দায়ী কে?

রাজনীতিতে ডাকাতি প্রতিষ্ঠা

একটি কাজে সাভারের সিআরপির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টরের সাখে দেখা করতে সাভারে যেতে হয়েছিল। সেদিন ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত রাজনৈতিক অবরোধ কর্মসূচির দিন যার ফলে রাস্তায় ট্রাফিক কম থাকারই কথা। দ্রুতই সাভার পৌঁছে কাজ সেরে ফেরার পথে দেখি ফেরার পথ একদমই ফাঁকা। এর কারণ রাজনৈতিক অবরোধ কর্মসূচি নয়। এর কারণ সাভারে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কোন নেতার কর্মসূচী। যার ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে এবং রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম লেগে গেছে তাই জ্যামের পরে রাস্তা একেবারে ফাঁকা।

যারা সেই কর্মসূচীতে এসেছে তাদের বেশিরভাগ এদেশের চীরায়ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারীদের মত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মিশ্র অর্থনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক চরিত্রর নয়। তারা বেশিরভাগ বয়সে তরুন, পোশাকে স্মার্ট ও অনেকেই এসেছে মোটরসাইকেলে। তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে তারা বর্তমান রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুবিধাভোগী স্মার্ট প্রজন্ম।

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা ১৮৯৬ জন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিআইবির তৈরি করা ‘হলফনামার তথ্যচিত্র’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেওয়া চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে রাজনীতিকে পেশা দেখিয়েছেন মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের মূল পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে যে মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ যে পেশাগতভাবে রাজনীতিবীদ সেটা আমার উপরের দেখা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারীদের চেহারা দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ মূল পেশা যে দেখিয়েছেন ব্যবসা, আমার মনে হয় সেখানে আমাদের বোঝার একটু ভুল আছে। এই ৫৭ শতাংশের মূল পেশা ব্যবসা দেখালও সেটা কাগজে কলমে মাত্র। এদের মূল পেশা ডাকাতি। ক্ষমতা ও সংসদ তথা আইন কানুন এই দুটোকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার নামে তারা আসলে অর্থনৈতিক ডাকাতি করে।

টিআইবি এবং মিডিয়া নির্বাচনে এইসব চূড়ান্ত প্রার্থীদের সম্পদের বৃদ্ধি নিয়ে খুবই উৎসাহের সাথে সোচ্চার। অথচ তারাই নির্বাচনে অংশ নেওয়া পেশাগত রাজনীতিবীদদের সংখ্যা ২ দশমিক ৮৬ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। রাজনীতিবীদদের চুরির ঘটনাগুলোর তিলকে তাল বানিয়ে নিয়মিত প্রচার করে তারা পেশাগত রাজনীতিবীদদের নির্মূল করে ডাকাত ব্যবসায়ীদের সেই স্থানে বসার সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। সম্পদের বৃদ্ধির বিষয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে মাত্রাহীন কর্মকান্ড করতে গিয়ে তারা জনগণের ক্ষমতায়নকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছে। পরিণতিতে চোরের স্থানে ডাকাত প্রতিস্থাপিত হয়েছে এবং জনগণ ক্রমেই ক্ষমতাবঞ্চিত হয়েছে যার চুড়ান্ত রূপ প্রকাশ পাবে পরবর্তি সরকার গঠনে।

প্রকৃতিবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বা ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্য ও নাজুকতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে ভাল মন্দ মিলে অর্থাৎ সহায়ক ও ক্ষতিকর উভয়ের প্রতিরোধের মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিটি ইকোসিস্টেমের একটি নিজস্ব অর্গ্যানিক স্থিতাবস্থা থাকে। বাইরে থেকে কোন শক্তি যদি অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করে তাহলে সেটি উক্ত অর্গ্যানিক স্থিতাবস্থাকে ব্যহত করে এবং ইকোসিস্টেমটিকে নাজুক করে ফেলে। উক্ত নাজুকতা সুযোগ সৃষ্টি করে নতুন শক্তির ডাকাতি করার বা সম্পদ লুন্ঠন করার। গত এক যুগে পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পগুলো এবং সরকারী নানা নিয়ম কানুন আমাদের প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমগুলোর অর্গ্যানিক স্থিতাবস্থাকে সেভাবেই বিনষ্ট করেছে যার ফলে চরমভাবে বিপন্ন হয়ে গেছে টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবনের মত ইকোসিস্টেমগুলো। উল্লেখ্য যে পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পগুলো এবং সরকারী নিয়ম কানুনগুলো আপাতভাবে ভাল উদ্দেশ্যে করা হলেও সেগুলো যদি ইকোসিস্টেমগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও যথাযথ ফিডব্যাক ও মনিটরিং ব্যবস্থাসহ প্রয়োগ না করা হয় তাহলেও উক্ত নাজুকতা তৈরী হবে।

আমাদের রাজনৈতিক ইকোসিস্টেমেও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রাইভেট মিডিয়া মুক্ত হবার পর টিআইবির মত প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের মিডিয়া গত ৩০ বছর ধরে রাজনীতিবিদদের তিলকে তাল করে প্রচার করে আমাদের রাজনৈতিক ইকোসিস্টেমকে নাজুক করেছে। টিআইবি বা আমাদের মিডিয়া কেউই আপাতভাবে অসৎ উদ্দেশ্য সেটা করেনি। দুটো বিষয় এখানে অবদান রেখেছে। একটি রাজনীতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা এবং দুই তাদের অর্থ সরবরাহকারী বা পে মাস্টার যারা, অবচেতনভাবে তাদের মনবাঞ্ছনা পূর্ণ করা। এদেশে সংবাদপত্রগুলো চালিত হত রাজনীতি বোদ্ধাদের দ্বারা। তাদের অবস্থান ছিল গণমানুষের পক্ষে এবং রাজনীতিবিদদের সহায়তায়। সেই কারণে মুক্তির আন্দোলন ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় পেয়েছি। টিআইবির কাজ রাজনৈতিক ইকোসিস্টেমে প্রভাব বিস্তার করে। তাদের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ আছে কি? তারা কারা? বর্তমানের মিডিয়াহাউজগুলোর রাজনীতিজ্ঞান কতটুকু? এখন টিআইবির মত প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্র উভয়েরই পে-মাস্টার হল কোন না কেনভাবে দেশি বা বিদেশি ধনতন্ত্র নামের ডাকাততন্ত্র। অবচেতনভাবে তাদের মনবাঞ্ছনাই পূর্ণ হচ্ছে রাজনীতিতে ডাকাতি প্রতিষ্ঠা কারার মাধ্যমে।