দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর চরম বিপর্যয়ের পর ১৯৪৮ সালের মে মাসে যখন ইসরাইল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল, তখন হিটলারের হলোকস্টের ভয়াবহতার পর ইহুদিদের জন্য এটি ছিল আশা আর সংকল্পের প্রতীক। হলোকস্টের ছাই থেকে উঠে আসা একটি জাতি, যারা একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু এখন, ২০২৫ সালে, ইসরাইল তার ৮০তম বছরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং তাদের সমাজে প্রচলিত একটি অশুভ অভিশপ্ত বাণীর অলিখিত ভয় তাদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে যাকে বলা হয়ে থাকে "অষ্টম দশকের অভিশাপ"। এই ধারণা, যেটি তাদের ধর্মতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে, সেটি ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েলের জন্য ২০২৮ সাল একটি সংকটের মুহূর্ত হতে পারে, যেখানে ঐশ্বরিক বিচার, অভ্যন্তরীণ সামাজিক, মনস্তাত্বিক ও রাজনৈতিক বিভেদ, এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রটির ভাগ্য নির্ধারণ করবে। এই গল্প আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন আমরা ইসরায়েলের বর্তমান সংকটের দিকে তাকাই—ইরানের সাথে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ, যা ১৩ জুন, ২০২৫ সালে শুরু হয়েছে, এবং যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা ইসরাইলকে একা লড়তে বাধ্য করছে। ইসরায়েলের নগর-রাষ্ট্রীয় গঠন, ইবন খালদুনের সামাজিক চক্র তত্ত্ব, এবং পল কেনেডির সাম্রাজ্যের পতনের বিশ্লেষণ এবং আমার মনস্তাত্বিক পতনের ধারণা এই অভিশাপের গল্পকে আরও গভীর করে।
ঐশ্বরিক দৃষ্টিকোণ: একটি চুক্তিভিত্তিক জাতির পরীক্ষা
ইসরায়েলের গল্প শুরু হয় তোরাহ, তানাখ বা ইহুদি বাইবেলের পাতায়, যেখানে তারা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত। উৎপত্তি পুস্তকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে আব্রাহামের বংশধররা একটি মহান জাতি হবে, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির সাথে এসেছিল শর্ত—ঈশ্বরের আদেশ মান্য করতে হবে। গীতসংহিতার ৯০:১০ পদে (Psalm 90:10:) বলা হয়েছে, মানুষের জীবন সাধারণত সত্তর বছর, আর শক্তিশালী হলে আশি বছর, কিন্তু এই সময় শ্রম ও দুঃখে পূর্ণ। ধর্মতাত্ত্বিকরা এই শ্লোকটিকে কেবল ব্যক্তির জীবন নয়, জাতির জীবনচক্রের প্রতীক হিসেবেও দেখেন। ইসরাইল, যা ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এখন তার অষ্টম দশকের দিকে এগোচ্ছে, এবং অনেকে বিশ্বাস করেন যে ২০২৮ সাল হবে এর চুক্তিভিত্তিক বিশ্বস্ততার চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়।
ইরানের সাথে চলমান যুদ্ধ এই পরীক্ষার একটি রূপ নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলের "অপারেশন রাইজিং লায়ন" ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা যেমন নাটানজ ও আরাকের উপর আঘাত হেনেছে, কিন্তু ফোর্ডোর গভীরে লুকানো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের প্রতিশোধমূলক ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১,০০০ ড্রোন হামলা ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে তেল আবিব ও বিয়ারশেবার হাসপাতালে আঘাত করেছে। এই সংঘাতে ২৪ জন ইসরায়েলি এবং ২২৪ থেকে ৫৮৫ জন ইরানি, বেশিরভাগ বেসামরিক, প্রাণ হারিয়েছে। এই মানবিক ক্ষতি কেবল যুদ্ধের ভয়াবহতাই নয়, নৈতিক প্রশ্নও তুলেছে। কিছু ধর্মতাত্ত্বিক এই সংকটকে ঈশ্বরের বিচার হিসেবে দেখেন, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ—যেমন ২০২৩ সালের বিচারিক সংস্কার বিক্ষোভ—এবং ফিলিস্তিনি সংঘাতের জন্য একটি শাস্তি।
