প্রিন্সেস ডায়ানার মানসিক সমস্যা

জনপ্রিয় ও বিখ্যাতদের ভক্ত অনেক কিন্তু তারা অনেকেই সুস্থ নয়

এই ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। বামের ছবিটির চোখের দিকে তাকান। মনে হবে এক বিপন্ন ও করুণ চাহনি যেন কোন শিশু কোন অপরাধ করে ফেলেছে এবং সে আপনার যে কোন কথা মেনে আপনার আজ্ঞা পালনে রাজি যে শিশু সুলভ মিষ্টি, খুবই সহানুভূতিপ্রবণ ও সহযোগী যাদের বলা হয় এগ্রিয়েবল। এবার ডানের ছবিটির দিকে তাকান। যেটি একটি এআই অঙ্কিত ছবি যেটি প্রিন্সেস ডায়ানার শত শত ছবি থেকে ধারণা নিয়ে আঁকা। ছবিটি একটি সুন্দরী নারীর ছবি হলেও সেই ছবিতে একটি রাগী, আবেগপ্রবণ, অত্যন্ত সংবেদনশীল, ক্ষুদ্রতম জিনিসের জন্যও উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এমন একটা চরিত্র ফুটে উঠেছে। এই দুটি চরিত্রের মিশ্রন যে ব্যক্তিত্বে থাকে তারা হয়ে থাকে বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি। ব্যক্তিটি যেন এই দুই মানসিকতার নাগরদোলায় দোলে বা দুই চুড়ান্ত মানসিকতায় রোলারকোস্টারে রাইড করতে থাকে যেটা থাকে তান নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। 

"ডায়ানা ইন সার্চ অফ হারসেল্ফ" হল স্যালি বেডেল স্মিথের লেখা ডায়ানার জীবনী, যেখানে দাবী করা হয়েছে ডায়ানার বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এর কথা। উল্লেখ্য ডায়ানার আত্মহত্যা প্রবণতা, গর্ভবতী থাকাকালীন ইচ্ছা করে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, নিজের দেহ ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কাটা, খাবারে অরুচি বা বুলিমিয়া, মুড সুইং এমন অনেক কিছুর বর্ণনা আছে। 

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (বিপিডি) একটি জটিল ব্যক্তিত্বের ব্যাধি, যা ক্লাস্টার-বি শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব ব্যাধির অন্তর্ভুক্ত। এটি ব্যক্তির কাজকর্ম, সম্পর্ক এবং আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে তীব্র আবেগপ্রবণতা এবং অস্থিরতার দ্বারা চিহ্নিত। সাধারণত, এই ব্যাধি যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ে বা পরিণত বয়সের শুরুতে প্রকাশ পায় এবং বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে প্রকট হয় যায়। বিপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই পরিত্যাগের ভয়, তীব্র রাগ, অস্থির সম্পর্ক, এবং আত্ম-ক্ষতি বা আত্মহত্যার প্রবণতার মতো লক্ষণ প্রদর্শন করেন। এই ব্যাধি তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক বজায় রাখা এবং স্থিতিশীল স্ব-ধারণা গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিপিডি-র নির্ণয়ের জন্য নয়টি প্রধান লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন। কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই লক্ষণগুলির মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদে উপস্থিত থাকলে তাকে বিপিডি-তে আক্রান্ত বলে বিবেচনা করা হয়। নিম্নে এই লক্ষণগুলি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:

১. পরিত্যাগের ভয়:

বিপিডি-র অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো পরিত্যাগ বা একাকীত্বের তীব্র ভয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রিয়জনদের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কায় ক্রমাগত উদ্বিগ্ন থাকেন। এমনকি সাধারণ ঘটনা, যেমন কোনো পরিবারের সদস্যের কর্মক্ষেত্র থেকে দেরিতে ফেরা, তাদের মধ্যে তীব্র আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই ভয় তাদের প্রিয়জনদের কাছাকাছি রাখার জন্য অতিরিক্ত প্রচেষ্টার দিকে পরিচালিত করে, যা প্রায়শই সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং শূন্যতার অনুভূতিকে আরও গভীর করে।

২. অস্থির সম্পর্ক:

বিপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সম্পর্কে দ্রুত তীব্র অনুভূতি গড়ে তুললেও সহজেই হতাশ হয়ে পড়েন। তারা প্রায়শই অন্যদেরকে চরমভাবে ভালো বা খারাপ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেন, মধ্যম পথে কোনো ভারসাম্য থাকে না। এই অস্থিরতার কারণে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে, যা বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কে অস্বাভাবিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

