EN
আরও পড়ুন
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -২
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -১
ধর্ম ও দর্শন
শহুরে শিক্ষিত দালালদের শক্তিশালী করার কৌশল
ধর্ম ও দর্শন
JadeWits Technologies Limited

ধনী কর্পোরেট জগতের এনার্কিজম

কর্পোরেট শয়তানবাদ ও সোশিওপ্যাথিক সংস্কৃতি: দ্য ম্যাকাফি কেস

আপনারা কেউ কি স্ক্যাট সেক্সের নাম শুনেছেন? দরিদ্র অসহায় মধ্য আমেরিকান কিশোরী মেয়েদের প্রতি রাতের জন্য প্রচুর টাকা দিয়ে ভাড়া করে তাদের দিয়ে নিজের মুখে মলত্যাগ করিয়ে যৌন আনন্দ পেত সাইবার সিকিউরিটি গুরু আমেরিকান মিলিয়নিয়ার জন ম্যাকাফি যাদের বয়স ১৬-১৭ বছর। আমেরিকার ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লিবারেটারিয়ান দলের প্রার্থী ছিল সে। নির্বাচন ক্যাম্পেইনে জনপ্রিয়তায়ও প্রথম দিকে ছিল সে, হয়েছিল দ্বিতীয়। 
   
স্ক্যাটোফিলিয়া (বা করোফিলিয়া) একটি প্যারাফিলিয়া বা যৌন বিকৃতি যাতে কোন অযৌন বস্তু বা সেগুলো নিয়ে চিন্তা, আচরণ ইত্যাদি যৌন উত্তেজক হিসাবে কাজ করে। শুধু যৌন বিকৃতিতে অসংখ্য দরিদ্র কিশোরীকে ব্যবহারই নয়, মধ্য আমেরিকার বেলিজ রাষ্ট্রে দুজনকে হত্যার সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা সে। কিন্তু অর্থ, ক্যারিশমা, এবং সাইকোপ্যাথিক ম্যানিপুলেশন ব্যবহার করে টেক দুনিয়ার জনপ্রিয় সিকিউরিটি গুরু সে। 

শুধু তাই নয়, খুন ধর্ষনের মত জঘন্যতম সব অপরাধ এবং সাইকোপ্যাথিক আচরণ থাকার পরও, যেগুলোর প্রমাণ হিসাবে খবর, সাক্ষ্য, তথ্যচিত্র ইত্যাদি বিপুল পরিমাণে থাকার পরও সমাজ সেগুলোতে অন্ধ। জন ম্যাকাফি যেন খুনি যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ব্যক্তি সংস্করণ। ভয়ংকর বিষয় হলো আধুনিক সমাজে ধনী, দাপুটে ও ক্যারিশমেটিক ব্যক্তি অথবা রাষ্ট্র যেমন চরিত্রেরই হোক না কেন, যে আচরণই করুক না কেন তারাই হয়ে যায় সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এবং সবাই তাদেরই বন্ধু হতে চায়, তাদের সেবা করতে চায়।

১৯৪৫ সালে বৃটেনে এক আমেরিকান সামরিক বাড়িতে জন্ম ম্যাকাফির যার ছিল বৃটিশ মা ও আমেরিকান মিলিটারি সার্ভেয়র পিতা। তার পিতা ছিল একজন অ্যবিউসিভ অ্যালকোহলিক যে নিজের গুলিতে নিজেই আত্মহত্যা করে ম্যাকাফির বয়স যখন ১৫। আমেরিকায় ভাল ছাত্র ম্যাকাফি গণিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়। সে গণিতে  পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করলেও সেটাতে মাঝামাঝি আসার পর অভিযুক্ত হয় তার এক পিএইচডি আন্ডারগ্র্যাড ছাত্রীর সাথে সাথে যৌন সম্পর্কের অভিযোগে। যার ফলে সে বহিষ্কৃত হয়। 

