হারেম। অভিধানে যার সংজ্ঞাটা এরকম: "a sacred inviolable place" যার অর্থ "একটি পবিত্র নিষিদ্ধ স্থান"। একসময় এলিট, তথা রাজা বাদশাদের হারেম থাকত। এক বা একাধিক স্ত্রী সন্তান পরিবার থাকলেও হারেমে থাকা নারীদের সাথে আমোদ ফুর্তি ছিল স্বীকৃত ওপেন সিক্রেট। এখন সেই রাজা বাদশার আমল নাই কিন্তু এলিটেরা আছে, তাই হারেমও আছে। ভিন্ন নামে। ভিন্ন বেশে। এখনকার রাজা বাদশা হলো কর্পোরেট হাউজগুলোর প্রধান যারা। চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও, সিওও, ডিরেক্টর, জিএম এরা। তাদের সীমানার ভেতরে তারাই নানা সাইজের নানা ধান্ধার ছোট বড় সব দিল্লির হারেম।।
রাজা বাদশাদের যেমন নানা রকম শখ থাকত, কারও বাঘ সিংহ শিকার, কারও প্রাসাদ নির্মান, কারও বা সংগীত তানসেন। আবার তাদের মধ্যে যারা নানা মাপের নানা রঙের নিত্য নতুন নারী পছন্দ করতেন, তারা গড়ে তুলতেন নারীসঙ্গ উপভোগের হারেম। আমাদের কর্পোরেট প্রধানেরা অন্য সব শখে প্রাচীন রাজা বাদশাদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও হারেম তৈরীতে পিছিয়ে নেই। এই হারেমগুলোতে যোগ দিতে নারীকর্মীদের উৎসাহ উদ্দীপনারও কমতি নেই।
কয়েকদিন আগে একটি মিডিয়া হাউসের এমন হারেমি চরিত্র মি-টু হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সেখানকার এক নারী কর্মী। যাদের সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। একসময় একই গ্রুপে পরিচালক ছিলাম। এদেশে এমন হ্যাশট্যাগ নগন্য হলেও হারেম কিন্তু নগন্য নয় এবং হারেম শুধুমাত্র মিডিয়াহাউসেই সীমাবদ্ধ নয়। ছড়িয়ে গেছে সবখানে, মাদক চোরাকারবারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। রাজা বাদশা যেখানে, হারেম আছে যেখানে।
তবে আগের দিনের হারেমে সবরকম নারীকে ব্যবহার করা হতো না। বাইজি, নর্তকি, শত্রুরাজ্য থেকে ধৃত নারী, ঘর সংসারে অমোনযোগী অনিচ্ছুক, গান বাজনা আমোদ উল্লাসে উৎসাহী নারীরা স্বীয় যোগ্যতায় হারেমে স্থান পেত। সমাজে একটা পরিষ্কার বিভাজন ছিল, কে হারেমে থাকবে আর কে বাসরে। আমাদের কর্পোরেট হারেমগুলোও এমনই ছিল এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত। যারা নারীলিপ্সু তারা অফিস শেষ করে পেশাগত নারীদের নিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতো। নতুবা তাদের নিয়ে বিদেশে ছুটি কাটাতে চলে যেত।
যারা এমন সম্পর্ক চায় না বা যারা ঘর সংসারী নারী কর্মী, তারা অফিস করত নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র নিয়ে। কিন্তু আধুনিক নারীদের রুপে গুণে অফিসের সবাইকে কুপোকাত করে দেবার যে প্রচন্ড লিপ্সা, তাতে ইদানিং ভেঙে যাচ্ছে সেই বিভাজন। এখন একজন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো পেশাগত উচ্চাকাঙ্খায় বিভোর নারী ভদ্র বেশের মিষ্টি কথার আদব কায়দায় খাঁটি বনেদী নারী পুরুষের ঝকঝকে তকতকে পাঁচতারা মার্কা পরিচ্ছন্ন অফিসে যোগ দেবার পর নিজেই অবাক হয় সে যে এত দক্ষ সেটা সে আগে জানতই না। তরতর করে অফিসের সকল পুরোনো নারী পুরুষ সহকর্মীকে পেছনে ফেলে সে কত দ্রুত বসের ডানহাত এই আনন্দেই সে আত্মহারা।
মহাকর্ষের সকল সূত্রকে ভুয়া প্রমাণ করে তার এই তড়িৎ রকেট গতীর পেশাগত উলম্ফনে সবচেয়ে খুশি হয় তার মা, যে তাকে আরও উৎসাহ দেয়, এগিয়ে যাও বেটা, তুমি আমার ছেলের চেয়েও সফল। মায়েরা ভাবে কি এক মনি মুক্তা আমার মেয়ে। ঠিক তখনই আসে এত সফলদের প্রতি বসের যৌন আবেদনে উদার হবার আহ্বান। মেয়েটা পড়ে উভয় সংকটে। যে বিশাল তারকার আকর্ষণ তাকে সকল মানুষকে বেধে রাখা মধ্যাকর্ষ থেকে এত দ্রুত তুলে এনেছে, সেই তারকার আঁচে যে কত উত্তাপ সেটা সে কখনও ভেবেই দেখেনি।
অনেকের ভাবতে ধান্ধা লাগার কথা যে শত মানুষের, যাদের ৯৫ ভাগ নিয়মিত নামাজ রোজা করে, যেখানে ভদ্র নারী পুরুষেরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিতান্তই আইনসিদ্ধ ও উঁচুমানের পেশাগত কাজ করে সেখানে এমনটি কিভাবে হয়? সবাই কি নতুন আসা মেয়েটিকে ভোগের এই চক্রান্তে জড়িত? যদি সেটা না হয় তাহলে তারা কি এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানে না? যদি জেনে থাক তাহলে মেনে নেয় কিভাবে?