৩. অস্পষ্ট আত্ম-ধারণা:

বিপিডি-র একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো অস্থির ও অস্পষ্ট আত্ম-ধারণা। আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের সম্পর্কে স্থিতিশীল ধারণা বজায় রাখতে অক্ষম। তাদের পছন্দ-অপছন্দ, লক্ষ্য, মূল্যবোধ, এমনকি ধর্মীয় বা যৌন পরিচয়ও ঘন ঘন পরিবর্তিত হতে পারে। এই অস্থিরতা তাদের জীবনে অসঙ্গতি এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।

৪. আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণ:

বিপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ এবং আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণে লিপ্ত হন, যেমন বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত মদ্যপান, মাদক গ্রহণ, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, বা দোকান থেকে চুরি। এই আচরণগুলি তাৎক্ষণিকভাবে স্বস্তি প্রদান করলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সম্পর্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

৫. নিজের ক্ষতি:

আত্ম-ক্ষতি বিপিডি-র একটি সাধারণ লক্ষণ। আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের শরীরে আঘাত করা, যেমন কাটা বা পোড়ানো, এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে পারেন। এই আচরণগুলি তাদের মানসিক যন্ত্রণা প্রকাশের একটি উপায় হিসেবে কাজ করে। আত্ম-ক্ষতি এবং আত্মহত্যার প্রবণতার কারণে তাদের প্রিয়জনদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়।

৬. মেজাজের আকস্মিক ও তীব্র পরিবর্তন:

বিপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তীব্র এবং অস্থায়ী মেজাজের পরিবর্তন (মুড স্যুইং) অনুভব করেন, যা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে। এই পরিবর্তন সুখী মেজাজ থেকে হতাশা বা আত্মহত্যার চিন্তার দিকে দ্রুত স্থানান্তরিত হতে পারে। এমনকি ক্ষুদ্রতম ঘটনাও তাদের মধ্যে তীব্র আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

৭. শূন্যতার দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতি:

বিপিডি-র একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো শূন্যতার দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতি। আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজেদের “কেউ কারও নয়” বলে অনুভব করেন। এই শূন্যতা পূরণের জন্য তারা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে, যেমন মাদক গ্রহণ, অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ, বা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এই অনুভূতি তাদের সম্পর্ক, কাজ এবং আচরণকে প্রভাবিত করে।

৮. বিস্ফোরক রাগ:

বিপিডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামান্য মতবিরোধেও তীব্র রাগ প্রকাশ করতে পারেন, যা চিৎকার, জিনিস ছুঁড়ে ফেলা, বা আক্রমণাত্মক আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই রাগ সর্বদা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ নাও পেতে পারে; কখনও কখনও এটি ভিতরে জমা হয়ে আত্ম-ক্ষতির আকারে প্রকাশিত হয়।

৯. প্যারানয়া বা সন্দেহজনক চিন্তা:

বিপিডি-র রোগীরা প্রায়শই অন্যদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এবং চাপের সময় বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন। এই প্যারানয়া তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে এবং পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বিপিডি জিনগত কারণ এবং পরিবেশগত ট্রমা, যেমন শৈশবের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যক্তিত্ব ব্যাধি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। তবে, এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি।

বিপিডি নির্ণয়ের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করেন:

⦁    রোগীর সাথে বিস্তারিত আলোচনা।
⦁    মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়নের জন্য প্রশ্নাবলী।
⦁    চিকিৎসা ইতিহাস এবং লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে আলোচনা।

চিকিৎসার প্রধান পদ্ধতি হলো সাইকোথেরাপি, যেমন ডায়ালেক্টিকাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT), যা আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পর্ক উন্নতিতে সহায়তা করে। কিছু ক্ষেত্রে, লক্ষণ ব্যবস্থাপনার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে, যেমন আত্ম-ক্ষতি বা আত্মহত্যার প্রবণতা শনাক্ত হলে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।

যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ বিপিডি-র লক্ষণ প্রদর্শন করেন, তবে তা উপেক্ষা না করে দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক চিকিৎসা এবং সহায়তার মাধ্যমে বিপিডি-র লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনমান উন্নত করা যায়।

বিপিডির সাথে নার্সিসিজম অনেক সময়ই একসাথে বিরাজ করে (কোমর্বিডিটি)।