ইউ এস বাংলা ফ্লাইট বিএস ২১১:

একটি বিমান দুর্ঘটনা ৫১টি পরিবারের কান্না ও একটি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

মার্চ ১২ ২০১৮ তারিখে স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে নেপালের কাঠমুন্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস ২১১ (ইউবিজি ২১১) কেন দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল সেটা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। বিমানটিতে ৭১ জন আরোহী ছিল যার মধ্যে ৫১ জন দুর্ঘটনায় নিহত হয়। আন্তর্দেশীয় (নেপাল, বাংলাদেশ ও কানাডা) সদস্যদের নিয়ে  দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠিত ও চুড়ান্ত রিপোর্টে যা আছে সেটা হলো কানাডার বম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি রানওয়েতে অনিরাপদ অবতরণ করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে মানব ত্রুটি (হিউম্যান এরর) যার জন্য দায়ী উড়োজাহাজের পাইলট ইন কম্যান্ড ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান, যিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক ফাইটার পাইলট ছিলেন। তার এ ভুলের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে:

১। অনিয়ন্ত্রিত গতি, উচ্চতা, বিপজ্জনক অ্যটিচ্যুড (গতির দিক ও বাঁক) এবং রানওয়ের সাথে অসম এলাইনমেন্ট তথা অনিরাপদ ল্যান্ডিং প্রচেষ্টায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয় ও আগুন ধরে যায়।

২। এই পরিস্থিতিতে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত গো এরাউন্ড (ল্যান্ডিং প্রচেষ্টা বাতিল করে ঘুরে এসে আবার ল্যান্ডিং করা) করা সম্ভব হলেও সেই চেষ্টা করা হয়নি।

৩। বিপজ্জনক ল্যান্ডিং পরিস্থিতির আগে বিমানটি পথ বিচ্যুত হয় যখন পাইলটেরা দিকভ্রান্ত হয় (ডিসঅরিয়েন্টেশন) ও সম্পুর্ণভাবে পরিস্থিতিগত সচেতনতা হারায় (কমপ্লিট ল্যাক অব সিচুয়েশনাল অ্যাওয়্যারনেস)।

৪। এই পরিস্থিতির কারণ হিসাবে দেখা হয় পাইলট ইন কম্যান্ডের মানসিক চাপ (স্ট্রেস) ও বিষন্নতা (ডিপ্রেশন) যার কারণ অপর একজন নারী পাইলটের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ও তার প্রভাব। যেটা ককপিটেই ক্রিটিক্যাল সময়ে তার আবেগগত বিপর্যয় (ইমোশোনাল ব্রেকডাউন) ঘটায়।     

ক্রিটিক্যাল সময়ে আবেগপ্রবণ হয়ে তার অবস্থান ও পরিস্থিতির বোধ হারানো, ককপিটে ধুমপান, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, কাজে ভুল করা, পথ হারানো, অসংলগ্ন যোগাযোগ, পরিশেষে রানওয়ে খুঁজে পেলেও ল্যান্ডিং অসম্ভব জেনেও প্রায় অসম্ভব ল্যান্ডিংএর চেষ্টা করা। ল্যান্ডিং বাতিল করে পুরায় চেষ্টা না করে একটি প্যাসেঞ্জার বিমানকে ফাইটার জেটের মত চালিয়ে ল্যান্ডিং এর চেষ্টা করা ও বিধ্বস্ত হওয়া।

আমরা যারা মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করি তাদের কাছে বিষয়টি খুব অদ্ভুত। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই বিমানের চালক ও পাইলট ইন কম্যান্ড ক্যাপ্টেন আবিদের আচরণ মোটেই একজন বিষন্ন ব্যক্তির আচরণের সাথে মেলে না। ক্যাপ্টেন আবিদ ছিল একজন হাই পার্ফমার পাইলট, যে ছিল একজন প্রশিক্ষক। ছাত্র জীবনে সে ছিল একজন প্রথম শ্রেণীর ছাত্র এবং পরিক্ষার খাতা বা বিমান চালনার সিম্যুলেটর সর্বক্ষেত্রেই সে ছিল উচ্চমানের নম্বর পাওয়া ব্যক্তি।