ইহুদি পণ্ডিতরা ১৯৪৮ সালের ইসরাইল রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে ইজেকিয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা হিসেবে দেখেন, যেখানে ঈশ্বর নির্বাসিত ইহুদিদের ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু তারা সতর্ক করেন, ইসরায়েলের আধ্যাত্মিক অবস্থা এর ভাগ্য নির্ধারণ করবে। খ্রিস্টান ইভানজেলিকালরা মনে করেন, মথি ২৪:৩৪-এর "এই প্রজন্ম" ইসরায়েলের পুনর্জন্ম দেখেছে, এবং ২০২৮ হতে পারে শেষকালীন ঘটনার শীর্ষ। তবে, মূলধারার ধর্মতাত্ত্বিকরা সতর্ক করেন, এই সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ঝুঁকিপূর্ণ। তারা বলেন, ইরান যুদ্ধ এবং মার্কিনী সমর্থনের অভাব ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, ঐশ্বরিক অভিশাপ নয়। তারা শান্তি ও মানবিকতার পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান।
ঐতিহাসিক দিগন্ত: একটি নগর-রাষ্ট্রের মৃত্যু চক্র
ইসরায়েলের গল্প কেবল ধর্মীয় নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর। এটি একটি নগর-রাষ্ট্রের মতো—ছোট, কেন্দ্রীভূত, এবং তীব্র জাতীয় ঐক্যে গড়ে উঠছিল। মাত্র ২২,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এবং তেল আবিব ও জেরুজালেমের মতো নগরে জনসংখ্যার বড় অংশ নিয়ে ইসরাইল প্রাচীন এথেন্স বা মধ্যযুগীয় ভেনিসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই নগর-রাষ্ট্রীয় গঠনই অষ্টম দশকের অভিশাপকে আরও বাস্তব করে তুলছে। এর সাথে বর্তমানের ইসরাইল যেন একজন একরোখা একনায়ক যুদ্ধবাজ রাজার রাজ্য যেখান প্রাক্তন বেঞ্জামিন নেতানিয়ায়ুই সর্বেসর্বা গত তিন দশক থেকে। বেঞ্জামিন নেতানিয়ায়ুই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এর একজন যুদ্ধফেরত কর্মকর্তা এবং তিনি আইডিএফ-এর একটি বিশেষ গোপন ইউনিট, সায়েরেত মাতকেল এর সক্রিয় কর্মী। ইবন খালদুন, ১৪শ শতাব্দীর আরব দার্শনিক, তার ‘মুকাদ্দিমা ’ গ্রন্থে বলেছিলেন, রাষ্ট্রগুলি জন্ম নেয় গভীর সামাজিক আবেগের ঐক্য বা ‘আসাবিয়া’ থেকে, কিন্তু সময়ের সাথে বিলাসিতা, বিভেদ, এবং কেন্দ্রীকরণ এই ঐক্য ক্ষয় করে, যা পতনের দিকে নিয়ে যায়। পল কেনেডি, আধুনিক ইতিহাসবিদ, তার ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য গ্রেট পাওয়ার্স ’ গ্রন্থে বলেছেন, যখন সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্থনৈতিক ও নৈতিক স্থিতিশীলতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন রাষ্ট্রগুলি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। ইসরায়েলের বর্তমান সংকট এই দুই তত্ত্বের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে।
ইসরায়েলের যাত্রা শুরু হয়েছিল জায়নবাদী স্বপ্নের ‘আসাবিয়া’ দিয়ে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ এবং ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে এই ঐক্য ইসরাইলকে অপরাজেয় করে তুলেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে, ফিলিস্তিনি দখল, ধর্মনিরপেক্ষ-ধার্মিক বিভেদ, এবং ২০২৩ সালের বিচারিক সংস্কার বিক্ষোভ এই ঐক্যকে ক্ষয় করেছে। ইবন খালদুনের তত্ত্ব অনুসারে, ইসরাইল এখন তার জীবনচক্রের চতুর্থ প্রজন্মে, যেখানে নগর রাজ্যের শহুরে বিলাসিতা ও মানসিক বিভেদ ‘আসাবিয়া’কে দুর্বল করে। নগর-রাষ্ট্র হিসেবে, এই ক্ষয় আরও দ্রুত ঘটে, কারণ ইসরায়েলের সমাজ ও অর্থনীতি তেল আবিবের মতো কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভরশীল। ইরান যুদ্ধ এই দুর্বলতাকে প্রকটভাবে প্রকাশ করেছে, যেখানে নগর কেন্দ্রগুলি সরাসরি আক্রান্ত যেখানকার জনগণ ভীতু এবং আরামের সীমানা থেকে বের হতে চায় না।
পল কেনেডির দৃষ্টিকোণ থেকে, ইসরায়েলের গত তিন দশকের আচরণ এবং ইরান যুদ্ধ একটি অতিরিক্ত সামরিক প্রসারণের উদাহরণ। ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ নেতাদের কল্পিত পারমাণবিক হুমকি নির্মূলের প্রচেষ্টা দেশটির অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পদকে চরম চাপে ফেলেছে। প্রযুক্তি-চালিত অর্থনীতি যুদ্ধের ব্যয় এবং নগর কেন্দ্রে হামলার কারণে দেশটি উভয়মুখী ঝুঁকির মুখে। উচ্চ-অর্থোডক্স বা মৌলবাদী জনসংখ্যার বৃদ্ধি এই চাপ বাড়িয়েছে। যাদের প্রায়শই হারেদি বলা হয়, তাদের জীবনধারা এবং বিশ্বাস তোরাহ (ইহুদি ধর্মগ্রন্থ) এবং হালাখা (ইহুদি আইন) দ্বারা গভীরভাবে পরিচালিত হয় যারা অর্থনীতিতে কম অংশগ্রহণ করে। নৈতিকভাবে ফিলিস্তিনি সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্য ক্ষয় করছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে অনীহা, ইরানের শীর্ষ নেতাকে হত্যা করার বিপক্ষে থাকা এবং মার্কিনিরা যারা ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের জন্য বাঙ্কার-বাস্টার বোমা দিতে অস্বীকার করেছে যা ইসরায়েলের কৌশলগত দুর্বলতাকে আরও উন্মোচিত করেছে। কেনেডির তত্ত্বে, এই বাহ্যিক নির্ভরতার ক্ষয় এবং সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইসরাইলকে পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ঐতিহাসিক উদাহরণ এই গল্পকে সমর্থন করে। প্রাচীন এথেন্স পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে অতিরিক্ত প্রসারণের কারণে পড়ে গিয়েছিল, আর মধ্যযুগীয় ভেনিস বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। ইসরাইল, তার ছোট আকার এবং কেন্দ্রীভূত গঠন নিয়ে, এই ধরনের সংকটের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও ইরান যুদ্ধের ফলাফল এখনও অনিশ্চিত, এবং এটি মার্কিন নীতি, ইরানের প্রতিরোধ, এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের উপর নির্ভর করবে। তবে, ইসরায়েলের স্থিতিস্থাপকতা এই অভিশাপকে এড়াতে পারে যদি তারা পরাজয় বরণ করে ও যুদ্ধবাজ নেতাদের বিদায় করে ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
একটি সন্ধিক্ষণের দিকে
ইসরাইল এখন একটি চৌরাস্তা বা ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। ধর্মতাত্ত্বিকরা এই মুহূর্তটিকে ঈশ্বরের সাথে ইসরায়েলের চুক্তির পরীক্ষা হিসেবে দেখবেন, যেখানে এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথ তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ইবন খালদুনের দৃষ্টিকোণে, ইসরায়েলের ‘আসাবিয়া’ বিনষ্ট হয়ে জাতিটিকে একটি জেদি গোঁয়ার আত্মগরিমার সামরিক সেনাছাউনিতে পরিণত করেছে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বেঁচে আছে পরগাছা হিসাবে যেটা একসময় এটিকে অপরাজেয় করেছিল। এটা এখন ক্ষয়ের মুখে, এবং এর নগর-রাষ্ট্রীয় গঠন এই পতনকে ত্বরান্বিত করছে। পল কেনেডি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ইরান যুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার অর্থনৈতিক ও নৈতিক স্থিতিশীলতাকে ছাড়িয়ে গেছে, যা একটি বিপজ্জনক পথের ইঙ্গিত।
ইসরাইর রক্ষা করতে গেলে আমেরিকার পতন
ইসরাইল হয়ত ভেবেছিল আমেরিকার শতভাগ সহায়তা তাদের বিজয়ী করবে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক জটিল। আমেরিকা এই যুদ্ধে জড়ালে চীন রাশিয়া এবং পশ্চিমা জোটের বিপক্ষে যারা আছে তারা ইসরাইলকে ধ্বংস করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাটিগুলো আক্রান্ত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে যে নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে মার্কিন অর্থনীতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে সেটা উচ্ছন্নে যাবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগানোর দায় বর্তমান মার্কিন প্রশাসন নেবে কিনা সেই প্রশ্ন বহু বিশেষজ্ঞ ও সমর বিশ্লেষক তুলেছেন এবং সেটি না বাধলেও মধ্যপ্রাচ্য যে আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে সেটি নিশ্চিত। এর ফল হবে সারা দুনিয়ায় জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বিষয়টা এখন যে ইরান যুদ্ধে আমেরিকা যুক্ত হলে শুধু ইসরাইল নয়, আমেরিকার পতন হবে।
মনোজাগতিক পতনের আমার বিশ্লেষণ