অ্যপেল ইনক বা অ্যাপেল কম্পিউটার কোম্পনীর সিইও স্টিভ জবস সম্পর্কে কথিত আছে যে জবস রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ড তৈরী করতে পারত। অপর এক অ্যাপল কর্মী, উদ্ভাবক কম্পিউটার প্রকৌশলী অ্যন্ডি হার্টজফেল্ডের ভাষ্যে “স্টিভ জবস তার চার্ম, ক্যারিশমা, দাপট, ভাঁওতাবাজী, পেলবতা, চপলতা, নিরন্তর প্রচেষ্টা এগুলোকে প্রয়োগ করে নিজের এবং অন্যের বাস্তবতাবোধ সম্পুর্ন বদলে ফেলতে পারত”। পৃথিবীর সবচেয় মেধাবী ও সফল ডিজাইনার প্রকৌশলী, উদ্ভাবকদের রিয়ালিটি বা বাস্তবতার স্থান কাল মাত্রা যারা বদলে দিতে পারে, সদ্য পাশ করা নতুন পেশাগত জীবনে আসা সুন্দরী নারীদের জীবন, প্রেম, যৌনতার ধারনার বাস্তবতার সেখানে কি পরিনতি হতে পারে? ঐ সব কার্যালয়ের টপ ম্যানেজমেন্টের ব্লকে জীবন, প্রেম যৌনতার সেই একই রকম “রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ড” বিরাজ করে।
এমনই এক অফিসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি আমার কাছে এসে একদিন অনেক কথা বলল চোখের জল সহ। তারপর প্রশ্ন করল “বলেন তো ভাইয়া, আপনি তো জানেন আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে, আমার হাজবেন্ডের সাথে যদিও খুব ভাল সময় যাচ্ছে না, তবুও কি আমার কারও সাথে যৌন সম্পর্ক করা উচিৎ? বুঝতে পারলাম মেয়েটি চুড়ান্ত রকম কনফিউজড। তার অফিসে সে এমনই রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ডে নিমজ্জিত যে তার নিজের বাস্তবতাবোধ লোপ পাচ্ছে। আমি তাকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু সমস্যা হলো আমার মত বাস্তবতায় বাস করে যারা, এইসব স্বপ্ন বাস্তবতার মাঝখানে দোদুল্যমান যারা, তাদের কাছে আমরা নিরস, কাঠখোট্টা দ্বিমাত্রিক ছায়ামানবের মত।
যাদুবাস্তবতায় তারা জীবনের স্বাদ পায়। তাই সকল শয়তানের টার্গেট তারা।
এই রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ড শুধুমাত্র যৌনসুবিধা আদায়ের জন্য তৈরী করা হয় না। এটা কর্মীদের উপর প্রয়োগ করলে তারা কম সুবিধায় বেশি করে খাটতে থাকে। এমনকি অনেকে জীবন উজাড় করে বসের আদেশ পালন করতে থাকে নিজে সর্বহারা হয়েও। এটা কাস্টমারের প্রতি প্রয়োগ করলে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে, বিনিয়োগের চেয়ে লাভ বেশী হয়, কাস্টমার ভাবে সে না কত ভাগ্যবান। এটি সরকারী কর্মকর্তাদেরউপর প্রয়োগ করলে মন্ত্রী সচিব, কর্মকর্তারা আহ্লাদে গদগদ হয়ে যা চাওয়া যায় তাই করে থাকে। এটা ব্যাঙ্কের উপর প্রয়োগ করলে যত খুশি ঋণ পাওয়া যায়। এত বেশী ঋণখেলাপী কি এমনিতেই হয়?