লামিয়া নামে তার শিক্ষানবিশ যে নারী পাইলটের উপর সে ক্ষিপ্ত ছিল সেটাও খুব অদ্ভুত। নারী পুরুষের মধ্যে যদি রোমান্টিক সম্পর্ক থাকে এমন কি যৌন সম্পর্কও থাকে তবুও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে বা সম্পর্কের অবনতি হলে সেটা তিক্ততার পর্যায়ে যেতে পারে, হিংসা, হতাশা, প্রতিশোধের পথে যেতে পারে কিন্তু ক্যাপ্টেন আবিদের যে আচরণ সেটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু।

ক্যাপ্টেন আবিদের আচরণ ছিল সবার প্রতি ক্ষুব্ধ আগ্রাসী, অথচ একই সময় পাইলট পৃত্থুলা রশিদের প্রতি সম্পুর্ণ শীতল ঠান্ডা মাথার। এর সাথে ছিল স্থানিক চিন্তার লোপ (ল্যাক অব স্পেশিয়াল কগনিশন), ওয়ার্কিং মেমোরির সীমাবদ্ধতা যা তৈরী করে পরিস্থিতিগত সচেতনতার অভাব ও হাতে থাকা কাজ বা টাস্ক ভুলে যাওয়া। ছিল নিয়ম ও প্রসিডিউর না মানা (ইম্পালসিভিটি) ও ঝুঁকি নেওয়া (রিস্ক টেকিং বিহেভিয়র)। এর সাথে ক্রমেই তার কমে আসছিল ভবিষ্যত চেতনা, যে তার বর্তমান কর্মকান্ডের ফল কি হতে পারে এটার বোধ ও আত্ম নিয়ন্ত্রণ। 

ক্যাপ্টেন আবিদের আচরণ ছিল অনেকটা গভীর নেশায় আসক্তদের উইথড্রল সিম্পটমের মত যদিও সিগারেট ছাড়া কোন নোশাদ্রব্য ব্যবহারের কোন অভিযোগ বা প্রমান মেলেনি। সহকর্মী শিক্ষানবিশ নারী পাইলট লামিয়া তার কাছে একটা স্বাভাবিক প্রেম বা যৌন সম্পর্কের কিছু ছিল না, যেন ছিল একটা নেশা, সেটা বিষে পরিণত হওয়াতে তার উপরোক্ত পরিণতি হয় যার স্থান হয়ত সে পুরণ করতে চেয়েছিল কো পাইলট পৃথুলা রশিদকে ইমপ্রেস করে তাই সে একের পর এক ভুল করে গেছে। ভুল স্বীকার করে সেগুলো সংশোধনে হয়ত পাশে বসা কো পাইলটের কাছে তার মুল্য কমে যেতে পারে তাই সেগেুলো সে সচেতনে বা অবচেতনে অবহেলা করে গেছে এবং শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যে বিমানটিকে রক্ষা করার সব পথ খোলা ছিল, পাশে বসা তরুণী শিক্ষানবিশের কাছে নিজের ইগো সংরক্ষনের জন্য সেটা সে করেনি বরং অসম্ভব নায়োকোচিত ল্যান্ডিং করতে গেছে যা অসম্ভব।

এই দুর্ঘটনা নিয়ে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের তথ্যচিত্রে পাইলট/এভিয়েশন এনালিস্ট সিলভিয়া রিংলি যেমন বলেছে “সে (পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ) নিচু উচ্চতায় এমনভাবে বিমানটাকে চালাতে চাচ্ছিল, উড়ে বেড়াচ্ছিল বিমান বন্দর চত্তরে যেন একটা টপ গান পাইলটের মত যেটা ছিল একটা চরম বেপরোয়া আচরণ"।          

