যারা বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত আছেন তারা ভবিষ্যতে একসময় নিজেদের দিকে তাকালে নিজেদের নর্দমায় বাস করা হেয় নগন্য নোংরা কীটের মত মনে হবে। মদ্যপান করে বা তসবি পড়ে মনকে অতীত গ্লানী থেকে দুরে রাখতে পারলেও পরের প্রজন্ম থেকে কিন্তু মুক্তি মিলবে না, তারা সেটাই ভাববে। একটি দেশ, যে দেশে কোটি কোটি শিশু বাস করে, তাদের জন্য এই দেশটিকে নিরাপদ রাখা বয়ষ্কদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেটাতে অবহেলা করে বা সেটাতে গুরুত্ব না দিয়ে যে যাই করেন না কেন, সেটা ঐ ভবিষ্যত চিত্র বদলাবে না।
বাংলাদেশে এখন যা চলছে তেমনই চলছিল অ্যাপারথাইড পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় যা ছিল সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি গোপন গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতিতে সাংবাদিকেরা কি করবেন? তারা মানুষ হলে কি করবেন আর তারা অমানুষ হলে কি করবেন? সেটাই লিখেছেন গ্রেগ মারিনোভিচ এবং জোয়াও সিলভার তাদের "দ্য ব্যাং-ব্যাং ক্লাব: একটি লুকানো যুদ্ধের কিছু ছবি" বইতে। সেই বই নির্ভর করে নির্মিত হয়েছে "দ্য ব্যাং ব্যাং ক্লাব" সিনেমাটি ২০১০ সালে।
সিনেমাটি চারজন দক্ষিণ আফ্রিকান ফটোগ্রাফারের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে, যারা ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামকে কাভার করেছিলেন। এই চারজন সাংবাদিক হলেন:
গ্রেগ মারিনোভিচ, জোয়াও সিলভা, কেভিন কার্টার এবং কেন ওস্টারব্রুক। তারা অ্যাপারথাইড পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ছবি তুলতেন, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বেশ আলোড়ন তুলে প্রচারিত হত।
সেই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সত্য ও মিডিয়ার চাহিদা নিয়ে সাংবাদিকদের কঠিন সিদ্ধান্ত এবং তাদের কাজের নৈতিকতা। তারা কেবল সেখানকার সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের বিচ্ছিন্ন নথিভুক্তকারী ছিলেন না, বরং সরাসরি তারা এই সংঘর্ষের ভেতরেই বসবাস করতেন। তবুও তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়া ভয়াবহ সহিংসতা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার করা হলেও সেখানে আসল সত্যের মাত্র অংশবিশেষই দেখানো হতো।
সিনেমাটি দেখায় কিভাবে পশ্চিমা মিডিয়া রাজনৈতিক ও বর্ণবাদী সহিংসতার চিত্র ব্যবহার করে তাদের নিজেদের চীরায়ত উদ্দেশ্য হাসিল করে, কিন্তু সেই অঞ্চলের প্রকৃত দ্বন্দ্ব ও বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করে না।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভণ্ডামি যেটি সিনেমায় উঠে এসেছে মিডিয়ার একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ও সেন্সরশিপ। পশ্চিমা মিডিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার সংঘাতকে শুধুমাত্র "শ্বেতাঙ্গ বনাম কৃষ্ণাঙ্গ" লড়াই হিসেবে তুলে ধরেছিল, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে এএনসি বা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রসে ও আইএফপি বা ইনকাথা ফ্রিডম পার্টির অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে।
