রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ ও একই মডেলে বাংলাদেশ

ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি – একটি ওর্স্ট কেস সিনারিও -৩

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে যে কোন 'অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা মোকাবিলায় শান্তি রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেবার পর বাংলাদেশে যারা উগ্র ভারত বিরোধীতা করছিল তাদের গলার আওয়াজ একটু কমেছে বলে মনে হয়। এর সাথে সরকার ও জামাতে ইসলামী অপেক্ষাকৃত নরম সূরে কথা বলছে। বাংলাদেশে যতবার অরাজনৈতিক সরকার এসেছে, প্রায় সব সময়ই রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান উঠে পড়ে লেগেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালীর মাটির সংস্কৃতিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে। এটি তারা করে ভারত বিরোধীতার নাম দিয়ে। 

এটি করতে গিয়ে সব সময় তারা প্রতি শক্তি বা কাউন্টার ফোর্স হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি এবং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে বাঙালীর মাটির সংস্কৃতিকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে । যেহেতু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি এবং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির কোন জনপ্রিয়তাই নেই, তাই নির্বাচনে তারা সবসময়ই জামানত হারিয়েছে। সুতরাং দেশের ভেতরের উগ্র ভারত বিরোধীতা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হবার কিছু নেই। কিন্তু বর্তমানের বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের যে ভূরাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, এবং অর্থনীতি, রাজনীতি ও পরাশক্তিগত দিক থেকে আমেরিকার যে মরিয়া অবস্থা, সেটি থেকে আমেরিকানদের খুনি চরিত্রের কুটচালই হচ্ছে সত্যিকারের চিন্তার বিষয়। 

ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনের কারণ নিয়ে আমার এনালিসিস আগেই দিয়েছিলাম। সংক্ষেপে সেটা হল ইরাক আফগানিস্তানে বিফল হবার পর আমেরিকার লেজুড় ধরা ইউরোপ ন্যাটো ও আমেরিকার মাতব্বরি থেকে একটু দুরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল বা স্বাধীন হতে চেয়েছিল। আমেরিকা চায়নি সেটা হোক। তাই তারা গোপনে ইউক্রেনকে উৎসাহিত করেছে ন্যাটোতে যোগ দিতে। তারা জানত যে রাশিয়া কোন ভাবেই এটা মেনে নেবে না। সুতরাং এই প্রচেষ্টার অর্থ হচ্ছে রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমনে বাধ্য করা। সেটা করলে আমেরিকার তিনটি লাভ। এক ইউরোপকে ভীত করা যাবে যে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে তারা নিরাপদ নয় তাই তারা আমেরিকান থেকে দূরত্ব আর চাইবে না। দুই, এর ফলে আর একটি ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হবে যার ফলে ইউরোপে অস্ত্র বিক্রি অনেক বাড়বে। এই পরিকল্পনায় বলির পাঁঠা ইউক্রেন। কিন্তু আমেরিকা কি জানে না এর ফল কি? রাশিয়াকে একঘরে করলে তার সাথে একঘরে হবে চীন। কোভিড পরবর্তি বিশ্বে এর ফল হল সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক মেল্টডাউন। সেটা থেকে কি আমেরিকা বাঁচবে? যেটাই হল তিন নম্বর কারণ, বাঁচবে। 

এই সুযোগে রাশিয়াকে দুর্বল ও বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে। রাশিয়া দুর্বল হলে পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সেগুলোকে কব্জা করে আমেরিকার অর্থনীতি আবার ফুলে ফেঁপে উঠবে যখন বাকি দুনিয়া হবে গরিব। এই প্রক্রিয়ায় চীন হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা। ইউক্রেনে আমেরিকার যে নৃশংস চেহারা আমরা দেখেছি যারা ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, নিজেদের সহযোগী ইউরোপের ধ্বংসের প্রতি নির্লিপ্ত, তাদের সেই পরিকল্পনারই অংশ হতে পারে চীনকে ঠেকাতে বাংলাদেশকে বলির পাঁঠা বানিয়ে ভারতকে চরমভাবে উত্যক্ত করা এবং ভারতে এক সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করা। আমেরিকার সহযোগীতায় এই যুদ্ধ যেমনই হোক, সেটা ভারতকে দুর্বল করে ফেলবে। তখন ভারত বাংলাদেশকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে খুব সহজ। এটাই হল বাংলাদেশের আমেরিকার ঘটানো কালার রেভ্যুলুশনের ওর্স্ট কেস সিনারিও। 
ইউক্রেনে কি হয়েছিল তার ধারাবাহিক বিবরণের পরের অংশ:     

৭. ইউক্রেনের ফার-রাইট এবং অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং সিআইএ-এর ভূমিকা

মিনস্ক -১ ও ২ চুক্তি ভঙ্গ:

পেরেস্ত্রোইকা বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন ইউক্রেন স্বাধীন হয় তখন রাশিয়ার সাথে ন্যাটো জোট ও ইউক্রেনের এই শর্তেই সেটা হয় যে ইউক্রেন কখনও ন্যাটো জোটভুক্ত হবে না, তারা তাদের কাছে থাকা সোভিয়েত পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করবে, তারা পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে এবং বিনিময়ে রাশিয়া তাদের বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেবে। এসব শর্ত মেনেই ইউক্রেন স্বাধীন হয় যেগুলোকে মিলে তৈরি হয় মিনস্ক প্রটোকল (মিনস্ক-১ চুক্তি) যার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশপন্থী অঞ্চলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা। চুক্তিটি অনেকটা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২ এর মতই।
 
কিন্তু ইরাক আফগানিস্তানে ব্যর্থ হবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৮ সালে হঠাৎ করেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ঐ সময় ইউরোপিয় ইউনিয়নের অনেক দেশ বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি এর বিরোধিতা করে কারণ এটা রাশিয়ার সাথে তাদের শর্ত ভঙ্গ করে (মিনস্ক-১ চুক্তি) এবং এটা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিনষ্ট করবে। কিন্তু এই বিরোধিতায় কোন কাজ হয়নি। আমেরিকা ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে যেতে থাকে এবং সিআইএ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে ইউক্রেন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশপন্থী অঞ্চলের মধ্যে বিরোধ জোরদার করার জন্য। 

শুধু এটুকুই নয়, ইউক্রেনের রাজনীতিরও ক্রমেই আমেরিকাকরণ হয়। পপুলিস্ট অলিগ্রার্কিক চরম ডানপন্থি উত্থান ঘটতে থাকে সেখানে। যারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাদের কর্মীদের জেলে পুরেছে, যারা তাদের সমালোচনা করেছে সেইসব টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে । বুশের পর ওবামা আসলেও আমেরিকার ইউক্রেন নীতির কোন পরিবর্তন হয় না। ক্রমেই আমেরিকা ও ইউক্রেন সরকারের মিনস্ক প্রটোকল অমান্যের কারণে ইউক্রেনে রুশভাষী ও ইউক্রেনিয়দের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বৃদ্ধি পায় এবং আভ্যন্তরীণ দমন নিপীড়ন ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়। 

এর ফলেই ২০১৪ সালে মিনস্ক-২ চুক্তিপত্র তৈরী হয় এবং ২০১৫ সালে বেলরুশ, রাশিয়া, জার্মানী ও ফ্রান্সের নেতাদের উপস্থিতিতে মিনস্ক-২ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ইউক্রেন বা আমেরিকার আচরণের কোন পরিবর্তন হয় না। তারা মিনস্ক ১ ও-২ চুক্তির কোন তোয়াক্কাই করে না এবং সিআইএ পূর্ন উদ্যমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। 

ইউক্রেনের ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান:

মিনস্ক ১ ও-২ চুক্তি ভঙ্গের পর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ফার-রাইট অর্থাৎ উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য করা যায় বিশেষ করে ২০১৩-২০১৪ সালের ইউরোমাইদান আন্দোলনের সময় থেকে যেটা ছাত্রদের সংগঠিত করে আকটি আমেরিকান কালার রেভ্যুলুশন ঠিক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের মত। এই ফার রাইট গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সময়ে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলেছে যা রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সংঘাতকে তীব্র করেছে। এই প্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিআইএ এবং অন্যান্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে।

ইউরোমাইদান আন্দোলন, যা ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয়েছিল যেটি মূলত একটি গণতান্ত্রিক ও পশ্চিমাপন্থী আন্দোলন ছিল। তবে, এই আন্দোলনের সময় ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলো ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, রাইট সেক্টর (Right Sector) এবং ভোবোদা (Svoboda) নামক দুটি উগ্র-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ইউরোমাইদান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাইট সেক্টর মূলত বিভিন্ন উগ্র-জাতীয়তাবাদী এবং নয়া-নাৎসি গোষ্ঠীগুলোর একত্রীকরণ দ্বারা গঠিত হয়। এই গোষ্ঠীটি ইউরোমাইদান আন্দোলনে সংঘর্ষে সামনের সারিতে ছিল এবং আন্দোলনকে সহিংস রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, ভোবোদা একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে, ইউরোমাইদান আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিল এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমিতে তাদের প্রভাব বাড়ায়। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের উগ্র-জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ এবং রাশিয়া বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত। আমাদের যে বৈষম্যরিরোধী গ্রুপগুলো সংগঠিত হয়েছে, সেখানেও একটি উগ্রবাদী সহিংস ইসলামী জোট রয়েছে এবং আর একটি রাজনৈতিক জোট রয়েছে। 

ইউক্রেনে ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের মূল কারণ ছিল ইউক্রেনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, সোভিয়েত যুগের পরবর্তী যুগে গণতন্ত্রের দুর্বলতা ও দুর্নীতি। এইসব সুযোগ এবং ইউক্রেনের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিশ্বসঘাতকতা কাজে লাগিয়েই পশ্চিমা বিশ্বের (বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)  সমর্থন ও প্রভাব এই গোষ্ঠীগুলোর উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান

ইউক্রেনে অ্যানার্কিজমের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে মাখনোভিস্ট আন্দোলনের সময় থেকে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলো একটি পুনর্জাগরণ হয়েছে, যা বিশেষ করে ইউরোমাইদান আন্দোলনের সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অ্যানার্কিস্টরা প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইউরোমাইদান আন্দোলনে অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোও অংশগ্রহণ করে, তবে তারা ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর মতো প্রভাবশালী ছিল না। তারা মূলত স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আন্দোলনের সময়, তারা কখনও কখনও ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, কারণ তাদের মধ্যে কিছুটা মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল।

সিআইএ-এর পরিকল্পনা: 

সিআইএ এবং অন্যান্য পশ্চিমা গোপন সংস্থাগুলো ইউক্রেনের ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলো সৃষ্টি করতে এবং তাদের প্রভাব বাড়াতে দীর্ঘ কার্যক্রম চালিয়েছে। তারা একই সময়ে, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ইউক্রেনের সরকারকে ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর অপরাধমূলক কার্যক্রমে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে নিস্পৃহ থাকতে বাধ্য করেছে, যা তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এই ঘটনা আমরা এখন বাংলাদেশেও দেখছি।
ফার-রাইট এবং অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং সিআইএর সম্ভাব্য ভূমিকা ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং রাশিয়া-পশ্চিম সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। রাশিয়া এই গোষ্ঠীগুলোর উত্থানকে পশ্চিমা বিশ্বের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্রিমিয়া দখল এবং দোনবাস যুদ্ধের সূচনা করে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

৮. ২০২২: ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনা

২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। রাশিয়ার ভাষ্যমতে, এই যুদ্ধ মূলত ইউক্রেনের ফার-রাইট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ইউক্রেন সরকার এবং ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ। রাশিয়া দাবি করে যে তারা ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করছে এবং ইউক্রেনকে নাৎসি মুক্ত বা ‘ডি-নাজিফাই’ করতে চাচ্ছে।

৯. ফলাফল ও বর্তমান অবস্থা

ইউক্রেনীয় সমাজের অপরাধীকরণ: 

জেল থেকে সন্ত্রাসীদের মুক্তি, সরকারের সমর্থনে ভীতি সৃষ্টির কৌশল এবং বেসরকারি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ব্যবহার ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার সাথে সাথে সমাজকে অপরাধীকরণের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোমাইদান আন্দোলনের পর থেকে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত জটিল হয়ে ওঠে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে অপরাধী কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এই প্রক্রিয়ায়, সরকার ও সামরিক বাহিনীর কিছু অংশের দ্বারা সন্ত্রাসী এবং অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর ব্যবহার ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

ইউক্রেনের সরকার বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে কারাগার থেকে অপরাধী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের মুক্তি দিয়েছে। এই পদক্ষেপটি মূলত সামরিক বাহিনী ও বেসরকারি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোতে তাদের ব্যবহার করার জন্য নেওয়া হয়েছিল। সরকারের ধারণা ছিল, এই ব্যক্তিদের সামরিক কাজে নিয়োগ করলে তারা দেশের রক্ষায় অবদান রাখতে পারবে, কিন্তু এর ফলে দেশে 
অপরাধীকরণের মাত্রা বেড়ে যায়।

২০১৪ সালে ইউরোমাইদান আন্দোলনের পর, বেশ কয়েকটি ফার-রাইট গোষ্ঠীর নেতাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেকেই নিও-নাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল এবং পূর্বে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। এদের মুক্তি দেওয়ার পেছনে মূলত রাজনৈতিক এবং সামরিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে।

সরকারের সমর্থন ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস

ইউক্রেনের সরকারের কিছু অংশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সহযোগিতায় ২০১৪ থেকেই লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে, যেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে, সরকার বিভিন্ন বেসরকারি মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি করে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নিয়োজিত করেছে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনেকেই দাগী অপরাধী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, এবং তাদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও সীমিত ছিল।

ইউক্রেনে প্রায় ৩০টিরও বেশি বেসরকারি মিলিশিয়া গোষ্ঠী সক্রিয়, যাদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাজভ ব্যাটেলিয়ন, যারা একটি ফার-রাইট বেসরকারি মিলিশিয়া, যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের সমর্থনে, এই গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল। সরকার এবং সামরিক বাহিনী সমাজে ভীতি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। সামরিক বাহিনী এবং বেসরকারি মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যাতে তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা বিদ্রোহ করতে না পারে। এই প্রক্রিয়ায়, ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

সামরিক বাহিনীর সহযোগীতায় বেসরকারি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে উৎসাহের কারণে সমাজে অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা, লুটপাট, এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এইসব কর্মকাণ্ডের পেছনে সরকারি প্রভাব থাকার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সহায়তা নিয়েছে, বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। এই গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক বাহিনী প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত করেছে, এবং তাদেরকে সামরিক অভিযানে ব্যবহার করেছে। তবে, এই প্রক্রিয়ায় সমাজে অপরাধীকরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

আগের পর্বগুলো: