প্রফেসর জামিলুর রেজা স্মরণে

পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু সেটা তথ্য দুর্নীতি ও যেটা করেছে রাষ্ট্রবিরোধী মিডিয়া ও মার্কিন ডিপ স্টেট চক্র

আমি যখন ডিনেটের সিইও তখন পদাধিকার বলে আমি ডিনেটের অন্যতম সহযোগী সংগঠন গুণীজন ট্রাস্টের একজন পরিচালক। গুণীজন ট্রাস্টের তখন সভাপতি হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। 

গুণীজন ট্রাস্টের বোর্ড সভা অনেক সময় ডিনেট কার্যালয়েই হত। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সেই সভাগুলোতে নিয়মিত আসতেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সাহেবের সাথে তখন নানা বিষয়ে কথা হত।  

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী
আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে। এই পদ্মা সেতু শুধু একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোই নয়। এই সেতুর পরিকল্পনা, সেতুটি তৈরীতে আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থাগুলোর আগ্রহ এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ দিতে নানা অবাস্তব শর্তারোপ, হাওয়ায় ভাসা খবর থেকে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দায়িত্বপ্রাপ্তদের অপমান, হেনস্তা ও পরিশেষে অচলাবস্থা তৈরি করার পেছনে আছে ভূরাজনীতিক উদ্দেশ্য এবং ইকনমিক অ্যাসাসিনেশনের প্রচেষ্টা।

বড় শক্তিগুলো যখন এরকম ভূরাজনীতিক খেলা এবং ইকনমিক অ্যাসাসিনেশনের প্রচেষ্টা শুরু করে তখন পরিবেশে তৈরী হয় ধোঁয়াসা। কোন কিছুই তখন পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয় না। এর ফলে মানুষ হাওয়া থাকে সিদ্ধান্ত নেয়, মিথ্যা থেকে মতবাদ তৈরী করে ও সেটায় সমর্থন করে যেতে থাকে। 

এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন পদ্মা সেতুর ছয় পা ওয়ালা পাইলের পিয়ারের (খাড়া পিলার) মত দৃঢ় চরিত্রের যারা সত্যকে ধারণ করে রাখবে, ধোঁয়া ধোঁয়াসা বা স্রোত যত বিভ্রান্তিই তৈরি করুক না কেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে টেকনিক্যাল পরমর্শক দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তেমনই পদ্মা সেতুর পিয়ারের মত দৃঢ় চরিত্রের। 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে সবচেয়ে সহজে যেখানে দুর্নীতি করা যায় সেই ভুমি অধিগ্রহণ বা নদী শাসনে নয়। এমনকি সিংহভাগ অর্থ খরচের মূল সেতু নির্মানেও নয়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে মূল সেতু নির্মানে তদারকি করার যে কনসাল্টেনসি কাজ সেটার। টাকার অঙ্কে সেই পুরো কাজের মূল্য সামান্যই। 

মূল সেতু নির্মানে তদারকি কাজের জন্য ডাকা হয় আন্তর্জাতিক দরপত্র। বড় প্রযুক্তিগত কাজের ক্রয় পদ্ধতি সম্পর্কে যারা সামান্য জ্ঞান রাখেন তারা জানেন এইসব দরপত্র দুই খামে জমা দিতে বলা হয়। একটি খামে প্রযুক্তিগত প্রস্তাব থাকে ও আর একটা খামে থাকে আর্থিক প্রস্তাব। 

প্রথমে প্রযুক্তিগত প্রস্তাবগুলোর খাম খুলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি সক্ষমতা ও কাজের স্পেসিফিকেশন ও কার্য পদ্ধতি যাচাই করা হয়। সেখানে যারা সক্ষম হয় পরবর্তিতে তাদের আর্থিক খামটি খোলা হয়। প্রযুক্তিগত সর্বোচ্চো অবস্থান ও আর্থিকভাবে যৌক্তিক অবস্থান বিবেচনা করে একজনকে কাজটির জন্য বিবেচনা করা হয়। 

