সিকারিও -১

জীবন নামক মুদ্রার ক্রমিক অবমূল্যায়ন

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার টেক্সাসের ২৬ বছর বয়সী যুবক ড্যানিয়েল শেভার অ্যারিজোনার মেসা সিটিতে লা কুইন্টা ইন হোটেলে তার পেশাগত কারনে রাত্রিযাপন করেছিল। পেশায় সে ছিল একজন পেস্ট কন্ট্রোলার যারা ক্ষতিকর পোকামাকড় বা প্রাণী দমন করে থাকে। সেই কারনে তার সাথে ছিল একটি এয়ারগান (প্যালেট গান)।

ঐ দিন কাজে বিরতি থাকায় দুজন বন্ধুকে সে তার রুমে ডেকেছিল আড্ডা মারার জন্য। গল্প করতে করতে বন্ধুদের দেখাবার জন্য সে তার এয়ারগানটি হোটেলের পাঁচতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাক করে। এটা হোটেলের অপর একজন অতিথি দেখে ফেলে ও হোটেল কতৃপক্ষকে জানায়। হোটেল কতৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয় ড্যানিয়েলের কাছে বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র (রাইফেল) আছে এটা ভেবে। পুলিশ আসার আগেই শেভারের দুজন বন্ধুর মধ্যে পুরুষ বন্ধুটি বিদায় নেয় ও মেয়েটি তার সাথে রয়ে যায়।

সামরিক কায়দায় আর্মারড সাজে ছয় জন পুলিশ দ্রুত হোটেল লবিতে আসে ও তারা শেভারকে ও মেয়েটাকে দেখে নিশ্চিত হয় যে কারও হাতেই কোন রাইফেল নাই। তাদের রুম থেকে বের হয়ে আসতে বললে প্রথমে মেয়েটা বের হয়ে আসে ও তারা শেভারকে হেঁটে না এসে ক্রল করে (বুকে হেঁটে) বের হয়ে আসতে বলে। এর পর পুলিশ কর্মকর্তারা শেভারকে গুলি করার ভয় দেখায় এবং অপ্রচলিত ও বিভ্রান্তিকর সব নির্দেশ দেয়।

ঘটনার পরে পুলিশের বডিক্যাম থেকে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিওতে যে কথোপকথন শোনা যায় সেটা ছিল এরকমঃ

পুলিশ অফিসারঃ “তোমরা যদি একটা ভুল কর, তাহলে আমরা তোমাদের গুলি করে ঝাঁজরা করে দেব, বুঝতে পেরেছ?”

[তখন মেয়েটা বের হয়ে আসে যদিও ক্যামেরায় দেখা যায় না, ড্যানিয়েল তখনও ভেতরে]

পুলিশ অফিসারঃ “কোন কথা বলবে না। আমি এখানে তোমার সাথে কৌশলী বা ডিপ্লোম্যাটিক হতে আসি নি, যা বলছি শোনো আর সেটা পালন কর”।

পুলিশ অফিসারঃ “তুমি যদি নড়াচাড়া কর, সেটাকে আমরা আমাদের জন্য বিপদ হিসাবে দেখব ও ব্যবস্থা নেব (গুলি করব) যার ফলে তুমি আর বেঁচে নাও থাকতে পার, বুঝতে পেরেছ?

পুলিশ অফিসারঃ “হাত উপরে তুলে রাখ, এরকম আবার করলে, গুলি করে দেব, বুঝতে পেরেছ”?

ড্যানিয়েল শেভারঃ “দয়া করে গুলি করবেন না, যা বলছেন আমি সেটাই করছি”।

পুলিশ অফিসারঃ “কোন কারনেই হাত নিচে নামাবে না, যদি মনে কর তুমি পড়ে যাচ্ছ তাহলে হাত উপরে রেখেই মুখ ঠুঁকে পড়বে, হাত নিচে নামলে বা হাত পেছনে গেলেই গুলি করব, বুঝতে পেরেছ”?