পরবর্তিতে সে কম্পিউটার প্রকৌশলি হয়। তার কলেজ তাকে অনারারি ডক্টরেট দেয় ২০০৮ সালে যেখানে সে নিয়মিত বক্তৃতা দিত। শিক্ষাজীবন শেষের পর ম্যাকাফি নাসায় কর্ম জীবন শুরু করে। সে চন্দ্র অভিযানে অ্যাপোলো প্রোগ্রামে কাজ করে। এর পর সিলিকন ভ্যালিতে আসে এবং ইউনিভ্যাক ও জেরোক্সে কাজ করে অপারেটিং সিস্টেম আর্কিটেক্ট হিসাবে। পরে সে জেনারেল ইলেকট্রিকে যোগ দেয় ও তারপর অস্ত্র ও বিমান প্রস্তুতকারক লকহিড মার্টিন কর্পোরেশনে যোগ দেয় যারা আমেরিকান মিলিটারির ডিফেন্স কনন্ট্রাকটর।
    
লকহিড মার্টিনে তার কাজ ছিল ভয়েস রিকগনিশন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করা। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে আমজাদ ফারুকি এবং তার ভাই বাসিত ফারুকি নামে দুই পাকিস্তানি পৃথিবীর প্রথম কস্পিউটার ভাইরাস তৈরী করে ‘পাকিস্তানি ব্রেইন’ নামে। ম্যাকাফি এটা পত্রিকা মারফত জানতে পারে এবং প্রথম একটি ছোট সফটওয়্যার লিখে যেটা ছিল পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিভাইরাস। এভাবেই জন্ম হয় ম্যাকাফি অ্যসোসিয়েটসের। 

এর পর বিভিন্ন নামে ভাইরাস বের হতে থাকে ও ম্যাকাফি সেগুলো নিয়ে মিডিয়ায় নানা রকম ভয় ভীতি তৈরী করতে সক্ষম হয়। ফলে দ্রুত মানুষ কিনতে থাকে অ্যন্টিভাইরাস। দ্রুতই ২০ জনের কোম্পানী ১৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলে। পরবর্তিতে ইনভেস্টরেরা ম্যাকাফি অ্যসোসিয়েটসকে পরবর্তি স্তরে বড় কর্পোরেটে রুপান্তরিত করতে চাইলে তারা ভাবে ম্যাকাফি ঠিক উপযুক্ত নয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে তারা ম্যাকাফির সব শেয়ার কিনে নেয়। আরও কয়েক বছর পর ম্যাকাফি অ্যসোসিয়েটসকে প্রচুর টাকায়, প্রায় আট বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় ইনটেল।

এর পর প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার পকেটে নিয়ে ম্যাকাফি অনেকগুলো স্টার্টআপ করার চেষ্টা করে যেমন পাওআও, ট্রাইবাল ভয়েস ইত্যাদি। কিন্তু কোনটাই দাঁড়ায় না। ২০০০ সালে সে ব্যবসা ছেড়ে কোলোরাডোতে গিয়ে ২৮০ একর পাহাড়ি উপত্যকা কিনে একটি ইয়োগা ও মেডিটেশন সেন্টার তৈরি করে। সেখানে সে আমন্ত্রণ জানাতো নারী পুরুষকে থাকতে ও যোগ সাধনা করতে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়। তখন ইয়োগা ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পাঁচটি বই লেখে সে ও একজন ইয়োগা গুরুতে পরিণত হয়। যদিও পরবর্তিতে সে নিজেই বলে ঐ সব বই আসলে ভুয়া। 

ব্যক্তিগত বিমান, কোলোরাডোতে ইয়োগা ও মেডিটেশন সেন্টার, নিউ মেক্সিকোতে এয়ারপোর্ট ও পাইলট ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, হাওয়াইতে বিশাল প্রোপার্টি ও রিসোর্ট এগুলো চালাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়ে সে। সম্মুখিন হয় নানা মামলার। পাইলট ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে একজন নিহত হলে তার জন্যও মামলা হয়। একটি মামলায় সে হেরে যাবার উপক্রম হলে সে সিদ্ধান্ত নেয় যথেষ্ট হয়েছে, আর এদেশে সে থাকবে না। সিদ্ধান্ত নেয় প্রকৃতির মাঝে বাস করার।   

