৭৫ এর অগাস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা শুধু যে বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগনকে পিতৃহীন ও সন্ত্রস্ত করেছিল তাই না, বাংলার বন্য জীবজন্তুদেরও অসহায় ও বিপদগ্রস্থ করেছিল। ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতে বন্যপ্রাণী আইন প্রণয়ন করেন এর ফলে সেখান থেকে বন্যপ্রাণী রপ্তানী বন্ধ হয়ে যায়। এর সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশেও বন্যপ্রাণী আইন প্রণয়ন করেন যার ফলে বাংলাদেশ থেকে বন্যপ্রাণী রপ্তানীর কোন সুযোগ থাকে না।
কিন্তু ৭৫ এর অগাস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া ক্ষমতায় আসলে ৭৬ এর জানুয়ারীতেই জিয়ার সামরিক সরকার মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছে ডেট্রয়টের মোল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে ৭১,৫০০ বানর ও উল্লুক রপ্তানীর চুক্তি করে। যাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমারিক ল্যাবরেটরিতে পারমানবিক রেডিয়েশন দিয়ে পারমানবিক বোমার ফলাফল পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার করার কথা ছিল।
চুক্তি অনুযায়ী সকল প্রারম্ভিক কার্য্য সমপন্ন হলে জানুয়ারী ১৯৭৯ তে ১৬০০ বানর আমেরিকায় পৌছে। প্রাণী অধিকার আন্দোলনকারীরা শংকিত ছিল যে এই ধরনের সামরিকের সাথে সামরিক চুক্তিতে ৭১,৫০০ প্রাণী রপ্তানী হবার কথা থাকলেও আসলে কত পাচার হবে সেটি বলা যায় না। কারন বনের পাশে উঁচু দেওয়াল ঘেরা সামরিক কায়দার স্থাপনায় ধৃত প্রাণীরা কাভার্ড ভ্যানে ওঠে তার পর গভীর রাতে গন্তব্যে চলে যায় সশস্ত্র প্রহরায়।
লাওস ভিয়েতনাম সহ যে সব দেশে এমন চুক্তি হয়েছে সে সব দেশে বন থেকে সব প্রাণী উজাড় হয়েছে এমনই পরিসংখ্যান। দেশে গুটিকয়েক বন্যপ্রাণীপ্রেমী, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড: জাকির হোসেন ও আমেরিকার একটি নেচার কনজার্ভেশন প্রতিষ্ঠান আইপিপিএল এর প্রধান শার্লি ম্যাকগিল এই চুক্তির বিরোধিতা করতে থাকে।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৪.৫% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে সংসদে ৫৪ টি আসন লাভ করে। ঐ সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুল মালেক উকিল বানর জাতীয় প্রাণী রপ্তানী এবং তাদের মার্কিন সামরিক প্রয়োজনে রেডিয়েশন দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন।
এর ফলে পরেরদিন নানা পত্রিকায় এটি নিয়ে খবর/নিবন্ধ ছাপা হয়। কোন কোন পত্রিকা এমনও লেখে যে বানর রপ্তানীর পর বাংলাদেশের গরীব শিশুও রপ্তানী হবে ও ব্যবহৃত হবে একই কাজে। এর ফলে কাজ হয়। জিয়া সরকার রপ্তানী স্থগিতের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়।
এর পর ঢাকার মার্কিন দুতাবাস সকল কুটনৈতিক প্রথা ভঙ্গ করে সরকারকে চাপ দিতে থাকে রপ্তানী কার্য্যক্রম চালু করতে। চুড়ান্ত ধৃষ্টতা দেখিয়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দুতাবাসকে ডেকে হুমকি দেওয়া হয় যে "বানর রপ্তানী কর, না হলে সাহায্য বন্ধ"। এই সংক্রান্ত তখনকার নিউ সাইন্টিস্ট পত্রিকার নিবন্ধটি ছবিতে দিয়ে দিলাম।
এর পর এরশাদ ক্ষমতায় আসে। মার্কিন সুন্দরী তরূনী বন্যপ্রাণীপ্রেমীর একটি ফোন কলেই এরশাদ রপ্তানী চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। এর মধ্যে রপ্তানী বাতিল হলে উক্ত মোল এন্টারপ্রাইজ ডেট্রয়েটের আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে ও কয়েক মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপুরণ দাবী করে।
যদিও ভিনদেশের আদালতে এই মামলা লড়তে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য নয় তাই সরকার নিষ্ক্রীয় থাকে। কিন্তু যেহেতু এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সন্মানের বিষয়, উক্ত মার্কিন নেচার কনজার্ভেশন প্রতিষ্ঠান মামলাটি বাংলাদেশের হয়ে লড়তে চায়।
কিন্তু এরকম হাই প্রোফাইল মামলায় উকিল দরকার উঁচু মানের যেখানে “জাজেরা ঘুষ খায়” (আমি আমেরিকায় গেলে এটা নিজে নেওয়া সাক্ষাৎকারে পেয়েছি)। তাদের এত টাকা ছিল না তেমন উকিল নিয়োগ করার। তখন খুব নামকরা এক উকিল, তিনি বিনা পয়সায় মামলাটি লড়তে রাজী হন এবং পরিশেষে বাংলাদেশ মামলাটিতে জয়লাভ করে। রেডিয়েশনে ধুকে ধুকে মরার থেকে বেঁচে যায় লক্ষাধিক প্রাণ যারা এই প্রকৃতিরই সন্তান।