ড্যানিয়েল শেভারঃ “(কম্পিত কন্ঠে ফুঁপাতে ফুঁপাতে) জি স্যার”।

পুলিশ অফিসারঃ “পা ভাঁজ করে হাত উপরে রেখে আমার দিকে ক্রল করে এগিয়ে এস”।

ড্যানিয়েল শেভারঃ “(কম্পিত কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে) জি স্যার”।

ড্যানিয়েল শেভার কান্নারত অবস্থায় ক্রল করে আসতে আসতে তার হাতটা কোমরের দিকে একটু বাঁকা হতেই পুলিশ অফিসার ব্রেইলসফোর্ডের এআর-১৫ রাইফেল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি এসে শেভারের শরীর ঝাঁঝরা করে দেয় ও সে মৃত্যুবরন করে।

পরে জানা যায় শেভারের ট্রাউজারটি ঢিলা ছিল ও ক্রল করার সময় সেটা খুলে যাচ্ছিল। সেটা টানতেই সে তার একটা হাত ব্যবহার করতে গিয়েছিল। পুলিশ অফিসার ব্রেইলসফোর্ডের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হলেও সে খালাস পেয়ে যায়।

ঘটনাটি ঘটার পর অস্ত্রধারী পুলিশের আচরণ ও গুলি করার ভয় দেখিয়ে আতংকিত করে একজন নির্দোষ সিভিলিয়ানের কাছ থেকে পুলিশ কেমন আচরণ আশা করে সেটা নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে পুলিশের সামরিকীকরণের ফল বলে আখ্যায়িত করে যেটি আমেরিকায় ব্যপকভাবে শুরু হয়েছে এবং তাদের অনুকরণ বা সহায়তায় আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমরা যারা বাংলাদেশের জন্মের সাথে সাথে বড় হয়েছি তারা এদেশেই অনেক কিছু দেখেছি। জিয়ার শাসন আমল পর্যন্ত কিশোর থাকার কারনে যদিও অনেক কিছুই আমাদের বোধের অগম্য ছিল, পরবর্তীতে এরশাদের সামরিক শাসনের নৃশংসতা ও অসভ্যতা আমরা নিজে চোখে দেখেছি। ঐ সময় আমি অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলাম। একবার একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হলো বিদ্যালয় বহির্ভূত কর্মকান্ডের উপর যেখানে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম তরুণ বিজ্ঞানকর্মী হিসাবে এবং সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এসেছিলেন এবং দেশেরও কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অংশগ্রহন করেছিলেন।

সেই প্রোগ্রামে আমরা বুয়েট থেকে শুরু করে গনস্বাস্থ্যকেন্দ্র সহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি এবং সেই তালিকায় ছিল তখনকার প্রেসিডেন্ট এরশাদের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল পুরোনো সংসদ তথা এখন যেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয় সেখানে। সবার সাথে বাসে করে আমি সেখানে উপস্থিত হলাম সপ্তাহখানেক আগে দেওয়া আমন্ত্রণপত্র সহ। কিন্তু কিছু শিক্ষক যাদের বেশিরভাগ গ্রামের স্কুল থেকে এসেছেন তাদের মধ্যে প্রায় জনা দশেক সাথে করে আমন্ত্রণপত্রটি আনতে ভুলে গেছেন।

আমাদের মুল সভাকক্ষে ঢুকতে দিলেও দেখলাম ইউনিফর্ম পরা এক ছোকরা সামরিক অফিসার বাপ দাদার বয়সী শিক্ষকদের লাইন ধরে দাড় করাল। তার হাতে ছিল একটি ছড়ি। সেটি দিয়ে নিজের হাতের তালুতে আঘাত করতে করতে সে শিক্ষকদের সামনে পায়চারী করছে আর বলছে “আই এম ওয়ান্ডার্ড, আই আই এম ওয়ান্ডার্ড”, এই বলে সে শিক্ষকদের নানাভাবে অপমানসুচক কথা বলছে আরও অনেক অতিথি ও কর্মীদের সামনে।

আমি তখন অনেক ছোট কিস্তু গ্রাম থেকে আসা বয়স্ক শিক্ষকদের এভাবে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে অপমান করার যে কোন অধিকার তার নেই এটি আমার কাছে তখনই স্পষ্ট ছিল। আমার তখনই মনে হয়েছিল যে হয় তাদের সে ঢুকতে দেবে না, বা ঢুকতে দেবে, তবে দুটোই সন্মানের সাথে করতে হবে। এটি না করতে পারলে ঐ সামরিক কর্মকর্তা শুধু অযোগ্যই নয় সে মানুষের অধিকার হরন ও মানুষকে অ্যাবিউজ করার অপরাধে অপরাধী।