এএনসি দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং আইএফপি দক্ষিণ আফ্রিকার একটি রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল। এএনসি অনেকটাই একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল যেটা আসলে পশ্চিমা চিন্তাধারারই বাহক। সাদাদের তাড়িয়ে একই ক্ষমতা তারা উপভোগ করতে চায়। ১৯৯৪ সালে বর্ণবাদ বিলুপ্তির পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রেখেছে এএনসি। বর্ণবাদ চালু করেছিল যে ন্যাশনাল পার্টি, সেটার পুনর্গঠিত সংগঠন নিউ ন্যাশনাল পার্টি ২০০৫ সালের এপ্রিলে এএনসি’র সাথে একীভূত হয়ে যায়। যার অর্থ শাসক একই কেবল রং নতুন।
সিনেমাটিতে দেখা যায়, কেভিন কার্টার ও গ্রেগ মারিনোভিচ যখন এএনসি-আইএফপি এর সহিংসতা কভার করছিলেন, তখন তারা দেখেন যে এটি শুধুমাত্র বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া এটিকে শুধুই শ্বেতাঙ্গ নিপীড়নের গল্প হিসেবে প্রচার করেছিল। এএনসি-আইএফপি সংঘাতটি ছিল মৌলিক, যেটা জাতীয়তাবাদ ও গ্রোবাল ডিপস্টেটের লড়াই। যে লড়াইতে বর্ণবাদ হেরে গেছে কিন্তু লিবারেল পশ্চিমা শক্তি জিতেছে আর হেরেছে আফ্রিকান জাতিয়তাবাদ ও সংস্কৃতি।
এই সিনেমায় দেখানো সেই কেভিন কার্টার বিশ্ববিখ্যাত "শকুন এবং নারী শিশু" ছবিটি তোলার জন্য ১৯৯৩ সাল পুলিৎজার পুরস্কার পান। ছবিটিতে দেখা যায়, একটি অনাহারী সুদানি শিশু মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে, আর পাশে একটি শকুন বসে অপেক্ষা করছে। এই ছবি নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
তবে, মিডিয়া কেভিন কার্টারের ছবিটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছিল। শকুনটি মেয়েটিকে খাবার জন্য সেখানে আসেনি। বিমানবন্দরের খোলা যায়গায় শকুনগুলে থাকত। ত্রাণ বিতরণের ভীড়ে বহু মানুষ সেখানে ছুটে এসেছিল এবং শিশুটির সাথে যে ছিল সে অল্প সময়ের জন্য তাকে ফেলে ত্রান নিতে যায়। তখনই কেভীন ছবিটি তোলে ফ্রেমে শকুনটিকে নিয়ে। পুরো বিষয়টি মিডিয়া ভ্রান্তভাবে তুলে ধরেছিল যেটা কেভিনের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠেছিল কেভিন ক্যামেরা ফেলে শকুনটাকে তাড়য়নি কেন? যদিও বাস্তবে শকুনটি মেয়েটির জন্য মোটেও হুমকি ছিল না। আবার হুমকি না থাকলে সে এই ছবি তুলল কেন বা দুনিয়াব্যপি প্রচার হল কেন? গণমাধ্যমের আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে এবং তার নিজের মানসিক চাপে কেভিন কার্টার দুঃখজনকভাবে আত্মহত্যা করে ১৯৯৪ সালে।
সিনেমাটির একটি দৃশ্যে, একজন ফটোগ্রাফার বলেন, "তারা (পশ্চিমা মিডিয়া) আমাদের ছবি নিয়ে ব্যবসা করছে, কিন্তু আমাদের বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করছে না।" মিডিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার সংকটকে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের বানানো গল্পের রসদ হিসেবে দেখেছে, কিন্তু প্রকৃত সংঘাত ও তার গল্প ছিল ভিন্ন। এবং সেটার বিষয়ে তাদের কোন নীতিগত অবস্থান ছিল না এবং সহিংসতা রোধে তারা তেমন কোনো ভূমিকা নেয়নি।
"দ্য ব্যাং ব্যাং ক্লাব" পশ্চিমা মিডিয়ার সীমাবদ্ধতা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ আচরণ প্রকটভাবে তুলে ধরে। সেখানে পরিষ্কার হয় যে পশ্চিমা মিডিয়া সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়কে নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বা ব্যবসায়িক সহায় বানায়, কিন্তু সেই দেশগুলোর সত্যিকার অবস্থা বা সমাধান নিয়ে কোন আগ্রহ দেখায় না। একপেশে বর্ণনা দিয়ে সংঘাতকে জটিলতার পরিবর্তে সরলীকরণ করা হয়, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াইকে শুধুই বর্ণবাদের গল্পে পরিণত করা।
এখন বাংলাদেশের স্থানীয় মিডিয়াকে আমরা দেখছি তারা পশ্চিমা মিডিয়ার ভন্ড চরিত্র পুরোটাই ধারণ করে বসে আছে অথচ তাদের কোন ডিপ স্টেট নাই।