ধরুন আপনার খুব একটা পছন্দ নয় এমন একজনের সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল যেহেতু আপনার ব্যবসায়ী পিতা এবং আপনার হবু বধুর সরকারী কর্মকর্তা পিতা উভয়ে খুব ভাল বন্ধু এবং একে অপরকে অবৈধ সুবিধা থাকে। বিয়ের পরে আপনি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে এই বিয়ের ফলে আপনার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। আপনি এই বিয়ে থেকে বের হতে চান। বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে উকিলের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন বিবাহ বিচ্ছেদ করতে গেলে আপনার এক কোটি টাকা খরচ হবে যা আপনার কাছে নেই। আপনি যাতে বিবাহ বিচ্ছেদ না করতে পারেন, সেই পথ বন্ধ করতেই এটা করা হয়েছে।
আপনি যদি একজন শুদ্ধ মনের মানুষ হন তাহলে আপনি এই বিয়ে থেকে বের হতে এক কোটি টাকা জোগাড় করতে সচেষ্ট হবেন। আপনি যদি সৎ লোক হন তাহলে সৎ পথে পরিশ্রম করে এই অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা করবেন। আপনি যদি অসৎ ব্যক্তি হন তাহলে অবৈধ কোন পথে দ্রুত এই টাকা উপার্জনের চেষ্টা করবেন। আর আপনি যদি শুদ্ধ মনের মানুষ না হন, তাহলে আপনি এমন কিছু করতে পারেন যার ফলে আপনার স্ত্রীই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাবে বা আপনার বাবাই নিজেরাই টাকা দিয়ে আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেবে।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনি নিয়মিত আপনার স্ত্রীর নানা রকম দুর্নাম করতে থাকুন কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই। এরপর যদি তার কোন দুর্বল মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে একটি নেতিবাচক বিষয় প্রমাণ করতে পারেন, তখন আগে যুক্তি প্রমাণ ছাড়া বলা সব কথা মানুষ তখন বিশ্বাস করবে এবং সেগুলো একসাথে যোগ করে আপনার স্ত্রীকে একজন ‘মন্দ নারী’ হিসাবে পরিত্যাগ করতে চাইবে। তখন এক কোটি টাকা ছাড়াই আপনার মনের ইচ্ছা সফল হবে।
উপরের উদাহরণ একটি রাজনৈতিক কৌশলও যা ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে সবসময় ব্যবহার করা হয়। যেখানে দীর্ঘমেয়াদী ধারাবাহিক অপপ্রচারের মাধ্যমে কোনো দেশ, দল, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বলে সন্দেহজনক বিরূপ মনোভাব তৈরি করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে সাজানো বা সাবোটাজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন অপবাদ তৈরি করে প্রমাণ করা এবং এর ফলে জনমনে সেই সন্দেহজনক অপপ্রচারের পুরো ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করানো। এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে সঠিকভাবে সমাজের চোখে বিভ্রান্ত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা অন্যায়কে ন্যায্যতা দেওয়া।
রাজনীতিতে এই কৌশলের ধাপগুলো হচ্ছে:
১। দীর্ঘমেয়াদী অপপ্রচার: দীর্ঘ সময় ধরে নির্দিষ্ট দেশ, দল, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবিরাম মিথ্যা, বিরূপ ও নেতিবাচক বার্তা ছড়ানো হয়। সাধারণত মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রাজনৈতিক ভাষণ বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে এই অপপ্রচার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, তাদেরকে মন্দ, শত্রু, অপরাধপ্রবণ, দেশবিরোধী, বা সমাজবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
২। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি: যখন অপপ্রচার দীর্ঘমেয়াদে করা হয়, তখন সমাজের বড় অংশ এটিকে ধীরে ধীরে ধারণাগুলো অবচেতন গ্রহণ করতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে একটি হালকা সামাজিক ধারণা তৈরি হয় যে, সেই দেশ, দল গোষ্ঠি বা সম্প্রদায় সত্যিই সমস্যার মূল কারণ।
৩। রাজনৈতিক যুক্তিযুক্তকরণ: রাজনৈতিক নেতারা এই অপপ্রচারকে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করে। তারা জনসম্মুখে এসব মিথ্যা ধারণা প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের ক্ষমতার পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করে।