আমেরিকা ত্যাগ করে মধ্য আমেরিকার বেলিজ নামক একটি ছোট্ট সাগর পারের দেশে সে বিচ সহ একটি সম্পত্তি কেনে স্যান পিয়েড্রো দ্বীপে। ক্যারিবিয় সাগরের তীরে মোক্সিকো ও গুয়াতেমালার পাশে মাত্র চার লাখ জনসংখ্যার বেলিজ একটা অতি দরিদ্র দেশ যার প্রশাসন দুর্বল ও দুর্নীতিতে ডোবা। বহু আমেরিকান ধনী ও অপরাধী যারা দেশ পালায় তারা এখানে এসে জায়গা কেনে ও স্বেচ্ছাচারিতায় বসবাস করে টাকার জোরে।

আমেরিকায় প্রায় সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে যখন সে বেলিজে বিচ রিসোর্টে নতুন জীবন শুরু করেছে তখন তারই এক রেস্তোরায় সে দেখা পায় ছুটি কাটাতে আসা অ্যালিসন অ্যাডোনিজিও নামের এক তরুনী সুন্দরী নারী মাইক্রোবায়োলজিস্টের যে কোরাম সেন্সিং নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট গবেষনা করছিল।    

কোরাম সেন্সিং হল ব্যাকটেরিয়াদের ব্যবহৃত একটি নিরাপত্তা পদ্ধতি যাতে নিজেদের পপুলেশন হিসাব করে তারা জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের সংখ্যা অপটিমাম রাখে। তাৎক্ষণিকভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ম্যাকাফি প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভবনের চিন্তা করে। অ্যালিসনকে সে তখনই প্রস্তাব দেয় তার সাথে পার্টনার হয়ে গবেষণা করার। তরুণী অ্যালিসন মনে করে তার জীবনের সোনালী স্বপ্ন সে হাতে পেয়েছে। মধ্য আমেরিকার প্রাকৃতিক বনের গাছপালা নিয়ে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়েটিকের গবেষণার ল্যাবরেটরি যেটা হবে তারই মনমত।    

এর পর ম্যাকাফি বেলিজের অরেঞ্জ ওয়াক জেলায় একটি জায়গা কেনে যেটা মেইনল্যান্ডে একটি প্রাকৃতিক জঙ্গল পরিবেষ্টিত এলাকায় এবং সেখানে সে কোরাম সেন্সিং ল্যাবটি তৈরী করে। অ্যালিসন নিজের পোস্ট গ্র্যাড গবেষণায় ইস্তফা দেয়। বিক্রি করে দেয় নিজের সদ্য কেনা বাড়ি। চলে যায় বেলিজের অরেঞ্জ ওয়াকে ম্যাকাফির সদ্য কেনা যায়গায় কোরাম সেন্সিং নিয়ে গবেষণা করার জন্য।

ম্যাকাফি ক্রমেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য স্থানীয় অপরাধীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র সহ। স্থানীয় পুলিশকে ঘুষ দেওয়া শুরু এমনকি তাদের নিজের সম্পত্তিতে থাকার যায়গা দেয়। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রচুর ডোনেশন দেয় নিয়মিত। এক মিলিয়ন ডলার দামের বোট কিনে দেয় পুলিশকে। এসবের উদ্দেশ্য নিরাপত্তা মনে হলেও আসলে এর ফলে এলাকাটা যেন তার হয়ে যায়। ক্রমেই সে যেন একটা দুর্গ গড়ে তোলে যেখানে তার লোকেরা যা খুশি তাই করতে পারে এবং আশেপাশের গ্রামগুলো তার লোকজনের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। পুলিশ ও ব্যক্তিগত অস্ত্রধারী মিলে একটা হাইব্রিড বাহীনি তৈরী হয় যারা মুলত চালিত হয় ম্যাকাফির কথায়।

ক্রমেই ম্যাকাফি প্রচুর আমেরিকান মিডিয়া ও সাংবাদিকের আমন্ত্রণ জানায় তার প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভবনের অগ্রগতি জানানোর জন্য। কোন অগ্রগতি না থাকলেও নানা রকম রাসায়নিক ও রং মিশিয়ে নকল স্যাম্পল তৈরী করে মিডিয়া ও সাংবাদিকের নিয়মিত মিথ্যা বলা হয়। এটা নিয়ে নানা পত্রিকা ও টিভিতে আকর্ষনীয় রিপোর্ট ছাপা হতে থাকে। গবেষক অ্যালিসন ক্রমেই এতে অস্বস্তি বোধ করে। ম্যাকাফি বলে ব্যবসার জন্য, ইনভেস্টর আকর্ষনের জন্য এগুলো দরকার আছে।     