তদন্তে বলা হয়েছে পাইলটের স্ট্রেস ও ইমোশোনাল ব্রেকডাউন এর জন্য দায়ী যে আগের দিন চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েছে বলে জানিয়েছে এবং রাতে ঘুমায়নি বলে জানিয়েছে। তদন্তে এটাও পাওয়া যায় যে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান, যিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলট ছিলেন তার বিমান বাহিনী ত্যাগ করতে হয়েছিল (রিলিজড) তার বিষন্নতাজনিত সমস্যার কারণে। কিন্তু বিষয়টা কি শুধুই তাই? আমার মনে হয় সমস্যাটা আরও গভীর যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে সমাজে ভাল ছাত্র এবং হাই পার্ফর্মেন্স প্রফেশনালদের মধ্যে। এটি একটি ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের প্রোফাইল যেটাকে আধুনিক সমাজ ইচ্ছা করে লুকিয়ে রাখতে চাইছে।

এই বিমানে ক্যাপ্টেন আবিদের প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়ার আগেই। অপারেশন্সের কাছে যখন পাইলট ইন কম্যান্ড এডিসি (এয়ার ডিফেন্স ক্লিয়ারেন্স) নম্বর চায়:

পাইলট ইন কম্যান্ড: তুমি কি এডিসি নম্বরটা পেয়েছ? (বাংলায় কো পাইলটকে)

ফার্স্ট অফিসার: না স্যার আমি একটা নম্বর পেয়েছি ২১৭৭

পাইলট ইন কম্যান্ড: অপারেশনস বিএস ২১১, জবাব দিতে আর কত সময় নেবে, আমি এডিসি এবং এফআইসি চাই (রাগী কন্ঠ)

অপারেশনস: কেটিএম এফআইসি ফর ২১১ হলো ১১৭১ এবং এডিসি কেএক্স ৮৪৮ ফর ২১২

পাইলট ইন কম্যান্ড: আই ডোন্ট ওয়ান্ট ফাক, ফাক ২১২, আই ওয়ান্ট ২১১ (অসম্ভব রাগী স্বর)... আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ফাক ইউ, রিড ইউ, এগেইন? কিপ ই্য়োর ফাকিং মাউথ শাট

পাইলট ইন কম্যান্ড: ক্লিয়ারেন্স পেয়েছ? (কো পাইলটকে)

ফার্স্ট অফিসার: জ্বি স্যার, লাইন আপ করার অপেক্ষায়

পাইলট ইন কম্যান্ড: ভয় পেও না, আমি আরও তিন মাস আছি, আই অ্যাম গোইং টু ফাক দিস পিপল রাইট অ্যান্ড লেফ্ট।

টেক অফ করেই এই আলাপের ছয় মিনিট পর ক্যাপ্টেন আবিদ অপারেশনকে কল করে অনবোর্ড ফুয়েল সম্পর্কে তারা কেন জানতে চায় সেটা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে অথচ অপারেশনস এই ফ্লাইটের অনবোর্ড ফুয়েল সম্পর্কে জানতে চায়নি, তারা জানতে চেয়েছে অন্য একটি ফ্লাইটের যেটা ক্যাপ্টেন আবিদ ক্রস হেয়ারিং করে তার কাছে মনে হয়েছিল এটা তার প্রতি:

পাইলট ইন কমান্ড: অপারেশন বিএস 211?            

অপারেশনস: বিএস 211 অপারেশনস, গো অ্যাহেড স্যার 

পাইলট ইন কমান্ড: কোন দোজখের জন্য তোমার অনবোর্ড ফুয়েলের হিসাব দরকার?  তুমি আমাকে অনবোর্ড ফুয়েলের কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? অনবোর্ড ফুয়েলের নিয়ে তুমি কী করতে চাও তা আমাকে বল, আমাকে এখনই জানিয়ে দাও ... আমি ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি ফাকিং লিখিত ব্যাখ্যা চাই (রাগী সুর)