৪। সাবোটাজ: উক্ত দেশ, দল, গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের সামান্য নেতিবাচক ঘটনাকে সামনে এনে বা কোন ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করে নানা আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক কার্যক্রম চালানো হয় সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে। এই ঘটনার পর সমাজের বড় অংশ সেই দেশ, দল, গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে দোষারোপ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়, কারণ তারা পূর্বে থেকেই প্রচারিত নেতিবাচক ধারণাগুলোকে বর্তমান ঘটনার প্রক্সিতে সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়।
এ ধরনের অপপ্রচার মনস্তাত্ত্বিকভাবে 'চিন্তাপ্রক্রিয়াগত অসঙ্গতি' (Cognitive Dissonance) এর সাথে জড়িত। মানুষের মনে যখন বারবার একই ধরনের নেতিবাচক তথ্য প্রবেশ করে, তখন তারা সত্য-মিথ্যার বিভাজন করার ক্ষমতা হারায়। দীর্ঘমেয়াদে এই নেতিবাচক তথ্যের পুনরাবৃত্তি ব্যক্তিরা বিশ্বাস করতে শুরু করে। একে 'ইল্যুশন অফ ট্রুথ এফেক্ট' (Illusion of Truth Effect) বলা হয়, যেখানে মিথ্যা তথ্য বারবার শুনলে মানুষ সেটিকে সত্য বলে মনে করে।
নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের প্রচারণার নীতি অনুসারে, "যত বড় মিথ্যা বলা হবে এবং যতবার তা পুনরাবৃত্তি করা হবে, ততবেশি তা মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে।" এই কৌশলটি হিটলারের সময়কার নাৎসি জার্মানির প্রোপাগান্ডায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের 'দেশদ্রোহী' এবং 'অপরাধী' হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, যার ফলে পরে 'হলোকাস্ট' নামে পরিচিত ভয়াবহ গণহত্যার ন্যায্যতা সমাজের একটি বড় অংশ স্বীকার করে সেটাতে অংশগ্রহণ বা সমর্থন করেছিল।
এ ধরনের অপপ্রচার কৌশল সাধারণত ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা (Fascism) প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে 'শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করা সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল এবং ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার হুতু সরকার তুলসিদের বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রচার চালিয়েছিল, যার ফলাফল ছিল গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা। এই প্রক্রিয়ার সামাজিক এবং রাজনৈতিক ফলাফল:
১। গণমানস গঠনে ভূমিকা: ধারাবাহিক অপপ্রচার মানুষের মনে একটি বিরূপ সামাজিক ধ্যানধারণা তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি জাতিগত বা ধর্মীয় সহিংসতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
২। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের হাতিয়ার: এই পদ্ধতি কোন রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতাহীন করার একটি কৌশল। তারা মানুষের ভয় এবং ঘৃণাকে ব্যবহার করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং নিজেদের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন তৈরি করে। ধর্মীয় রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা বা সামরিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করারও এটি একটি কৌশল।
৩। মানবাধিকার লঙ্ঘন: এর ফলাফলস্বরূপ ভুক্তভোগী সম্প্রদায় মানবাধিকার হরণের শিকার হয়, যেমন গণহত্যা, নির্যাতন বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।
এই ধরনের প্রোপাগান্ডা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সমাজকে বিভক্ত করতে এবং ক্ষমতা কায়েম করতে কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার উদাহরণ ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এ ধরনের গোয়েবলের অপপ্রচার কৌশল বহু দিন ধরে ব্যবহার করে আসছে ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে একই কৌশলের গোয়েবলের অপপ্রচার ভিত্তিক রাজনৈতিক ইসলাম। সামরিক বাহিনীর সাই অপস (Psychological Operations) একই কৌশলের ভিত্তিতে কাজ করে।
তথ্যসূত্র:
১। Hannah Arendt এর "The Origins of Totalitarianism" গ্রন্থে তিনি ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যে প্রোপাগান্ডার ভূমিকা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে।
২। Noam Chomsky-র "Manufacturing Consent" গ্রন্থে গণমাধ্যম কীভাবে মানুষের মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদী অপপ্রচারের মাধ্যমে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে, তা ব্যাখ্যা করেছেন।