ম্যাকাফি তার সিকিউরিটি দিন দিন আরও বৃদ্ধি করতে থাকে এবং সে ১২ জন আর্মড গার্ড নিয়ে চলাফেরা শুরু করে। তার লোকজন আশেপাশের গ্রামে কারফিউ দেওয়া শুরু করে। রাত নয়টার পর রাস্তায় দেখলে গুলি করা হবে এই ভয় দেখানো হয়। এসব দেখে ও ম্যাকাফির স্থানীয়দের মেরে ফেলা, সরকার ফেলে দেওয়া এইসব আগ্রাসি কথাবার্তা শুনে অ্যালিসন ভয় পায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় চলে যাবার।

একদিন সন্ধায় অ্যালিসন ম্যাকাফিকে তার কাজে অগ্রগতি না হওয়া, মিথ্যা প্রচারে তার অস্বস্তি ও আরও নানা সমস্যার কথা খুলে বলে। সে বলে সে ব্রেক চায় ও পরিবারের কাছে ফিরত চায়। ওই সময় অ্যালিসনের মাথা ব্যাথা শুরু হলে ম্যাকাফি তাকে অরেঞ্জ জুস ও দুটো ট্যাবলেট দেয়। সেটা খাবার পর অ্যালিসনের সে রাতের আর কিছু মনে পড়ে না। শুধু আবছাভাবে তার মনে পড়ে ম্যাকাফি তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। 

পরদিন তার ঘুম ভাঙলে সে অনুভব করে সে ক্লান্ত, অসুস্থ, ঘোরের ভেতরে আছে। তার শরীরে কোন পোশাক নেই এবং সে গত রাতের কথা তেমন মনে করতে পারে না। তার রুমে ফিরে গোসল করতে গিয়ে কাঁদতে থাকে, অনুভব করে ব্যাথা ও রক্তক্ষরণ।

পরে অ্যালিসন নিজেকে সামলে নিয়ে ম্যাকাফির সাথে দেখা করতে যায়। ম্যাকাফি ভাব করে যেন কিছুই হয়নি। অ্যালিসন শান্তভাবে জানায় সে চলে যেতে চায়। তার সাথে দেনা পাওনা যাতে সে মিটিয়ে ফেলে। দুই সেকেন্ডের মধ্যে ম্যাকাফি শান্ত থেকে উন্মত্ত পাগলে পরিণত হয়। অ্যালিসনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে দেওয়ালে চেপে ধরে। কোনমতে পালিয়ে অ্যালিসন ল্যাবের দরোজা বন্ধ করে দেয় এবং দ্রুত তার বাবাকে ইমেইল করে তার অবস্থা জানিয়ে এবং বিমানে দেশে যাবার টিকেট কেনে। 

ম্যাকাফি তখন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, প্রচন্ড বাজে গালাগালি করতে থাকে অ্যালিসন, পাগলের মত দরোজা ধাক্কাতে থাকে। তার পর সে চলে যায়। পরমূহুর্তেই সে ফিরে আসে অস্ত্র হাতে। অ্যালিসন ডেস্কের নিচে লুকিয়ে থাকে। অ্যালিসন তখন তার স্থানীয় বন্ধুদের টেক্সট করে। তারা এসে অ্যালিসনকে উদ্ধার করে। রাতে তারা তাদের এক আত্মিয়ের বাসায় তাকে রাখে এবং সকালে সে পালিয়ে আমেরিকার বিমান ধরতে পারে।

অ্যালিসন দেশে ফিরে এফবিআইকে ঘটনা জানায় কিন্তু বেলিজেতে ঘটা ঘটনার বিষয়ে তারা কিছু করতে পারবে না বলে জানায়। অ্যালিসন বলে আমি নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলাম তাকে আমি আগে চিনতে পারিনি বলে। সে একজন ভয়ংকর ব্যক্তি।