সারা দুনিয়াতে সামরিক বাহিনীতে যারা কাজ করে তারা কখনও এই সন্মানটা দিতে পারে না কারন এর উল্টোটা করা তাদের প্রশিক্ষনের অংশ। তাদের কোর ভ্যাল্যু থেকে অ্যানোনিমাস বা গোত্রপরিচয়হীন মানুষের প্রতি যে সমমুল্যায়নের মুল্যবোধ সেটা মুছে ফেলা হয়। জাস্ট মানুষ তাই তারা রেসপেক্ট ডিম্যান্ড করে এই বোধটা থাকলে সে অপরিচিত মানুষ লক্ষ্য করে ট্রিগার টানতে বা দার দেহে বেয়োনেট ঢুকাতে দ্বিধা বোধ করবে। যুদ্ধকালিন সয়ম এটিই তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তাই বাই ডিফল্ট একজন সামরিক ব্যক্তি অবিশ্বাসী। সেই কারনেই তাদের ব্যারাকে পোশাক ব্যাজ পরা এত গুরুত্বপুর্ণ। এই ট্রেনিংটাকেই বলা হয় ডিসোশালাইজেশন।

ঐতিহাসিকভাবে কৃষি সভ্যতার প্রসারের পর থেকে শহরগুলো তৈরী হতে শুরু করে বিশেষতঃ শস্য সংরক্ষন ও ব্যবসা বানিজ্যের সুবিধার জন্য। কিন্তু শহরগুলো বড় ও সামরিক ক্ষমতায় শক্তিশালী হবার পর থেকে শহরগুলো বিস্তৃতি লাভ করে সামরিকতার প্রসার থেকে। কোন দুর বিরানে কৌশলগত কারনে তৈরী হয় একটি সামরিক ব্যারাক, তার নিকটে গড়ে ওঠে একটি পতিতালয় সৈনিকদের চাহিদা মেটানোর জন্য। তারপর তাদের প্রয়োজনে কিছু দোকান, বাজার। তারপর একটি মসজিদ বা গীর্জা –পাপক্ষালনর জন্য। এটিই বেশিরভাগ আধুনিক শহর জন্মগ্রহণের ইতিহাস। ঢাকা শহরের ইতিহাসও অনেকটা তাই।

সামরিকতা ও যৌনপল্লিগুলোর কারনে নতুন স্থানে শহর তৈরী হলেও সেটি যদি ব্যবসা বানিজ্যের সুবিধার কারনে বিস্তার লাভ করে তখন এই দুটি অতি প্রয়োজনীয় পেশার মানুষদেরকে শহরের বাইরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখাই সব সংস্কৃতিতে মেনে চলা হয়। এর কারন বাই ডিফল্ট একজন সামরিক ব্যক্তি যেমন সামাজিক কনস্ট্রাক্ট বিহিন অবিশ্বাসী, বাই ডিফল্ট একজন যৌনকর্মীও সামাজিক কনস্ট্রাক্ট বিহিন ফলে তাদের উভয়ের বেচে থাকার মূল সূত্র বিশ্কাস না করা। শত্রুর ভালমানুষ চেহারায় যদি সৈনিক বা খদ্দেরের প্রেমপুর্ণ কথায় সে যদি যৌনকর্মী বিশ্বাস করে বসে, তাহলে তাদের জীবন রক্ষা বা ব্যবসা হবে না। উভয়ের প্রাথমিক শিক্ষা তাই, মানুষকে বিশ্বাস না করা। অথচ সিভিল সমাজ ও সংসার চলে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসের উপরে।

সামরিক ব্যারাক ও যৌনপল্লিকে সমাজ থেকে দুরে রাখার আরও কারন হলো সৈনিক আর যৌনকর্মী এই দুই পেশায় মানুষকে এমন কিছু করতে হয় যেটা মানুষের কোর ভ্যাল্যুর বিপরীত। মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগ মানুষের জন্ম বা মৃত্যুর মত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। একজন সৈনিককে নির্দিধায় আর একজন মানুষকে হত্যা করার জন্য তৈরী করা হয়। অপর দিকে একটি শিশুর জন্ম দেবার জন্য যে আবেগ সেটি একটি নারীর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী। একজন যৌনকর্মীকে সেটা অবজ্ঞা করতে শিখতে হয় পেশাগত কারনে। কোর ভ্যাল্যু ও শক্তিশালী আবেগগুলোকে অবজ্ঞার এই শিক্ষা বাকি মানুষদের সাথে আপাতবিরোধ বা কনফ্লিক্ট তৈরী করে।

মিলিটারি টার্মে এটাকে বলা হয় ডিসোশালাইজেশন ও রিসোশালাইজেশন, যার মাধ্যমে এই নতুন কোর ভ্যাল্যু বা গভীর মুল্যবোধ তৈরী করা হয় যেটি তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হয়।

প্রথম ধাপ: পরিচয় আত্মসমর্পণ (Identity Surrender)। এর মাধ্যমে তার বর্তমান পরিচয় বা ব্যক্তিত্বকে বাতিল করা। তার শেকড়, সংস্কৃতি, পরিবার, ট্রাডিশনাল মুল্যবোধ ও নর্মগুলোকে নিয়মিত দলগতভাবে হেয় করে তাকে তার নিজের শেকড়কে হেয় করতে শেখানো হয়। এর পর পোশাক, পদবী, ও ব্যক্তিত্বে তাকে করবে উন্নততর শ্রেণীভুক্ত এই ধারণা দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় ধাপ: আদর্শের অনুকরণ (Role Modelling)। এই পর্যায়ে সে যখন নিজের পুর্ব পরিচয় হারিয়ে বিভ্রান্ত তখন তার কাছে কিছুটা সিনিয়র এমন কেউ তার কমান্ডার, যিনি ঈশ্বরসম অসীম ক্ষমতাধর কিন্তু আবার পিতৃস্থানীয় শুভাকাঙ্খী বন্ধু এমন রোল প্লে করে থাকেন। এই সময় তাকে কঠোর শাস্তির ভয় ও পুরষ্কার এই দুই মানসিক বৈপরিত্বের মাঝে এমনভাবে আটকে ফেলা হয় যে তার মুক্ত চিন্তার কোন অবকাশ থাকে না। সে উক্ত সিনিয়র ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশিল হয়ে পড়ে।

তৃতীয় ধাপ: নিষ্ঠুরীকরণ (Brutalization)। এই পর্যায়ে তাকে শান্তি আর শুভর রক্ষাকর্তা হিসাবে ইপস্থাপন করা হয়। এবং তার বেয়নেটের সামনে যে থাকবে তাকে তার কল্পিত শত্রুর রোল মডেল প্লে করতে অভ্যস্ত করানো হয়। যেমন আমেরিকান সৈন্যদের বেয়োনেট প্রাকটিসে টার্গেট একজন লাল কম্যিউনিস্ট, বা জিহাদী, পাকিস্তানের জন্য 'মালাউন' ভারতীয় সৈন্য ইত্যাদী রোল প্লেতে অভ্যস্ত করানো হয়। যখন সে সম্পুর্ণ ভিন্ন কারও শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করবে তখনও তার মনে ভাসে সে তার সেই কল্পিত শত্রুই খতম করছে।

আধুনিক সভ্যতার শুরু থেকেই তাই সামরিক বাহিনী ও যৌনকর্মীদের সিভিল সমাজ থেকে আলাদা রাখা হয়। এমনকি শান্তিরক্ষা ও আইন প্রয়োগের জন্যও তাদের ব্যবহার করা হয় না জরুরী অবস্থা ছাড়া। ব্যবহার করা হয় সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে যাদের সামাজিক বা কোর মুল্যবোধ সাধারন মানুষদের মত একই। ডিসোশালাইজেশন ও রিসোশালাইজেশনের মাধ্যমে নবায়নকৃত নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম ইসরাইলে পুলিশ ও সিভিল বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু হয় এবং পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্রুটালাইজ করা হয়। এই কাজটিকে বলা হয় মিলিটারাইজেশন অব পোলিস বা পুলিশের সামরিকীকরণ।

