পাক শ্রীলংকা বাংলাদেশের অর্থনীতি

রেমিট্যান্সেই পতন

আজকের একটি পত্রিকার হেডলাইন হল “প্রকৃত রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে”, আজ প্রায় সব পত্রিকার হেডলাইন হল “৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স”। অশিক্ষিতরা দুনিয়ার সব যায়গায় ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে জীবনযাপন করে, আর আমাদের শিক্ষিতরা সবচেয়ে বেশী ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে চলে। আমাদের সরকার, মিডিয়া, এবং বেশিরভাগ ইন্টেলেকচুয়ালরা সেই ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। আমাদের মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে বিদেশে কাজ করে দেশে অর্থ আনা, অর্থাৎ রেমিট্যান্স হল শুধুই উপকারী এবং দেশের ভেতরে যারা ব্যবসা শিল্প কারখানা করে, উৎপাদনের চেষ্টা করে তারা চোর ও ঋণ খেলাপী। আজকেরই আর একটি খবর হল “জুন শেষে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড খেলাপি ঋণ যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ”। সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স ও রেকর্ড খেলাপির খবরগুলো পড়লে বোঝা যায় দেশের “রেমিট্যান্স যোদ্ধা” ও উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা কেমন।

রেমিট্যান্স সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হল যে বিদেশ থেকে টাকা আসা মানেই সেটা ভাল। অবশ্যই বিদেশে কর্মীরা কষ্ট করে যে বৈদেশিক মূদ্রা উপার্জন করে সেই বৈদেশিক মূদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে তারা দেশের বৈদেশিক মূদ্রার সঙ্কট হ্রাস করে এবং দেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই উপার্জিত টাকা যদি তাদের দেশে অবস্থিত পরিবারের আর্থিক অবস্থার ব্যপক পরিবর্তন ঘটায় এবং জীবনযাত্রা আধুনিক করে তাহলে পুরো পরিবারের জন্য যে নতুন নতুন প্রোডাক্ট ও সার্ভিসের প্রয়োজন হয় সেটি বা তার কাঁচামাল কিনতে আরো বেশী বৈদেশীক মূদ্রার প্রয়োজন হয়। যে হারে রেমসিট্যান্স বাড়ছে সেই হারে যদি দেশের প্রোডাকশন জটিলতা না বাড়ে তাহলে যত বেশি রেমিট্যান্স তত বেশি বৈদেশিক মূদ্রার সঙ্কট দেখা দেবে। এই বিষটি আমার গত কালকের লেখাতে বিস্তারিত আছে (কেন দ্রুত অর্থনৈতিক ‘উন্নয়ন’ আমাদের গলায় ফাঁস হবে, ১ অক্টোবর ২০২৩)। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা কালকের লেখার সেই ম্রু গ্রামের থট এক্সপেরিমেন্টে ফেরত যাই।

থট কনটেক্সট ৪: ধরা যাক ঐ ম্রু গ্রামের এক ব্যক্তি তাদের হেডম্যানের সাথে গন্ডগোল হওয়াতে ঢাকা শহরে চলে এল। এর পর সে একটি করাখানায় কাজ নিল। এতে সে মাস গেলে ভালই অর্থ উপার্জন শুরু করল এবং নিজে কষ্ট করে থেকে সেই অর্থের বেশিলভাগ সে তার ম্রু গ্রামে অবস্থিত পরিবারের কাছে পাঠাতে শুরু করল। এই অর্থ আসাতে উক্ত পরিবার কষ্ট করে ঝুম চাষ ছেড়ে দিল এবং হাটবারে হাট থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে জীবনযাপন শুরু করল এবং শিশুরা পড়াশোনায় মন দিল।

থট কনটেক্সট ৫: ধরা যাক উক্ত ব্যক্তির দেখাদেখি ঔ গ্রামের আরো কয়েকজন একই কাজ করল এবং ধীরে ধীরে তারা এমন জিনিষও কিনতে শুরু করল যেগুলো ঔ ম্রু গ্রামে তৈরী হয় না। তাদের দেখাদেখি অন্য ম্রু পরিবারের লোকজনের মধ্যেও এমন সব পণ্যের চাহিদা তৈরী হল যেগুলো তারা নিজেরা তৈরী করে না।

