা যে কত অগাধ সে তো আমরা সবাই দেখেছি— দুটি ছেলে, স্ত্রী মারা গেলেন, আপনাকে তো এতটুকু কাতর হতে দেখিনি।
খুদাবখশ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু মুখে কথা ফুটল। বললেন, আপনি পর্যন্ত এই কথা বললেন? ছেলে মরেছিল তো কি? আবার ছেলে হবে। বিবি মরেছেন তো কি? নূতন শাদী করব। কিন্তু ভাই পাব কোথায়? তারপর আবার হাউ হাউ করে কাঁদেন আর বলেন, আমার ভাই মরে গিয়েছে।
অধ্যাপক বলা শেষ করলে আমি বললুম, লক্ষ্মণের মৃত্যুশোকে রামচন্দ্রও ঐ বিলাপ করেছিলেন।”
বাংলাদেশে অচেনা লোককেও আমরা ভাই বলি। আমাদের অফিসের কলিগদেরও আমরা ভাই বলি। সেই হিসাবে নিহত সাগর সরওয়ার আমাদের ভাই। নিহত সাগর সরোয়ার সকল সাংবাদিকের ভাই। সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত হয় না এর কারন হল এদেশে আর কোন প্রলেতারিয়েত নাই। সকলেই পাতি বুর্জোয়া হয়ে গেছে। পাতি বুর্জোয়াদের ভাই লাগে না। পাতি বুর্জোয়াদের মনিব মা বাপ, অস্ত্রধারী লাঠিয়াল তাদের পরম বন্ধু।
তাহলে কি এই খুনের বিচার হবে না? এটা নিশ্চিত যে শুধু এই মামলা নয়, আরো অনেক সহজ মামলার তদন্ত এগোচ্ছে না অথবা তদন্তে ক্ষমতাশালীদের নাম সন্দেহ তালিকাতেই রাখা হচ্ছে না যেখানে ক্ষমতাশালীরা অভিযুক্ত। তদন্ত না এগোনোর এই সব কাপুরুষতা ও অপকর্মের দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই দায়ী। সরকারী কর্মক্ষেত্রে অল্প কিছু লোক মন্দ আর বেশিরভাগ ভাল এই তত্ত্ব দিয়ে এর থেকে পার পাওয়া যাবে না এবং পরবতী প্রজন্ম কাউকেই ছাড় দেবে না। বিচার হলে অপরাধী সাজা পাবে আর বিচার না হলে বর্তমানের সকলে অপরাধী হবে।
আজ ৯ অগাস্ট জাপানের নাগাসাকির উপর অন্যায় ও অন্যায্য কারনে দ্বিতীয় পারমানবিক বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। পারমাণবিক বোমার সফল প্রয়োগের খবর যখন পারমানবিক বোমা প্রকল্প লস আলামসের বিজ্ঞানীদের কাছে পৌছায় তখন সেখানে সন্ধ্যা। পারমাণবিক বোমার সফল প্রয়োগ ও লক্ষ নার পুরুষ শিশুর আগুনে রেডিয়েশনে ঝলসে যাবা খবর শুনে বিজ্ঞানীরা তখন আনন্দে মেতে ওঠেন। সারা রাত চলে পার্টি এবং খাদ্য পানীয় সহ আনন্দের বন্যা। আজ ৭৮ বছর পর আমরা কিন্তু জানি হিরোসিমা নাগাসাকি ছিল হত্যাকান্ড এবং তার জন্য উক্ত আনন্দ উদযাপনকারীরা সবাই দায়ী। এর কারন এই ৭৮ বছর কোন সরকার বিচার না করলেও মানুষ কিন্তু তদন্ত চালিয়ে গেছে। আমাদের যারা ভাই হারিয়েছেন তারা সেটা চালাচ্ছেন কি? তদন্ত কিন্তু শুধু সরকার করে না, ভাইয়েরাও করে।
পরের পর্বে সমাপ্য।