অপারেশনস: কপিড স্যার, উইলকো (আমরা সহযোগীতা করব), সেফ ফ্লাইট স্যার                                                       

পাইলট ইন কমান্ড: আই ডোন্ট ফাক ইয়োর সেফ ফ্লাইট, ইউ ফাক ইয়োর ডার্টি..... আমি তোকে কল না করা পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলবি না

এই আলাপগুলোতে দেখা যায় কোন দৃশ্যমান প্রভোকেশন ছাড়া ক্যাপ্টেন আবিদ অসম্ভব ক্ষোভ নোংরা বাক্য মারফত প্রকাশ করেছেন একটি অল্প বয়স্কা নারী কলিগ তার পাশে থাকা অবস্থায়ও।

বিমান চালনার সময় বিমানটিকে যাত্রাপথে বিভিন্ন পুর্ব নির্ধারিত ওয়েপয়েন্ট টাচ করে যেতে হয় এবং কোন ওয়েপয়েন্টে পৌছালে তাকে পরবর্তী ওয়েপয়েন্ট পর্যন্ত যাত্রার নির্দেশাবলী দেওয়া হয়। কাঠমুন্ডু বিমানবন্দরে পৌছাবার ঠিক আগের ওয়েপয়েন্টটা হলো গুরাস। ঢাকা এইচএসআইএ থেকে গুরাস পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আবিদ ফার্স্ট অফিসার পৃথুলা রশীদকে বিমান চালনার বিভিন্ন বিষয় শেখান খুব ধীর স্থির ও ঠান্ডা মাথায়। পেশাগত ফর্মাল যোগাযোগে অনিয়ন্ত্রিত অযৌক্তিক ক্ষোভ আর পরমুহুর্তেই একজনের সাথে অপেক্ষাকৃত অ-জরুরী বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় প্রশিক্ষণ কোনভাবেই কোন স্বাভাবিক ডিসট্রেসের লক্ষণ নয়। এটাই প্রথম রেড ফ্ল্যাগ যে এখানে অন্য কিছু আছে। 

ঢাকা এইচএসআইএ থেকে গুরাস পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ শেষ হলে ক্যাপ্টেন আবিদ তার প্রাক্তন শিক্ষানবীশ পাইলট লামিয়াকে নিয়ে তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে অত্যন্ত নোংরা ভাষায়। কোন নারীর সাথে যদি কর্মক্ষেত্রেও কোন পুরুষের আবেগগত সম্পর্ক থাকে সেটা প্রেম বা যৌনতাও যদি হয়, সেই সম্পর্ক ভেঙে গেলে উক্ত নারী বা পুরুষের মধ্যে ইমোশোনাল ব্রেক ডাউন হতে পারে, তারা বিষন্ন থাকতে পারে, তারা সাময়িক কর্মক্ষমতা হারাতে পারে কিন্তু প্রফেশনালরা, বিশেষ করে পুরুষেরা সাধারণতঃ সেটা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রকাশ বা অন্যের সামনে এটা নিয়ে সিন ক্রিয়েট করে না।

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা কলিগদের সাথে সম্পর্ক সমসময়ই 'নিষিদ্ধ' সম্পর্ক তাই সুস্থ চিন্তার মানুষেরা, তারা যত বিপর্যস্থই হোক না কেন এমন হলে তারা নিজেদের লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে যায়।
 
শিক্ষানবীশ পাইলট লামিয়াকে নিয়ে ক্যাপ্টেন আবিদের মনে যে সচেতন সম্পর্ক সেটা তাই প্রেম বা যৌনতার ছিল বলে মনে হয় না। এই সম্পর্কটা আমার মতে সম্ভবত ছিল ওয়ার্কস্পেস কো-ডিপেন্ডেন্ট রিলেশনশিপ।  