এখন থট কনটেক্সট ৪ পরিস্থিতিতে উক্ত ব্যক্তির পরিবার ভাল থাকবে এবং এতে ঐ ম্রু গ্রামের সামাজিক অর্থনীতির ধারা ব্যাহত হবে না। কিন্তু থট কনটেক্সট ৫ পরিস্থিতিতে ঐ ম্রু গ্রামের যে জিডিপি (ঐ ম্রু গ্রামের অভ্যন্তরে এক বছরে চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার সামষ্টিক মূল্য), তার কত অংশ এ ম্রু গ্রামের বাইরে যারা কাজ করছে তারা ভোগ করছে আর কত অংশ ঐ ম্রু গ্রামের উৎপাদন ব্যবস্থায় যারা নিয়োজিত তারা ভোগ করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই অনুপাত একটি মানের চেয়ে বেশি হলে ঔ ম্রু গ্রামে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার অভাব দেখা দেবে (কারণ একটি বড় অংশের শ্রম ঐ গ্রামের বাইরের উৎপাদন ব্যবস্থায় নিয়োজিত) ও মূদ্রাস্ফীতি হবে। ঐ ম্রু গ্রামের মানুষদের তখন অন্য গ্রাম থেকে দ্রব্য ও সেবা কিনে আনতে হবে অথচ তত টাকা তাদের হাতে নেই। এতে তাদের শ্রমের মূল্য কমবে।

এটি হল অর্থ ও শ্রম ব্যবস্থার অরৈখীক ধর্ম (ননলিনিয়ার প্রোপার্টি) যেখানে একটি অনুপাতের উপরে গেলে যত বিক্রি তত ক্ষতি। যত বিনিয়োগ তত ক্ষতির একটি বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যখন যমুনা ফিউটার পার্ক তৈরি হচ্ছে তখন আমি ওটিস লিফট ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলাম। যমুনা ফিউটার পার্কে ওটিস লিফট ও এসকেলেটর দেবার জন্য তখন প্রায়ই যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুল সাহেবের সাথে দেখা করতে হত। তিনি একবার হাঁসতে হাঁসতে বললেন, আর বইলেন না ভাই, পত্রিকায় ডেইলি এক লাখ টাকা লস। কি যে বিপদে আছি, পেপার যত পুপলার তত লস, যত সার্কুলেশন তত লস, যত বিক্রি তত লস। আমি বললাম কিভাবে সেটা? উনি বুঝিয়ে দিলেন পত্রিকা ছাপতে খরচ ১৬ টাকা, পত্রিকার বিক্রয় মূল্য ১০ টাকা, এই ৬ টাকা আসে সরকারী বিজ্ঞাপন থেকে। ২৫০০০ কপির উপরে বিক্রি হলে প্রতি কপিতে লস হতে থাকে কারণ বিক্রি আর যতই বাড়ুক সরকারী বিজ্ঞাপনের অর্থ একই থাকে।

রেমিট্যান্স জিডিপি অনুপাত ও প্রোডাকশন জটিলতা বৃদ্ধির মধ্যে ঐ পত্রিকা ব্যবসার মতই একটি গুণগত সীমারেখা আছে। অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেমকে না বুঝে, তাকে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধুই ডলারের লোভে আর কর ভ্যাটের খায়েশে অর্থনৈতিক নীতি সিদ্ধান্ত নিলে রেমিট্যান্সও হয়ে যেতে পারে পতনের কারন।

ছবিতে উপরের অংশে দক্ষিন এশীয়ার দেশগুলোর রেমিট্যান্স জিডিপি অনুপাত। অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া তিনটি দেশ, শ্রীলংকা, পাকি’স্তান বাংলাদেশ উচ্চ রেমিট্যান্স জিডিপি অনুপাত। গ্রাফে ২০১২ এর পর বাংলাদেশের অনুপাত কমতে দেখা গেলেও এটি আসলে গার্মেন্টস রফতানী বৃদ্ধি ও শুভঙ্করের জিডিপি বৃদ্ধির কারণ যা প্রকৃত নয়। ছবিতে নিচে দক্ষিন এশীয়ার দেশগুলোর তৈরী পোশাক রফতানী।

পরের পর্ব: রেমিট্যান্স ও দেশে মানবসম্পদের মূল্য বৃদ্ধি