এই রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ড তৈরী করা একটি সাইকোপ্যাথিক ট্রেইট বা লক্ষন। একজন সাইকোপ্যাথের নেশা হচ্ছে ক্ষমতা। যৌনতাও তার কাছে প্রেম বা নিছক শারিরীক আনন্দ নয়, সেটা হলে সে কোন এক যৌনসঙ্গী নিয়ে আনন্দে থাকত। তার নেশা হচ্ছে মানুষকে মানসিক ক্ষমতায় পরাস্ত করে পুরো মানুষটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে তার অস্তিত্বটাকে নিজের করে উপভোগ করা। এই কাজে সবচেয়ে উপযোগী অস্ত্র হলো রিয়ালিটি ডিসটর্শন ফিল্ড তৈরী করা। একটি মানুষকে নিয়ন্ত্রনের সবচেয়ে সফল পন্থা হলো তার বাস্তবতাবোধ সম্পর্কে তার মনেই সন্দেহ জাগানো। তখন সে হয়ে পড়ে সবচেয়ে নাজুক। একে গ্যাসলাইটিং ও বলা হয়ে থাকে। “গ্যাসলাইটিং মানে এক ব্যক্তি তার প্রক্ষেপিত নির্দেশনার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে অন্য কোন ব্যক্তির বাস্তবতার ধারনাকে তার নিজের বিচারবোধ ও অনুভূতির কাছেই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে দেয়া” (Dorpat, T. L. (1994). On the double whammy and gaslighting, Psychoanalysis & Psychotherapy, 11(1), 91-96)।
মজার ব্যাপার হলো যে ব্যক্তি এই গ্যাসলাইটিং এর শিকার, অসীম মানসিক শক্তি, সহ্যক্ষমতা ও দৃঢ়সংকল্প না থাকলে সে নিজেকে এই চোরাবালী থেকে বাঁচাতে তো পারেই না, বরং নিজেকে নিজের সন্দেহ অবিশ্বাস থেকে বাঁচাতে ঐ সাইকোপ্যাথেকে সাহায্য সহযোগীতা ও উষ্ণতা ভালবাসা দিয়ে আরও শক্তিশালী করে। সাইকোপ্যাথরা সবাইকে টার্গেট করে না ভিক্টিম হিসাবে। তারা টার্গেট করে ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে অ্যাম্বিভ্যালেন্ট অ্যাটাচমেন্ট যাদের মূলত তাদের। অ্যাম্বিভ্যালেন্ট অ্যটাচমেন্ট হচ্ছে যে সকল শিশুদের মায়েরা একই সাথে প্রচন্ড তিরস্কার করে থাকে আবার মুখে ভালবাসার বা নির্ভরতার আচরণও দেখিয়ে থাকে।
এইসব শিশুরা মা দুরে থাকলে তাকে অসম্ভব মিস করে, আবার মা কাছে আসলে তাকে অসহ্য লাগে। এই শিশুরাই বড় হলে তারা সহযে সাইকোপ্যাথিক ট্রাপে পড়ে। কারন মানব সম্পর্ক সম্পর্কে তার আত্মবিশ্বাসের চুড়ান্ত ঘাটতি থাকে, ঘাটতি থাকে পরিষ্কার চিন্তার ও খারাপ অবস্থা থেকে সময়মত বের হয়ে যাবার মত মানসিক শক্তির ও উদ্যমের। এইসব মানসিকতার মেয়েদের মধ্যেই দেখা যায় স্টকহোম সিনড্রোম, যেখানে তাকে যে কিডন্যাপ করেছে, অত্যাচার করেছে, তার প্রতি আকর্ষন অনুভব করে সে যতক্ষন না চরম বিপর্যয় নেমে আসে।
নানা গবেষনা বলছে পাঁচজনে একজন কর্পোরেট সিইও সাইকপ্যাথ। সাইকোপ্যাথিক পুরুষেরা ব্যবসায় সফলতর। এটি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে মনে করা হয়ে থাকে ২০৭-২০০৮ এর যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তার একটি কারন সিইওদের সাইকোপ্যাথিক রিয়ালিটি ডিসটর্শন।
তাহলে কি করা? সাফল্যের লক্ষ্যে ছোটা নারী পুরুষেরা, বিশেষ করে মানসিকভাবে নাজুক নারীরা কিভাবে বাঁচাবে নিজেদের এইসব কর্পোরেট সাইকোপ্যাথদের হাত থেকে? এর জন্য এদের সম্পর্কে জানতে হবে। নিজেদের মনকে শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরী করতে হবে সাইকোপ্যাথদের যাতে তারা চিনতে পারে। তরপর কঠিনতর কাজটি হলে ফাঁদে ধরা না দেওয়া বা ধরা দিলেও সময় মত নিজেকে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে যাওয়া চুড়ান্ত ক্ষতির আগেই।
এইসব সাইকোপ্যাথিক শিকারের ঘটনাগুলো এত মসৃণ, পেলব ও মধুর আবেগঘন সিডাকশন ও পারস্পরিক উচ্ছাস আর উদ্দিপনার মধ্যে ঘটে যে ভিক্টিম যে সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে, অপর মেয়েরা তাকে ঈর্ষা করে তার সফলতার। এটা একটি পারস্পরিক প্রক্রিয়া তাই পরিবার, সহকর্মী, সমাজ, রাষ্ট্র, থানা, পুলিশ, এসব চুড়ান্ত ক্ষতি হয়ে যাবার পরে কাজে দিলেও দিতে পারে কিন্তু শুরুতে কখনই সেগুলো সাহায্য করতে পারে না কারন ভিক্টিম নিজেই অতি উৎসাহী থাকে। তাই আগাম শিক্ষা আর চোখ কান খোলা রাখাই একমাত্র পথ।
সেই শিক্ষা নিয়ে আর একদিন লেখা যাবে, যদি কেউ জানতে চায়।