পরের পর্বে থাকবে একটি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের প্রোফাইল যাতে দেখা যাবে অসম্ভব ভাল ছাত্র, হাইলি স্কিলড প্রফেশনালস, ওয়ার্কোহলিক সাসসেসফুল মানুষেরা কিভাবে তাদের অন্তর্জগতের ক্ষোভকে দমাতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ শেখে সেটাকে কাজে লাগিয়ে ও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দ্বিতীয় হয়। পেশাগত দক্ষতায় সেরা হয় এবং অসম্ভব কর্মঠ ও সফল হয় কিন্তু ক্রমেই তারা হয়ে ওঠে লক্ষ্যহীন, পরিবেশ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে ক্রমেই অসেচতন এবং অল্প বয়স্ক তরুণীর প্রশংসার করুণ মুখাপেক্ষী। 

আরও ভয়ঙ্কর হল নানা গবেষণা বলছে এই ব্যক্তিরা যখন কোন বিশেষ কারণে ট্রিগ্রারড হয় তখন তাদের স্পেশিয়াল ওয়ার্কিং মেমোরির অকার্যকারিতা দেখা দেয় (ডিসঅরিয়েন্টেশন), এদের মধ্যে তখন অ্যাটেনশন সেট শিফটিং দেখা দেয় (যে কাজ করছে তার বাইরে মনোযোগ), ডিসট্র্যাকশন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা লোপ পায়, মুড ইনস্ট্যাবিলিটি বৃদ্ধি পায়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধারণা লোপ পায়, কি হতে যাচ্ছে সেটা চিন্তা করার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে আসে, লক্ষ্য (গোল) হারিয়ে ফেলে। তারা হয়ে ওঠে ইম্পালসিভ ও রিস্কটেকিং। হারিয়ে ফেলে কার্য-কারন বোধ।

দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস ২১১ (ইউবিজি ২১১) বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদের প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়ার আগেই সেটা ছিল প্রায় সকলের প্রতি তার ক্ষুব্ধ আচরণ। যদিও সেটা বিমান চালনার প্রথম অংশে কোন প্রভাব ফেলেনি। ফ্লাইট কন্ট্রোলে সমস্যা শুরু হয় তারা যখন রোমিও ও রতন ওয়েপয়েন্ট ছেড়ে এসে গুরাস ওয়েপয়েন্টে পৌছায়। গুরাস ওয়েপয়েন্টের ৩৪ মাইল আগে তারা ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে একটি হোল্ডিং প্যাটার্ন প্রি-প্রোগ্রাম করে। গুরাস যেহেতু কাঠমুন্ডু এয়ারপোর্টের আগে শেষ ওয়েপয়েন্ট, রানওয়ে ব্যস্ত থাকলে এখানে অনেক সময় হোল্ডিং প্যার্টার্নে যেতে বলা হয় যেটা হল একটা রেস ট্র্যাক প্যাটার্নে বিমানকে চালিয়ে সময় ক্ষেপণ করা যা সাধারণভাবে তিন মিনিটের মত হয়ে থাকে। হোল্ডিং প্যাটার্ন শুরু করেলে সেটা শেষ করতে হয় যাতে বিমান যেখান থেকে সেটা শুরু করেছিল সেখানেই ফিরে এসে বাকি যাত্রা শুরু করে।

গুরাসে আসার আগে কাঠমুন্ডু অ্যাপ্রোচ তাদের ১৩,৫০০ ফুটে নামতে বলে এবং গুরাসে হোল্ডে থাকতে বলে। সাথে সাথে ক্যাপ্টেন আবিদ কো পাইলট পৃথুলাকে বলে তুমি কি জান কিভাবে হোল্ডে যেতে হয়? প্রিথুলা তাকে দেখায় কিভাবে এবং তারা সাথে সাথে হোল্ডে চলে যায়। গুরাসে পৌছানোর তিন মাইল আগে কাঠমুন্ডু অ্যাপ্রোচ তাদের বলে গুরাসে আর হোল্ডের প্রয়োজন নেই তারা ১১,৫০০ ফুটে নেমে তারা যেন ভিওআরএ প্রবেশ করে ও রানওয়ে ০২ তে ল্যান্ড করে।

