যখন কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা হয় বা কোন দেশ নিকটবর্তী কোন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন কখনও বিষয়টাকে অতি গোপনীয় রাখা হয় আবার কখনও আগে থেকেই জোর হুমকি প্রোপাগান্ডা চলতে থাকে। গোপনীয়তার বিষয়টি নির্ভর করে কৌশলগত সুবিধা আদায়ের উপর। কিন্তু যখন কোন দেশ অন্য দেশের সাথে একটি গোপন সংযুক্তি বা কোন কোয়ালিশনের স্বার্থে একটি গোপন যুদ্ধ সহায়তা বা ছায়া যুদ্ধ বা প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন সেটা গোপনেই হয় যা দেশের জনগণ বা গণমাধ্যম জানতে পারে না। তবে আমরা যারা ভূ-রাজনীতি বা নিরাপত্তা বিশ্লেষণ বা গবেষণা করি, আমরা একটি বিষয়ে লক্ষ্য করি যে সংযুক্ত বিষয়টি নিয়ে নানা মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে কিনা। এটাকে বলা হয় চ্যাটারিং। যেমন কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠি কোথাও কোন গোপন সন্ত্রাসী হামলা চালালে তার আগে তারা কিছুই ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের আলাপ আলোচনা লক্ষ্য করলে ওই ঘটনা ঘটাবার আগে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই চ্যাটারিং এর সাথে মিলিয়ে উক্ত এলাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় লক্ষ্য করলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আঁচ করতে পারেন যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবিত পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) কে মানবিক বা নরম (অ-মারাত্মক) যুদ্ধ সহায়তা প্রদান করবে, এটি সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির জন্য রসদ সরবরাহ, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার, এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ড্রোন স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে মিয়ানমারের বন্দরগুলোর উপর নজরদারি করার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা ও জাতিসংঘকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ হতে মিয়ানমারের রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের কুটকৌশল নিয়েও প্রস্তাব এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে এই করিডোর স্থাপনের প্রস্তাবের মাধ্যমে উক্ত নরম যুদ্ধ সহায়তার একটি মানবিক আবরণ ও জাতিসংঘকরণ করা সম্ভব হবে। যদিও এই সহায়তাগুলো আপাতদৃষ্টিতে অসামরিক প্রকৃতির বলে মনে হতে পারে, তবে এগুলোর অপব্যবহারের সম্ভাবনা এবং এর ফলে বাংলাদেশের একটি জটিল ও বিপজ্জনক "ডার্টি ওয়ার"-এ জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি প্রবল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ২০০৯ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং আরাকান জনগণের অধিকারের জন্য মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে জান্তা বিরোধী অভ্যন্তরীণ সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে আরাকান আর্মি রাখাইনে বেশীরভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার জান্তার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করার কৌশল হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সত্যিই এমন একটি প্রস্তাব দিয়ে থাকে - যার আওতায় মিয়ানমারের আরাকান আর্মিকে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে হয়, যেমন: তাদের জন্য রসদ পরিবহন, সীমান্ত ব্যবহার, কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ড্রোন পরিচালনা করে মিয়ানমারের বন্দর ও সামরিক স্থাপনার ওপর নজরদারি চালানো—তাহলে সেটি শুধু একটি অসামরিক সহায়তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতির পরিভাষায় একটি "লজিস্টিক এনএবলিং অ্যাক্ট" বা "ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার" ভূমিকা হিসেবে গণ্য হবে। এই ধরনের সহায়তা নিরপেক্ষতার ভান ধরে রাখলেও, প্রকৃত বাস্তবতায় বাংলাদেশকে একটি হাইব্রিড ও প্রক্সি যুদ্ধের সক্রিয় পক্ষ বানিয়ে তুলবে।
উল্লেখ্য যে মিয়ানমারের রাখাইনে কিয়াকফিউ সমুদ্র বন্দর ও সেই বন্দর থেকে চিনের কুনমিং পর্যন্ত চীন সরকারের জ্বালানি পাইপলাইন রয়েছে, রয়েছে একটি নৌবাহিনী ঘাটি এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর সাথে রাখাইনে রয়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত সিটউই সমুদ্র বন্দর এবং তার সাথে যুক্ত ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড বহুমুখী সংযোগ। চীন ও ভারতের এই কৌশলগত অবকাঠামো এখনও মিয়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে আছে তবে যে কোন সময় সেগুলো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে চীন ও ভারত মিয়ানমারের জান্তা ও আরাকান আর্মি উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। ওদিকে চীনের জন্য কিয়াকফিউ সমুদ্র বন্দর ও কুনমিং পর্যন্ত জ্বালানি পাইপলাইন অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নিরাপত্তার অংশ। যেটি রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানীর মালাক্কা প্রণালী পথের একটি বিপদকালীন বিকল্প। চীন কোনভাবেই এই বিকল্প হাাতে চায় না আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সামরিক উৎসাহের প্রধান কারণ এই কিয়াকফিউ সমুদ্র বন্দর হয়ে চীনে জ্বালানি সরবরাহ ধ্বংস করা। বাংলাদেশে ২০২৪ এর সরকার পরিবর্তনের মার্কিন উৎসাহের প্রধান কারণ এটা।