মূল সেতু নির্মানে তদারকি করার যে কনসাল্টেনসি কাজ সেটার প্রযুক্তিগত প্রস্তাবগুলোর খাম খুলে প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা সক্ষমতা যাচাই করা টেকনিক্যাল পরমর্শক দলের কাজ। এই কাজের পরই দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় আর্থিক খাম খোলার আগেই। 
এই টেকনিক্যাল পরমর্শক দলের প্রধান ছিলেন প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী। এখানে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে, বা আরও উর্দ্ধতন কেউ প্রভাব খাটাতে চাইলে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর অগোচরে সেটা করা অসম্ভব। 

প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সবসময় বলেছেন প্রাক-যোগ্য দরদাতা নির্বাচনে টেকনিক্যাল পরমর্শক দল যৌক্তিক কারণে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিলে বিশ্বব্যাংক নাখোশ হয়। তারা ঐ ডিসকোয়ালিফাইড প্রতিষ্ঠানকে কোয়ালিফাই করাতে জবরদস্তি করতে থাকে। এর পর দরপত্রে ঐ প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ধরা পড়ে। তখন তারা নিজেরাই দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। 

এই বিষয়ে তখনকার সেতু মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে (দেশ টিভি ২৩ জুন, ২০২২) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন “শুধুমাত্র মূল সেতুর প্রাক-যোগ্য দরদাতা নির্বাচনে বিশ্বব্যাংকের একটি তদবির অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি কার্যকর করতে অপারগতা প্রকাশ করার পরই বিশ্বব্যাংকের ধীরগতি পরিলক্ষিত হয় এবং আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। 

বিশ্বব্যাংক টিইসি (টেকনিক্যাল মূল্যায়ন দল) নির্বাচিত ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে প্রাক-যোগ্য দরদাতা China Construction Communication Company (CCCC)-কে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় অযোগ্য দরদাতা China Railway Construction Company (CRCC)-কে Qualify করতে বলে। 
কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য কোয়ালিফাইড প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য ডিসকোয়ালিফাইড প্রতিষ্ঠানকে অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেয়ায় কোয়ালিফাই করতে অস্বীকৃতি জানায়। 

ডিসকোয়ালিফাইড দরদাতাকে কোয়ালিফাই করার জন্য বিশ্বব্যাংক একাধিকবার তদবির করে। কিন্তু টিইসি তাকে যোগ্য করতে শেষাবধি অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে বড় ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ার আশংকায় CRCC দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। 
এই CRCC-কে যোগ্য করতে ব্যর্থ হওয়ার পরই বিশ্বব্যাংক এবং CRCC এর স্থানীয় প্রতিনিধি আমার নামে (মন্ত্রি আবুল হোসেন) মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে এবং স্থানীয় মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে একটি অশুভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে"। 

পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তার দাপ্তরিক বা কাগজপত্রে দায় টেকনিক্যাল মূল্যায়ন দল এবং তার প্রধান প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর। অথচ কোন অভিযোগে এই দায়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কারন সবাই জানত টেকনিক্যাল মূল্যায়ন দল এবং তার প্রধান প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা নয়। আমার গাট বলে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী যদি দুর্নীতি করার মানসিকতার হতেন তাহলে তিনি গুণীজন ট্রাস্টের বোর্ড সভা করতে নিয়মিত ডিনেট কার্যালয়ে আসতেন না।

পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তোলে তখন বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলো, বেশিরভাগ সাংবাদিক, সম্পাদক, যারা আওয়ামী রাজনীতি করেন না এমন প্রফেশনালেরা ও শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, একাডেমিকস যাদের বেশিরভাগ নিশ্চিত ছিলনে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। 

আজ সেই পদ্মা সেতুকে শুধু সেতু নয়, নিজেদের বিচারবোধ প্রক্রিয়ার আয়না হিসাবে দেখুন। দেখুন আপনি চরম ভ্রান্ত ছিলেন কিনা? এমনই ভ্রান্তির ফলে আমরা শেখ মুজিবকে হারিয়েছি। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা না থাকলে এই সেতুও হারাতাম। এমন পরীক্ষা কিন্তু আবারও আসবে - আবারও ফেল করবেন, নাকি আয়নাতে নিজেকে ভাল করে দেখবেন? নিজেদের বিচারবোধ প্রক্রিয়া উন্নত করবেন!