ইসরাইল জাতির অষ্টম দশকের অভিশাপ মনোজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আসলে কি? ইসরাইলের অষ্টম দশকের অভিশাপ কেবল বাহ্যিক নয়; এটি তাদের আত্মার গভীরেও প্রতিষ্ঠিত। একসময় ইসরাইলের সংস্কৃতি ছিল মাটির যেখানে কিবুৎজের মত সামষ্টিক জীবন, কৃষি, এবং জমির সাথে সংযোগ ঘটেছিল। কিবুটজ (Kibbutz) হলো ইসরাইলের একটি সনাতন রীতির বিশেষ ধরনের যৌথ বসতি ও কৃষি খামার। এখানে সাধারণত সকলে মিলেমিশে বসবাস করত, সবাই মিলে কাজ করত এবং তাদের উৎপাদিত সম্পদ সকলে ভাগ করে নিত। কিবুটজ শব্দটি হিব্রু শব্দ "কিবুটজ" থেকে এসেছে, যার অর্থ "সমষ্টি" বা "একত্রীকরণ"। ইসরাইলিদের সারা বিশ্বে অভিবাসী হয়ে ছড়িয়ে পড়া ও ফিরে এসে নগরায়ন এবং প্রযুক্তি নির্ভর শহুরে জীবন এই সংস্কৃতিকে ক্ষয় করেছে।
একই সাথে, ধর্ম অথবা নিও লিবারেল গ্লেবালিজম ইসরায়েলের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। উচ্চ-অর্থোডক্স বা হারেদি সম্প্রদায়, যারা এখন জনসংখ্যার ১২-১৫%, তাদের কঠোর ধর্মীয় জীবনধারা জাতীয় পরিচয়কে নতুন রূপ দিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব, শাস পার্টির মাধ্যমে, সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সীমিত করেছে। এই একক ধর্মীয় পরিচয় ধর্মনিরপেক্ষ ইসরায়েলিদের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, সমাজকে বিভক্ত করছে।
মনোবিদ্যার দিক থেকে ইসরায়েলের সমাজে উচ্চ নার্সিসিজম দেখা যায়। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে তারা "নির্বাচিত" এবং অনন্য, যা ক্রমাগত নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছে এবং এটা তাদেরকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় এই সমষ্টিগত নার্সিসিজম সমাজকে সমালোচনার প্রতি সংবেদনশীল করে, কূটনৈতিক সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ইরান যুদ্ধে বেসামরিক হতাহত এবং ফিলিস্তিনি সংঘাতে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া মানবিক সহানুভূতির অভাব প্রকাশ করে। এই নৈতিক বিচ্ছিন্নতা আন্তর্জাতিক সমর্থন কমিয়েছে এবং সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েছে।
একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গবেষণা হয়েছিল যে ইহুদিরা এমন কেন? একদিকে তারা বিনিময়যোগ্য জ্ঞানে, অর্থাৎ বিজ্ঞানে, গণিতে, অর্থনীতিতে, প্রকৌশলে অন্যদের চেয়ে শতগুন সেরা। অপরদিকে ব্যবসায় অন্যদের চেয়ে শতগুন সেরা অথচ তাদের কেউ পছন্দ করে না। কেউ তাদের প্রতিবেশী হিসাবে মেনে নেয় না, তাদের দ্বারা শাসিত হতে চায় না, তাদের বিশ্বাস করে না। তাদের দেশছাড়া করতে চায়, এটা কেন?
১৯২৬ সালে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এজরা পার্ক প্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন "মার্জিনাল ম্যান" ধারণাটি যেটি দ্বারা দুটি ভিন্ন জাতি বা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিকে বর্ণনা করা হয়। পার্কের মতে “মার্জিনাল ম্যান… এমন একজন যাকে ভাগ্য পরিহাস করছে দুটি সমাজ-সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করতে এবং যেদুটি শুধু ভিন্ন নয় বরং সেগুলো পরস্পরবিরোধী সমাজ-সংস্কৃতি…। মার্জিনাল ম্যানের মন হল সেই জ্বলন্ত ক্রুসিবল যেখানে দুটি ভিন্ন এবং অবাধ্য সংস্কৃতিকে গলিয়ে একিভূত করতে বলা হয় এবং হয় এবং যেগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিশে যায়”। এজরা পার্ক এই দুটি সমাজ-সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করা "মার্জিনাল ম্যান" বলতে বুঝিয়েছেন প্রবাসী বা মাইগ্র্যান্টদের যারা নিজের সংস্কৃতি এবং একটি অসংগত বিরোধী সংস্কৃতিকে একই সাথে ধারণ করে বাস করার চেষ্টা করে। ইহুদিরা ঐতিহাসিকভাবে মাইগ্র্যান্ট।
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের একসময় বলেছিলেন “ইহুদিরা কখনও কোন কিছুতে সন্তুষ্ট বোধ করে না”। অষ্টম দশকের অভিশাপ সেই অসন্তুষ্টির ঐশ্বরিক প্রতিশোধ।