যদিও জাতিসংঘের মাধ্যমে এই করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব, যার সাথে মানবিক আবরণে মার্কিন নরম যুদ্ধ সহায়তার প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে নিরিহ প্রকৃতির বলে মনে হতে পারে, তবে এগুলো বাংলাদেশকে একটি জটিল ও বিপজ্জনক "স্টিকি ডার্টি ওয়ার" এর সাথে জড়িয়ে ফেলবে এবং যেখান থেকে বের হওয়া কঠিন হবে।
প্রথমত, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা (তাতামদাও বা সিট-ট্যাট) ইতিমধ্যেই সন্দেহ করছে যে আরাকান আর্মি বাইরের শক্তির সহায়তায় শক্তি সঞ্চয় করছে। অতীতে চীন, ভারত, এমনকি আরব উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা মধ্যস্থতা প্রক্রিয়াগুলোকেও তাতামদাও অবিশ্বাস করেছে। এ প্রেক্ষাপটে যদি তারা বুঝতে পারে যে বাংলাদেশ ভূখণ্ড আরাকান আর্মির সহায়তার জন্য সরকারীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা যে কারণেই হোক না কেন, তাহলে বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত সংঘাত, বিমান ও ড্রোন আক্রমণ, অথবা শরণার্থী ঠেলে দেওয়া নতুন মাত্রায় প্রবেশ করবে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের ওপর হামলা বা সেনা ক্যাম্প লক্ষ্য করে 'পাল্টা প্রতিক্রিয়া' আসতেই পারে, যেটা সংঘর্ষের একতরফা চিত্রকে বদলে দিয়ে বাস্তব যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে।
দ্বিতীয়ত, এই সহায়তা প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে "দ্বৈত সুযোগে" অপব্যবহারের দরজা খুলে দেবে। আধুনিক ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারে অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন ড্রোন ব্যবহার, সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স, স্যাটেলাইট লিঙ্ক ও ইলেকট্রনিক লিসনিং প্রযুক্তির যুক্তরাষ্ট্রের লোকাল হাবের ওপর নির্ভরতা মানে হলো বাংলাদেশে একটি ছায়া সামরিক অবকাঠামো গড়ে তোলা। একবার এই অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেলে তা শুধুমাত্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এর মাধ্যমে সিআইএ বা অন্য পশ্চিমা এজেন্সিগুলো বাংলাদেশ সরকারের বাইপাস করে আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে, বিশেষ করে চীন বা ভারতবিরোধী কার্যক্রমে। এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর হুমকি।
তৃতীয়ত, আরাকান আর্মির প্রতি সহানুভূতির ভিত্তিতে সহায়তা দিলেও, এই গোষ্ঠীর ভবিষ্যত রাজনীতিক গতিপথ বাংলাদেশ নির্ধারণ করতে পারবে না। ইতিহাসে দেখা গেছে, বহুবার সিআইএ বা বৃটিশ এমআই সিক্স যেসব মিলিশিয়াকে সহায়তা করেছে, যেমন আফগান মুজাহিদিন, কুর্দি পেশমার্গা, বা সিরিয়ার কিছু গ্রুপ, তারা পরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে এবং নিজস্ব অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি বা অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মি, যাদের একাংশ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত, তারা যদি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা দেয় বা বাংলাদেশের ভেতরে দেশী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিলে আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে সেই পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ হবে।
চতুর্থত, এই সহায়তা বিশ্বব্যাপী একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাবে - বাংলাদেশ এখন নিরপেক্ষ নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতি এখন নতুন এক মহাশক্তির সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে—একদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং ইউরোপ। এই বিভাজনে যুক্ত হলে বাংলাদেশ কেবল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হবে না, বরং অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বাইরের শক্তির উপর। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি রাষ্ট্র যখন তার ভূখণ্ড সামরিক তথ্য-প্রযুক্তির বাফার জোনে পরিণত করে, তখন সে এক ধরনের 'প্যাসিভ যুদ্ধক্ষেত্র' হয়ে ওঠে—যার পরিণতি নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয় না।
সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে অসামরিক সহায়তা মনে হলেও, এই ধরনের প্রস্তাব আসলে একটি ধূসর যুদ্ধের দরজা খুলে দেয়, যেখানে সরাসরি গুলি বিনিময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় দায়িত্ব, প্রতিক্রিয়া এবং কৌশলগত জটিলতা। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তারা জানবেই না তাদের ভাগ্য নিয়ে কারা খেলছে এবং কি কারণে খেলছে। বাংলাদেশের জন্য এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া মানে হলো, স্বল্পমেয়াদী কূটনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নিজেদের ঠেলে দেওয়া। এটা কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ভূরাজনৈতিক অবস্থানের চিহ্ন নয়, বরং এক ধরনের প্ররোচনাজনিত ফাঁদ।
যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব অনুসারে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত হয়, যেমন রসদ সরবরাহ, সীমান্ত রুট ব্যবস্থাপনা, ড্রোন নজরদারি পরিচালনা—তাহলে এটি কেবল মিয়ানমার-ভিত্তিক সংঘাতকে নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে একধরনের বিপজ্জনক ডমিনো প্রক্রিয়ায় ঠেলে দিতে পারে। এই ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপ আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এক ধরনের বিভাজন, সংঘাত এবং শেষপর্যন্ত কৌশলগত জোট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি করবে, যার শিকার হবে বাংলাদেশ নিজেই।
প্রথমত, রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র দল ও মিয়ানমারের অন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, (TNLA), কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (KIA), কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (KNU), শান স্টেট আর্মি (SSA) প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্ক জটিল। অনেকক্ষেত্রে তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণ, মাদক চালানের পথ বা বিদেশি সহায়তা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। যদি বাংলাদেশের সহায়তায় আরাকান আর্মি একতরফাভাবে সামরিক সুবিধা পায়, তাহলে এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের সংঘাত বাড়তে পারে বা তারা সেই সুযোগ নিতে পারে। যা অনিবার্যভাবে অস্ত্র, লোক, ও চোরাচালানপথে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের দিকেও। একইসঙ্গে, এই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলো চীন বা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহায়তায় আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ ও হামলা চালাতে পারে। বাংলাদেশ সেই সংঘর্ষের চক্রে আটকা পড়বে, যেখানে আরাকান আর্মিকে সহায়তা দিচ্ছে বলে প্রতিশোধমূলক হামলার টার্গেটে পরিণত হবে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহু সশস্ত্র দল, যেমন NSCN (IM), ULFA, PLA ইত্যাদি বহু দশক ধরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পার্বত্য সীমান্ত ব্যবহার করে আশ্রয়, অস্ত্রপাচার, এবং প্রশিক্ষণ চালিয়ে আসছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগত পদক্ষেপকে একদিকে হুমকি এবং অন্যদিকে সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। একদিকে তারা হয়তো আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়াবে যদি তাদের সীমান্ত অঞ্চল হুমকির মধ্যে পড়ে, অন্যদিকে তারা চীন বা মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্ররোচনায় বাংলাদেশ বিরোধী অপারেশনে অংশ নিতে পারে—বিশেষত যদি তারা বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের “লেজ” হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্ত্রধারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দল যেমন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (UPDF) বা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (PCJSS) এর মত সংগঠনগুলো এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন চুক্তি ও জোটে প্রবেশ করতে পারে। যদি সেনাবাহিনী কক্সবাজার ও বান্দরবানের অংশে মিয়ানমারগামী সরবরাহ এবং নজরদারি অভিযানে নিয়োজিত থাকে, তাহলে এই বাহিনীর অনুপস্থিতি বা সরাসরি শত্রু ভাবনার সুযোগ নিয়ে এই দলগুলো আবার নিজেদের শক্তি সঞ্চয়, নাশকতা বা চাঁদাবাজি বাড়িয়ে দিতে পারে। চীন বা মিয়ানমার এই পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলোর কিছু অংশকে অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে চাইবে, যাতে আরাকান আর্মির সহায়তা ব্যাহত হয়। এটি একধরনের “পাল্টা প্রক্সি” যুদ্ধ—যেখানে একপক্ষের সহায়তার জবাবে অন্যপক্ষ স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদদ দেয়।
চতুর্থত, এই পরিস্থিতি একটি বহুপাক্ষিক সংঘর্ষের জট তৈরি করতে পারে। একদিকে থাকবে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মধ্যে “সহযোগিতামূলক সম্পর্ক”, অন্যদিকে থাকবে চীন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ভারতের উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহীরা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য জোট। এটি একটি জটিল ছায়াযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করবে যেখানে কেউ সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করবে না, কিন্তু বাংলাদেশ হয়ে উঠবে চোরাগোপ্তা যুদ্ধ, নাশকতা, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং সীমান্ত উত্তেজনার স্থায়ী এলাকা।
পঞ্চমত, মিয়ানমার এর মধ্যেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যেখানে একটি গৃহযুদ্ধ চলমান। মিয়ানমার জুড়ে রয়েছে অস্ত্র কারখানা এবং সেগুলো একের পর এক বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে চলে যাচ্ছে। অস্ত্র নির্মাণ, চোরাচালান ও ভগ্ন পুনর্বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অস্ত্র শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাই নয়, বরং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ চীন সীমান্ত অঞ্চলেও বিদ্রোহকে জিইয়ে রাখছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যেমন সাবেকে শান্তিবাহিনী বা ভারতীয় ULFA গোষ্ঠী অতীতে এসব অস্ত্রের ক্রেতা ছিল। এমনকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও এ ধরনের অস্ত্রের চিহ্ন মিলেছে, যা পরোক্ষভাবে মিয়ানমার উৎপাদিত।