সত্তুরের দশকে আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের যুদ্ধে জড়িত তখন থেকে আমেরিকার রাজনীতি নীতিহীন ও জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। নিক্সন কিসিঞ্জারের হাত ধরে যে কর্পোরেট মিলিটারি এলিটিজম দাপটের সাথে সারা দুনিয়ায় নোংরাতম ধনতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে থাকে তার ফলে মার্কিন সমাজে গুন্ডামি, মাস্তানি ও নেশার রাজত্ব কায়েম হয় যেখানে ড্রাগ লডেরা বা গডফাদাররা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। আশির দশকে মার্কিন সমাজে যখন বহু রাজ্য ক্রিমিনালদের নিয়ন্ত্রণে তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে মার্কিন পুলিশের সামরিকীকরণ শুরু হয়।

শুরুর দিকে এই সামরিকিকরণ শুধু সোয়াট বা এলিট ফোর্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে নাইন ইলেভেন ঘটনার পর সেটা নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সকল রাজ্যে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৩ সালে 1033 প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্পের অধীনে ইরাক, আফগানিস্থান ও অন্যান্য যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রচুর পরিমান নতুন ও পুরানো ভারী ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, সরঞ্জাম ও আর্মার্ড ভিহিক্যাল বা সাঁজোয়া যান সিভিল পুলিশকে প্রদান করা হয় যার মধ্যে রকেট লাঞ্চার ও বেয়োনেটও আছে।

এটির সাথে সাথে সন্ত্রাস দমনের নামে সামরিক বাহিনির কন্ডিশন্ড রেসপন্স অব কিলিং কে পুলিশ প্রশিক্ষনের অংশ করে তোলা হয়। সন্ত্রাস দমনের নামে এগুলো করা হলেও এই প্রক্রিয়া আসল উদ্দেশ্য হল সাধারন জনগনকে প্রতিবাদ, বিপ্লব বা সিভিল রেজিস্ট্যান্সে অক্ষম করে তোলা যাতে রাষ্ট্র যা করবে সেটা বিনা প্রতিবাদে মানতে মানুষ বাধ্য হয়। এর সাথে যুক্ত হয় সামরিক গোয়েন্দাদের এসপিওনাজে ব্যবহৃত ট্যাকটিকগুলো জনগন বা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা।

২০০২ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশকে অনেক সামগ্রী ও ট্রেনিং সহায়তা দেয়। তার কিছুদিন পরেই এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান বা র‌্যাব জন্মলাভ করে। ঐ সময় থেকেই আমরা দেখি আমাদের পুলিশের আচরণে পরিবর্তন। তখনকার বিরোধী দলগুলোর প্রতি পুলিশের আচরণ ছিল চরম হিংস্র ব্রুটাল ও অগনতান্ত্রীক যেটা আমাদের দেশে কখনও ছিল না এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়।

আমাদের সবার অলক্ষ্যে বাংলাদেশেও তখন থেকেই ঘটেছে মিলিটারাইজেশন অব পোলিস বা পুলিশের সামরিকীকরণ। আশ্চর্য্য হলো বুঝে হোক না বুঝে হোক দক্ষিন এশিয়ার গর্ব যে রাজনৈতিক দল। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গনতান্ত্রীক নেতাদের একজন যে বঙ্গবন্ধু, তার দল ও আমাদের মত বাকস্বাধীনতা ও গনতন্ত্রীদের ভরসা মনে করি আমরা যে দলকে, সেই দলই পুলিশের এই সামরিকীকরণকে আরও বাড়িয়েছে এবং দেশকে একটি বিভিষিকাময় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যেই আমেরিকা সহ নানা দেশের গবেষনায় দেখা গেছে পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ আসলে অপরাধ বৃদ্ধি করে এবং অপরাধীদেরও নৃসংশ ও ব্রুটাল করে তোলে, ইসরাইল যার উদাহরণ। পরের পর্বে লিখব পুলিশের সামরিকিকরণের ফল কি হতে পারে।