ভিওআর হল একটি ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওমিনি ডাইরেকশনাল রেঞ্জ নেভিগেশনাল সিস্টেম। আমি যখন কম্পিউটারে ফ্লাইট সিম্যুলেটরে বিমান চালিয়েছি তখন দেখেছি সবচেয়ে কঠিন হল বিমানকে ল্যান্ডিং এর আগে রানওয়েতে এলাইন করা সঠিক অ্যাপ্রোচে। ভিওআর হলো সেই ব্যবস্থা যার আওতায় প্রবেশ করলে এই ব্যবস্থা বিমানকে সঠিকভাবে রানওয়েতে নামার জন্য সঠিক অ্যাপ্রোচে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাইড করে।   

এই সময় পাইলট ইন কম্যান্ড ক্যাপ্টেন আবিদের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে যায়। দুই পাইলটই ব্যস্ত হয়ে যায় সিগারেট খুঁজতে। তারা ভুলে যায় হোল্ড থেকে বের হতে। গুরাসে আসার পর কাঠমুন্ডু অ্যাপ্রোচ খেয়াল করে বিএস ২১১ হোল্ডে ঢুকেছে এবং তখনও হোল্ডে আছে। কাঠমুন্ডু অ্যাপ্রোচ জানতে চায় বিমানটি গুরাসে হোল্ডিং করছে কিনা? তখন তাড়াতাড়ি তারা হোল্ডিং প্যাটার্ন কমপ্লিট না করেই হোল্ড ক্যান্সেল করে। জবাবে ফার্স্ট অফিসার কাঠমুন্ডু অ্যাপ্রোচকে জানায় তারা অ্যপ্রোচ কন্টিনিউ করছে (চেপে যায় হোল্ডের কথা)।

পাইলট হোল্ডিং প্যাটার্ন কমপ্লিট না করেই হোল্ড ক্যান্সেল করে এবং বিমানকে হেডিং মোডে চালাতে শুরু করে। হেডিং মোডে একটি নির্দিষ্ট হেডিং (দিক) সেট করে দিলে অটোপাইলট বিমানকে সেদিকেই চালাতে থাকে। ঐদিন কাঠমুন্ডুর আকাশে বাতাস ছিল অনেক। পশ্চিম থেকে আসা ২৭ নটের বাতাস বিএস ২১১কে ডানদিকে ঠেলতে থাকে সেটা তাদের রানওয়ের পথ থেকে দুরে নিয়ে যেতে থাকে এবং তারা ভিওআর এর আওতায় বাইরে দিয়ে রানওয়ে পার হয়ে চলে যেতে থকে। হেডিং মোডে যখন বিমান চালনা করা হয় তখন বাতাসের গতি ও দিক হিসাব করে কিছুক্ষন পর পর হেডিং কারেকশন করতে হয়। বিএস ২১১ এর দুই পালটই সেটা করতে বেমালুম ভুলে যায়। তারা ভিওআর এবং রানওয়ে ছেড়ে ডানদিক দিয়ে উড়তে থাকে ও রানওয়ে খুঁজে পায় না।

এই সময় ক্যাপ্টেন আবিদ ফার্ষ্ট অফিসারকে বলে "বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট কর"। 

ফার্ষ্ট অফিসার: ল্যান্ডিং গিয়ার

পাইলট ইন কম্যান্ড: ডাউন থ্রি গ্রিন 

ফার্ষ্ট অফিসার: ফ্ল্যাপস

পাইলট ইন কম্যান্ড: ১ ৫ সেট

ফার্ষ্ট অফিসার: স্যার নট ইয়েট সেট (LANDING GEAR UNSAFE WARNING)... স্যার স্পিড স্পিড স্পিড

পাইলট ইন কম্যান্ড: ভয় পেওনা ভয় পেওনা (LANDING GEAR UNSAFE WARNING)