এই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের অস্ত্র কারখানাগুলো শুধু একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা শিল্প নয়, বরং আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার ধারাবাহিক উৎসে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির মাধ্যমে এই অস্ত্র উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার চক্রে আটকে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সাথে কোন সক্রিয় সংযোগ একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত কারণ সহসা মিয়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামো সুশৃঙ্খল হবার কোন নিশানা দেখা যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সরাসরি যুক্ত হলে তারা কেবল সামরিক বাহিনী নয়, বরং একটি কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। এতে সেনাবাহিনীর প্রতি দেশের ভেতর-বাইরের আস্থা দুর্বল হবে, এবং সন্ত্রাস মোকাবিলার পরিবর্তে সেনা সম্পদ ও মনোযোগ ভাগ হয়ে যাবে এক অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক সংঘাতের দিকে, যেটা জাতীয় নিরাপত্তার চূড়ান্ত হুমকি তৈরি করবে। এই বিপজ্জনক “পাল্টা প্রক্সি প্রতিক্রিয়া” (কাউন্টার প্রক্সি রিটালিয়েশন) এড়াতে হলে, বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতা, নীতিগত নিরপেক্ষতা এবং আঞ্চলিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে- নয়তো বাংলাদেশ নিজেই হয়ে উঠবে এই যুদ্ধের শিকার।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সহযোগিতা, বিশেষ করে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা স্থানীয় বাহিনীকে সমর্থন প্রদান, অনেক ক্ষেত্রে দেশ বা অঞ্চলকে জটিল, দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এবং অশান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ধরনের সহযোগিতা প্রায়শই অস্ত্র সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য, এবং লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে শুরু করা হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ বা অ-মারাত্মক হলেও, পরবর্তীতে সিআইএ এর নানা অপকর্মে সেগুলো দীর্ঘমেয়াদে "ডার্টি ওয়ার" বা অপ্রচলিত সংঘাতে রূপ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আড়ালে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে, যেমন সিরিয়ায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (FSA) এবং পরবর্তীতে সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (SDF) ও কুর্দি মিলিশিয়া YPG–কে। এসব গোষ্ঠীকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ সরবরাহ করার ফলে, একদিকে আইএস (ISIS) দুর্বল হয়, কিন্তু অন্যদিকে সিরিয়ার ভেতরে বহুগোষ্ঠীর যুদ্ধ শুরু হয়, যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া-সমর্থিত আসাদ সরকার, তুরস্ক, কুর্দি গোষ্ঠী, এবং ইরানপন্থী মিলিশিয়া। সিরিয়া এখনো একটি ছিন্নভিন্ন রাষ্ট্র, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের "পরোক্ষ সহায়তা" কার্যত এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের উৎস হয়েছে।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ইউরোমেইদান আন্দোলনে রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়, যা ইয়ানুকোভিচ সরকারের পতন এবং রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের দিকে নিয়ে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীগুলোকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও তথ্য সহায়তা দিতে থাকে। এর ফলে ইউক্রেন একদিক দিয়ে পশ্চিমপন্থী শক্তি অর্জন করলেও, অন্যদিকে রুশপন্থী বিদ্রোহ, গণহত্যা, ক্রিমিয়া যুদ্ধ, এবং অবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে প্রবেশ করে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, ইউরোপে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট তৈরি হয়, এবং বিশ্বে নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে সরাসরি না গিয়েও “সহযোগিতা” বা “অসামরিক সহায়তা” দেয়, সেসব অঞ্চলে দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো, বহুগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, বিদেশি প্রতিযোগিতা এবং গোপন প্রক্সি যুদ্ধের কারণে অব্যাহত অশান্তি ও জটিলতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের মতো একটি ভৌগোলিকভাবে সংবেদনশীল, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র দ্বন্দ্বের ইতিহাসসম্পন্ন দেশ যদি এই পথে পা বাড়ায়, তাহলে কৌশলগতভাবে তা আত্মঘাতী হতে পারে। ভবিষ্যৎ আফগানিস্তান, সিরিয়া বা লিবিয়ার মতো না হতে চাইলে, আমাদের নিরপেক্ষতা, কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং নিজস্ব সার্বভৌম অবস্থান বজায় রাখা জরুরি।