বেলিজে আসার পর ম্যাকাফি প্রচুর পরিমানে খরচ করতে থাকে পুলিশ বিভাগকে উপহার সামগ্রী দেওয়া, স্থানীয়দের উচ্চ বেতনে চাকুরি ইত্যাদী। সব সময়ই সে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কথা বললেও সাহায্য করত শুধু নিজের স্বার্থ সাপেক্ষে। দরিদ্র ও অশিক্ষিত অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসাবে অরেঞ্জ ওয়াক এলাকায় মেয়েরা ছিল স্বাভাবিকবাবেই নিগৃহিত ও নির্যাতিত।

অ্যালিসন চলে গেলে ম্যাকাফির কোরাম সেন্সিং গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। সে “লাভা’র্স” নামে একটি সস্তা স্থানীয় বারে প্রতিদিন যাওয়া শুরু করে। সেখানে কাজ করত অল্পবয়সী মেয়েরা যারা বারে মদ পরিবেশন করত আর অনেকেই পুরুষদের যৌন চাহিদা মেটাত। 
এইসব মেয়েরা সবাই হত অল্প বয়সী ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন যাদের অতীত ইতিহাস হচ্ছে তারা সকলেই অল্প বয়স থেকে নির্যাতিতা।
 
ম্যাকাফি এবার এইসব অল্পবয়ষ্কা কিশোরীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় এবং সেটা ছিল প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তার অস্বাভাবিক যৌন চাহিদা মেটানো। তার এক কর্মচারী অন ক্যামেরা বলে যে সে ৪০ থেকে ৪৫ জন মেয়ে তাকে সরবরাহ করেছে। একাধিক মেয়ে অন ক্যামেরা বিবৃতি দিয়েছে যে তাদের সাথে ম্যাকাফির স্বাভাবিক যৌন সঙ্গম সাধারণত হত না, হতো স্ক্যাট সেক্স। যেখানে ম্যাকাফি তাদের দিয়ে নিজের মুখে মলত্যাগ করিয়ে যৌন আনন্দ পেত। 

ঐ সময় একবার ম্যাকাফির কম্পাউন্ডে চুরি হয়। ডেভিড মিডলটন নামে এক তরুণ কিছু জিনিষ চুরি করে বলে প্রকাশ হয়। ম্যাকাফি তার সহকারীকে বলে তিন চারজন গুন্ডা ভাড়া করে ডেভিডকে উচিৎ শিক্ষা দিতে। গুন্ডারা ডেভিডকে তার বাসা থেকে ধরে নিতে গেলে সে দৌড়ে পালায়। মানুষের সহযোগীতা চায়। কিন্তু কেউ সহযোগীতা করে না। তাকে তারা ধরে ফেলে ও তার সারা দেহে, যৌনাঙ্গে টিজার দিয়ে শক দেয়। ছুরি দিয়ে সারা দেহে কোপায়। তার পর তারা ম্যাকাফিকে ফোন করে। ম্যাকাফি বলে সে তার সাথে সে কথা বলতে চায়। ম্যাকাফির গাড়িতে তাকে তুলে দিলে তিন চার মিনিট তাদের কথা হয়। তার পর তাকে তারা ডেভিডের গ্রাম কার্মেলিটাতে নিয়ে আসে ম্যাকাফির একটি পিকআপ ট্রাকে করে। তাকে তারা রাস্তায় ফেলে দেয় সবাইকে এই বার্তা দিতে যে ম্যাকাফির কম্পাউন্ডে চুরি করলে ফল কি হয় দেখ।

দুই দিন কোমায় থেকে ডেভিড মিডলটন মারা যায়। সেই হত্যার জন্য ম্যাকাফির পোষা পুলিশ কোন ক্লু খুঁজে পায় না। ছোট্ট একটি সন্তান তার পিতাকে হারায়। স্থানীয়রা বলে এখানে কারও সাহস নেই যে বিচার চায়।                       

স্যান পিয়েড্রো দ্বীপে ম্যকাফির বিচ হাউজের মাত্র ৬০০ ফুট দুরে এক ব্যক্তির বাড়ি ছিল যার নাম গ্রেগরি ফল। টুরিস্ট এলাকার বিচে ম্যাকাফির ভারি অস্ত্রসহ গার্ড নিয়ে চলাফেরা গ্রেগরির অপছন্দ ছিল। ম্যাকাফির ছিল অনেকগুলো হিংস্র কুকুর যারা বিচ এলাকায় মানুষদের ধাওয়া করত। এটাও পছন্দ ছিল না গ্রেগরি ফলের। সে ম্যাকাফির বাসায় যায় ও তাকে বলে কুকুর প্রতিবেশীদের সমস্যা করছে, কুকুর নিয়ন্ত্রণ করতে। ম্যাকাফি শটগান কক করে গ্রেগকে বাসা থেকে বের করে দেয়। 

