উহান ল্যাব, মার্কিন অর্থায়ন, এবং বাংলাদেশে জাকার্তা মেথড

কোভিড-১৯ ও বিডিআর বিদ্রোহ: সত্যের সন্ধানে ন্যারেটিভের রাজনীতি

৭০ লক্ষ লোক মারা গেছে সারা দুনিয়ায় করোনাভাইরাসে যে সংখ্যা এক কোটি হবে যদি অনিবন্ধিতদের হিসাবে নেওয়া হয়। এই এককোটি লোকের মৃত্যু এবং তার সাথে যে বিশ্ব অর্থনীতি ও সামাজিক বিপর্যয় সেটাকে হিসাবে নিলে মৃত্যু ও ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরো কয়েকগুন বেশী হবে। এই করোনাভাইরাস কি প্রকৃতি থেকে এসেছিল? নাকি ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছিল? এই বিতর্ক শুরু থেকেই। এই বিতর্কে যখন তুঙ্গে এবং সারা দুনিয়ার ভাইরোলজির বিশেষজ্ঞরা পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিতে ব্যস্ত তখনই আমরা শুনলাম চীনের উহানের একটি ওয়েট মার্কেট বা কাঁচা বাজার থেকে এটি ছড়িয়েছে। তার পর খবর এল চীনের উহানের একটি বায়োল্যাব বা জীবাণু পরীক্ষাগারে নাকি এটি তৈরি করা হয়েছে। এর পর সারা দুনিয়ার প্রধান মিডিয়াগুলোর সে কি তুমুল চীন বিরোধী প্রোপাগান্ডা।

আমরা যা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারা একরৈখিক চিন্তা করি না। কোন ঘটনায় 'ক' পক্ষ যদি একটি বিবরণ দেয় সেটা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি, একই ঘটনায় 'খ' পক্ষ ভিন্ন একটি বিবরণ দিলে সেটিও আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি, একই ঘটনায় 'গ' পক্ষ ভিন্ন একটি বিবরণ দিলে সেটিও আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। এর সাথে আমরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। এর পর প্রতিটি পক্ষের বিবরণ বা ন্যারেটিভগুলোর নিজস্ব স্ট্রাকচার বা মডেল তৈরি করি। এর পর দেখি সেই মডেলগুলোতে উদ্ভট বা অসম্ভব কিছু আছে কিনা। কোন ঘটনার ন্যারেটিভ বা বিবরণে অনেক বড় বড় ফাঁক থাকতে পারে বা অনিশ্চয়তা থাকতে পারে কিন্তু উদ্ভট কিছু থাকবে না। উদ্ভট কিছু থাকলে সেই ন্যারেটিভ গ্রহণযোগ্য নয়।

চীনের উহানের ওয়েট মার্কেট বা জীবাণু পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাস তৈরী হয়েছে এই দাবীটি যারা করছে তাদের বক্তব্য যেন মনে হচ্ছিল শুধুই রাজনৈতিক। এতে যেন কোন সায়েন্টিফিক মেরিট নেই। যখন সারা দুনিয়া থেকে জোর দাবী উঠল যে বিষয়টির বৈজ্ঞানিক তদন্ত হওয়া খুব দরকার। তখনই যেন পর ধপ করেই সেই দাবী স্তিমিত হয়ে গেল।

চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের মাধ্যমে ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স নামক একটি মার্কিন এনজিও উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি-কে অর্থায়ন করেছে। এই অর্থায়ন মূলত করোনাভাইরাসের উপর গবেষণার জন্য প্রদান করা হয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, ইউএসএআইডি ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সকে ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে, যা উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির সাথে একটি সাব এওয়ার্ডের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। এই অর্থায়ন মূলত মানব ও প্রাণী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন ভাইরাসের উপর গবেষণার জন্য প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়া, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির গবেষক শি ঝেং লি তার রেজুমিতে উল্লেখ করেছেন যে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তিনি ইউএসএআইডি থেকে ৫৫৯,৫০০ মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এর মাধ্যমে ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের অর্থায়ন ছাড়াও, ইউএসএআইডি এর মাধ্যমে সরাসরি চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিকে অর্থায়নের প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আর একটি বিষয় লক্ষ্য করে সেটি হল ন্যারেটিভের রাজনীতি। যে কোন পক্ষ কোন বিষয়ে কোন ন্যারেটিভটা হাজির করছে। তাদের মোটিভ কি? এখন নতুন সব মার্কিন সরকারী তথ্য ফাঁস হবার পর দেখা যাচ্ছে যে আসলে আমেরিকার সরকারের ভেতরের ছোট একটি দল শুধু জানত যে চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে বিপজ্জনক করোনাভাইরাস দিয়ে গবেষণা হচ্ছে। সেই তথ্যকে রাজনৈতিক সুবিধা ও চীনের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় কাজে লাগায় তারা। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে জোর তদন্তের দাবী উঠলে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া হয়। শুধু ধামাচাপা দেওয়া হয় তাই না, করোনাভাইরাস যে প্রকৃতি থেকে এসেছে সেটি নিয়ে একটি হাই ভ্যাল্যু বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র ছাপা হয় বিখ্যাত নেচার জার্নালে। এখন দেখা যাচ্ছে যারা এই গবেষণাপত্র ছাপিয়েছে তারা ওই ছোট দলটিরই লোকজন। যার অর্থ হল রাজনৈতিক সুবিধা নিতে তারা নিজেদের অপকর্মকেই অন্যের করা অপকর্ম বলে প্রচার করছিল। সঠিক তদন্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়া মাত্রই তারা নেচার জার্নালে গবেষণাপত্র ছাপিয়ে তদন্তের কফিনে পেরেক মেরে দেয়।
  
ঠিক একই প্যাটার্নে বাংলাদেশে ঘটা বিডিআর বিদ্রোহ যে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে একটি বৃহৎ এবং জঘন্য গৃহযুদ্ধ লাগানোর চক্রান্ত ছিল সেটা বর্তমানে সরকারে যারা আছে তারা জানে। এটা তারাও জানে যারা এই সরকারের অংশীদার একটা ক্ষমতাশালী এজেন্সীকে হেয় করতে চাইছে যারা সেই চক্রান্ত তৈরি করেছিল। বিষয়টা এমন যে আপনি যদি কাউকে খুন করার জন্য ভাড়া করেন। খুনটা করার পর সেই ব্যক্তি কিন্তু আপনার কাছে জিম্মি। কারণ সে যত দক্ষতার সাথেই সকল চিহ্ন কারণ প্রমাণ না রেখে কাজ করুক না কেন আপনি জানেন কাজটা কে করেছে। অপরদিকে সেও জানে যে আপনি কাজটা করিয়েছেন। এখন এই খুনের জন্য যদি কাউকে ফাঁসাতে হয় তাহলে আপনি সেটা সবচেয়ে দক্ষভাবে পারবেন। কারণ আপনি প্রকৃত খুনিকে চেনেন। আবার আপনি এটাও চাইবেন না যে প্রকৃত তদন্ত হোক। কারণ প্রকৃত তদন্ত হয়ে আপনি সহ ফেঁসে যাবেন।  

৭০ লক্ষ লোক মারা যাওয়া কোভিড সংক্রমণ বা বাংলাদেশে জাকার্তা মেথড প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার জন্য যে বিডিআর বিদ্রোহ পরিকল্পনা এগুলো সবই কিন্তু একই মার্কিন ডিপ স্টেট এবং সরোস-বাইডেন-ক্লিনটন গোষ্ঠির কাজ যাদের কাছে নেচার জার্নালও প্রোপাগান্ডার অস্ত্র। এখন প্রমাণ হচ্ছে শুধু চীনের উহান ল্যাব নয়, ইউক্রেনও আছে মার্কিন অর্থায়নে জীবাণু অস্ত্র তৈরির ল্যাব। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। করোনাভাইরাসে জীবাণু পরীক্ষাগারে তৈরি কিনা বা বিডিআর বিদ্রোহ যে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে একটি বৃহৎ এবং জঘন্য গৃহযুদ্ধ লাগানোর চক্রান্ত ছিল কিনা এগুলো দ্রুতই পরিষ্কার হবে। প্রমাণ হবে মানবতার শত্রু তারাই যারা নিজের করা দোষে অন্যকে দোষারোপে খুবই পারদর্শী।