গতকাল সোমবার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকার করেছেন। সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার একটি রূপরেখাও নাকি দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে জাপানের অনুকরণে সংস্কার প্রস্তাব যেখানে পাবলিক সেফটি কমিশনের অধীনে চলবে পুলিশ তেমন একটি রূপরেখাও আমরা দেখছি যে অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয় যেটি আবার সচল হয়েছে।
মনে হচ্ছে কোটা নিয়ে ধোকা দিয়ে পুরো এই সরকার পরিবর্তন ও পরবর্তী সব পদক্ষেপই বহু আগে থেকেই পরিকল্পনা করা যার উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে জাপানের 'রেড পার্জ' মডেলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করাই মহা পরিকল্পনা। আশ্চর্য হচ্ছে জাপানের বিজয়ী পক্ষ পরাজিত পক্ষের জাতীয়তাবাদ দমন করেছে আর আমাদের দেশে এখন পরাজিত পক্ষের সমর্থকেরা বিজয়ী পক্ষের জাতীয়তাবাদ দমন করার চেষ্টা করছে। এই খর্ববুদ্ধি পরিকল্পনা সফলতো হবেই না, এটির প্রচেষ্টা বরং দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। যারা এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, এই দেশে থাকতে চান, তাদের সবাইকে বর্তমানে এই অবৈধ সরকার যে মহা বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা সম্পর্কে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে।
জাপানে 'রেড পার্জ' (Red Purge) অভিযান যার উদ্দেশ্য ছিল জাপানে জাতীয়তাবাদ দমন এবং বামপন্থী উচ্ছেদ সেটা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান পরাজিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে আসে। আমেরিকান দখলদার প্রশাসনের অধীনে (১৯৪৫-১৯৫২), জাপানের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। এই সময়ে জাপানের ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদ এবং বামপন্থী প্রভাব উভয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, একদিকে জাতীয়তাবাদ নতুন করে উগ্র সামরিক শাসন বা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পুনরুত্থান ঘটাতে পারে, এবং অন্যদিকে বামপন্থী শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতাদর্শের প্রতি জাপানকে আকৃষ্ট করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, 'রেড পার্জ' অভিযান শুধুমাত্র বামপন্থী এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিতই হয়নি, বরং এটি জাপানের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদও নির্মূল করার একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা ছিল।
'রেড পার্জ' অভিযান:
ক: বামপন্থী শক্তির উচ্ছেদ
১. প্রাথমিক প্রভাব এবং লক্ষ্যবস্তু:
১৯৪৯-১৯৫০ সালের সময়কালে শুরু হওয়া 'রেড পার্জ' অভিযানের প্রথম লক্ষ্য ছিল জাপানের কমিউনিস্ট পার্টি (JCP) এবং তার সমর্থকরা। কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং ১৯৪৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছিল। তবে আমেরিকান দখলদার প্রশাসন এই পরিস্থিতিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বের জন্য একটি বিপদ হিসেবে দেখেছিল এবং তারা দ্রুত কমিউনিস্ট প্রভাব দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২. জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী উভয়ের দমন:
জাপানের জাতীয়তাবাদী শক্তি, যারা যুদ্ধের সময় সামরিকবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক ছিল, তারা যুদ্ধের পর বামপন্থী শক্তির উত্থান দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। অনেক জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ এই সময়ে বামপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে আমেরিকান প্রশাসনের দৃষ্টিতে, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বামপন্থী মতাদর্শ উভয়ই বিপজ্জনক ছিল। ফলে, তারা দুটো প্রবণতাকেই দমন করার জন্য 'রেড পার্জ' অভিযানের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার চালায়।
৩. অভিযানের প্রক্রিয়া এবং পদক্ষেপ:
‘রেড পার্জ’ অভিযানে প্রায় ২০,০০০ কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তবে এই অভিযানের ব্যাপ্তি শুধুমাত্র কমিউনিস্টদের উপর সীমাবদ্ধ ছিল না; যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যেসব জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সামরিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখতে চেয়েছিল, তাদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এর ফলে জাপানের রাজনৈতিক, সামরিক, এবং শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বামপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ উচ্ছেদ করা হয়।
৪. গণমাধ্যম এবং শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ:
জাপানের গণমাধ্যম এবং শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। তাই আমেরিকান প্রশাসন গণমাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে 'রেড পার্জ' অভিযান পরিচালনা করে। বামপন্থী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের বরখাস্ত করা হয়, এবং শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে সামরিক জাতীয়তাবাদ এবং কমিউনিজমের প্রতি ঘৃণা জন্মে।
খ: জাতীয়তাবাদ দমন এবং এর প্রভাব
১. নতুন সংবিধান এবং প্যাসিফিজমের প্রচলন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে জাপানে ১৯৪৭ সালে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, যেখানে যুদ্ধ পরিত্যাগ এবং সামরিক বাহিনী রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এতে করে জাপানের ঐতিহ্যবাহী সামরিক জাতীয়তাবাদকে কার্যত সংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। প্যাসিফিজমের এই নীতি পরবর্তীকালে জাপানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করে।
২. রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্গঠন:
'রেড পার্জ' অভিযানের মাধ্যমে বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী দলগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। আমেরিকান দখলদার প্রশাসনের সহায়তায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (LDP) এবং অন্যান্য ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান ঘটে, যারা মার্কিন নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী প্রভাব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে।
৩. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব:
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমেরিকান দখলদার প্রশাসন জাপানে একটি নতুন সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ প্রচলিত করতে চায়, যা ছিল মূলত আমেরিকান গণতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে, জাপানের ঐতিহ্যবাহী সামরিক ও জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটি নতুন ধরনের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৪. শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘটের উপর প্রভাব:
জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনগুলোর উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। 'রেড পার্জ' অভিযানে অনেক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব পরিবর্তন করা হয় এবং বামপন্থী আন্দোলনের নেতাদের বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে, জাপানে শ্রমিক আন্দোলনগুলোর শক্তি কমে যায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়।
গ: ফলাফল
জাপানের 'রেড পার্জ' অভিযান শুধুমাত্র একটি কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযান ছিল না; এটি মূলত জাপানের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো থেকে বামপন্থী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রভাব উচ্ছেদ করার একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা ছিল। আমেরিকান দখলদার প্রশাসন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাপানের রাজনীতি ও সমাজকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল, যাতে এটি আমেরিকান নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এর ফলে জাপানে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ডানপন্থী এবং মধ্যপন্থী রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বামপন্থী শক্তি কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। 'রেড পার্জ' অভিযান তাই জাপানের যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবে চিহ্নিত হয়, যা দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক চেতনা এবং সমাজকে পুনর্গঠন করতে সহায়ক হয়।
ছবি: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের আত্মসমর্পন এবং ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ জাপানে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী মামোরু শিগেমিতসু ইউএসএস মিসৌরি যুদ্ধ জাহাজে জাপানি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করছেন এবং মার্কিন জেনারেল রিচার্ড কে. সাদারল্যান্ড ও অন্য সৈন্যরা সেটা দেখছেন।