গ্রেগরি কুকুরের উপদ্রবের জন্য পুলিশকে রিপোর্ট করে কিন্তু কোন ফল হয় না। দুইদিন পর এগারোটা কুকুরের মধ্যে চারটে কুকুরকে পাওয়া যায় বিষ খাওয়া অবস্থায়। ম্যাকাফি অসুস্থ কুকুগুলোকে গুলি করে মেরে ফেলে। সন্দেহ করে গ্রেগরী এটা করেছে। সে তার মেয়েবন্ধুকে বলে গ্রেগরীকে এর মুল্য দিতে হবে। দুইদিন পর গ্রেগোরীকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মাথার পেছনে গুলি, কাছে থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক, হত্যার জন্যই গুলি করা।  

পরের দিন পুলিশ ম্যাকাফির বাসায় গেলে সে বাসার পেছনে বালুতে গর্ত করে লুকিয়ে থাকে। তারপর সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়। প্রাক্তন দেহজীবি অপ্রাপ্ত বয়ষ্কা এক মেয়েবন্ধু নিয়ে সে কয়েকদিন পালিয়ে থাকে। এরপর তার বন্ধু, কর্মচারী, রাষ্ট্রিয় শুভাকাঙ্খীদের সহযোগীতায় অবৈধভাবে বর্ডার ক্রস করে গুয়াতেমালা চলে যায়। গ্রেগরি হত্যার মামলা প্রমাণের অভাবে ঝুলে থাকে। গ্রেগরি ফলের বাবা কান্না জড়িত কন্ঠে এক তথ্যচিত্রে বলে আমার ছেলের খুনি খুনের অপরাধে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখনও সবার আগ্রহের কেন্দ্র ম্যাকাফি, একজন খুনি নয়। 

অবৈধভাবে গুয়াতেমালা যাবার খবর ফাঁস হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কিন্তু জেল থেকে বাঁচতে সে হার্ট এটাকে আক্রান্ত হবার ভান করে। পরে গুয়াতেমালার সেরা আইনজীবি তার পক্ষে লড়ে (গুয়াতেমালার প্রাক্তন অ্যটর্নি জেনারেল) এবং তারা তাকে আর বেলিজে পাঠাতে পারে না, আমেরিকায় বহিষ্কার করে। পরদিন মুক্ত মানুষ হিসাবে ফ্লোরিডায় ফিরে আসে ম্যাকাফি রাতারাতি আগের ফর্মে।

অস্কার নমিনেটেড নারী চলচিত্র পরিচালক ন্যানিটে বাস্টিনের তথ্যচিত্র “গ্রিংগ – দি ডেঞ্জারাস লাইফ অব জন ম্যাকাফি” এর তদন্তে বের হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ম্যাকাফির কেয়ারটেকার কাশান চেভারিয়া যে সবাইকে ম্যাকাফির হয়ে অর্থ প্রেরণ করত সে অন ক্যামেরা বলে “বৃহস্পতিবার রাত্রে কুকুরগুলোকে বিষ দেওয়া হয়। 

পরের দিন সকাল নয়টার দিকে জন (ম্যাকাফি) আমাকে ডেকে হাতে ৫ হাজার ডলার দিয়ে বলে টাকাটা এডি ম্যাকয় নামে একজনের একাউন্টে দিয়ে দিতে। হত্যার রাত্রে, রবিবার ভোর সাড়ে তিন বা চারটার দিকে এডি আমাকে ফোন করে বলে তাকে তুলে নিয়ে যেতে। আমি তাকে গাড়ি নিয়ে তুলে নিয়ে আসি গ্রেগরি ফলের বাসার কাছে থেকে। আমি প্রথমে বুঝিনি ঐ টাকা দেবার কারণ। তবে পরে বুঝেছি ঐ ৫ হাজার ডলার ছিল ঐ মানুষটাকে হত্যা করার জন্য”। পুলিশকে সে একথা বলেছে কিনা এটা জিজ্ঞেস করলে সে বলে “আমি আশ্চর্য হয়েছি যে পুলিশ আমাদের থানায় নিয়েছিল কিন্তু কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি”।  

বেলিজ পুলিশের তদন্তে আরও বের হয় যে ম্যাকাফির আর এক মেয়েবন্ধু এমি নামের এক তরুনী তথ্য দেয় যে ঐ রাতে গ্রেগরি ফলকে প্রলুব্ধ করে তার সাথে তার ঘরে যায় ম্যাকাফির আর এক মেয়েবন্ধু মার্সিয়া নোভেলো। যাতে গ্রেগরি তার ঘরের দরোজা খোলা রাখে ও এডি ম্যাকয় নির্বিঘ্নে তার ঘরে ঢুকতে পারে। বেলিজ পুলিশকে এমির এই তথ্য দেবার দুই দিন পর এডি ম্যাকয় গোপনে বেলিজ ত্যাগ করে। 

আমেরিকা ফিরে গিয়ে ম্যাকাফি যেন বেলিজে তার সকল ইতিহাস ও কর্মকান্ড বেমালুম ভুলে যায়। এই সব তথ্য মিডিয়া, তথ্যচিত্র ও নেটে থাকা সত্বেও সে নতুন করে সিকিউরিটি গুরু হিসাবে এমন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে যে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যায় ও ভাল অবস্থান দখল করে।

মানব চরিত্র বিবর্তিত হয়ে ধনী কর্পোরেট জগতে এক নতুন প্রজাতি তৈরী হচ্ছে যারা প্রচুর অর্থ, ক্ষমতা, ক্যারিশমা ব্যবহার করে মন্ত্রী, পুলিশ, মিডিয়া থেকে শুরু করে মেধাবী আইনজীবি এবং অপরাধ জগত সহ সর্বস্তরে সংযোগ রেখে নিজের যা খুশি সেটা করার অধিকার নিয়ে নেয়। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এদের চিনতে পারে না এবং এদের সফল ও অনুসরনযোগ্য মনে করে। নিজের সন্তানদের এদের মত তৈরি করতে উন্মুখ থাকে। 

এদের একমাত্র আনন্দ অল্প বয়ষ্কা নারীদের সাথে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক। আশ্চর্য হচ্ছে ঐসব নারীরাও এদের প্রতি সব ভালবাসা নিংড়ে দিয়ে এরা যা করাতে চায়, খুশি মনে তাই করে থাকে। বাংলাদেশেও এই প্রজাতির সংখ্যা এখন অনেক এবং তারা একই রকম কাজ করে বেশিরভাগের শ্রদ্ধা ভালবাসার পাত্র। এরা কোন নারীকে ধর্ষন করলেও মানুষ সেই নারীর ত্রুটি খোঁজে। 

ম্যাকাফি ছিল এক্সট্রিম। কিন্তু এই মানসিকতার মানুষ ভদ্র বেশ ধরে তৈরী হচ্ছে প্রচুর। আধুনিক ধনতন্ত্র, নীতিহীন প্রশাসন, মেরুদন্ডহীন বিচার ব্যবস্থা এবং সমাজবিচ্ছিন্ন ক্যালাস মিডিয়া একটি ডিসটোপিক পরিস্থিতি তৈরী করেছে। প্রতিটি ঘটনা ও মানুষ সম্পর্কে ভাল ও মন্দ দুটো পরস্পরবিরোধী তথ্য একসাথে ছড়ানো হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি হচ্ছে বিভ্রান্ত। যার সুযোগে জয়ী হচ্ছে তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লোভ আর ইন্দ্রিয় আকর্ষন। সেটাতেই সুযোগ পেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে সাইকোপ্যাথ, সোশিওপ্যাথ ও নেতিবাচক অসামাজিক মানসিকতার মানুষেরা, যারা চলে যাচ্ছে নেতৃত্বে। 

তথ্য সূত্র: 

1. John McAfee Fled to Belize, But He Couldn't Escape Himself, WIRED magazine, 12.24.2012
2. John McAfee: Addict, coder, runaway, BBC, 11 October 2013
3. Gringo: The Dangerous Life of John McAfee (2016), Documentary by Nanette Burstein

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।