ল্যান্ডিং প্রসিডিওর অনুযায়ী তিনটি চাকা নামানোর কথা ও তিনটি চাকা ঠিকমত নামলে তিনটি সবুজ বাতি জ্বলার কথা। ফার্স্ট অফিসার ল্যান্ডিং গিয়ার নামানোর প্রম্ট করলেও ক্যাপ্টেন আবিদ ল্যান্ডিং গিয়ের নামায় না কিন্তু মুখে বলে নামিয়েছে। তিনটি সবুজ বাতি জ্বলেছে বললেও সেগুলো জ্বলেনি এবং প্রচন্ড জোরে ল্যান্ডিং গিয়ার আনসেফ ওয়ার্নিং বাজতে থাকলেও সেটা তারা খেয়ালই করে না। 

এক মিনিট পর ক্যাপ্টেন আবিদ দ্বিতীয় বারের মত বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট করতে বলে। তখন ফার্স্ট অফিসার বলে আমরা বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট করেছি।

এই সময় [MIMINUMS, MIMINUMS], [GEAR UNSAFE WARNING] বাজতে থাকে যার অর্থ তারা ভুমির খুব কাছে এবং চাকা নামানো হয়নি। 

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বাংলায় বলে আমরা কি রানওয়ে দেখতে পাচ্ছি? 

এই সময় [EGPWS “MINIMUM” “SINK RATE”] [“TOO LOW-GEARS”]  কল গুলো বাজতে থকে তার মানে গ্রাউন্ড প্রক্সিমিটি মিনিমাম এবং সিঙ্ক রেট মানে রেট অব ডিসেন্ট অস্বাভাবিক, গিয়ার নামানো নাই।

এই সময় ফার্স্ট অফিসার বাংলায় বলে “স্যার ল্যান্ডিং গিয়ার এখনও নামানো নাই”

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বলে “ঠিক আছে গিয়ার নামাও....” তারপর আবার বলে “বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট কর”।

ফার্স্ট অফিসার জবাব দেয় তৃতীয় বারের মত “ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট করেছি স্যার”।

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বাংলায় বলে “রানওয়ে দেখা যাচ্ছে”?

ফার্স্ট অফিসার জবাব দেয় “না স্যার” 

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বাংলায় বলে “এখনও দেখা যাচ্ছে না? সমস্যা নাই সামনে দেখা যাবে”।

বিমানটি তখন রানওয়ে মিস করে ডান পাশ দিয়ে রানওয়ের অপর প্রান্তে এসে পড়েছে। এতে কাঠমুন্ডু টাওয়ার অবাক হয় এবং মনে করে বিমানটি বিপরীত দিক থেকে ল্যান্ড করতে চাচ্ছে। তারা তখন বলে “তোমাকে রানওয়া ০২ তে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তুমি রানওয়ে ২০ এর দিকে যাচ্ছ”।

ক্যাপ্টেন আবিদ তখন বলে “আমরা ০২ এর দিকে যাচ্ছি”

কাঠমুন্ডু টাওয়ার তখন বিপরীত দিক অর্থাৎ রানওয়ে ২০ থেকে ল্যান্ড করার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেয় না, তাদের বর্তমান অবস্থায় থাকতে বলে কারণ আর একটা বিমান বিপরীত দিক থেকে মানে রানওয়ে ২০ তে ল্যান্ড করছিল।

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বলে আমরা কি “রানওয়ে দেখতে পাচ্ছি? আমরা সব কিছু সেট আপ করেছি কিন্তু রানওয়ে দেখতে পাচ্ছি না”

তখন ফার্স্ট অফিসার জবাব দেয় “না”

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ বলে “ভিওআর আমাদের বামে তাই না”?.... তারপর আবার বলে “বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট কর”।

ফার্স্ট অফিসার চতুর্থ বারের মত জবাব দেয় “ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট করেছি স্যার”।

তখন ফার্স্ট অফিসার রানওয়ে দেখতে পায় বলে ওঠে “স্যার ঐ যে রানওয়ে”

এরপর কাঠমুন্ডু টাওয়ার রানওয়ে ২০ ক্লিয়ার হলে রানওয়ে ২০ বা ০২ সেটাতে খুশি নামার ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেয়।

তখন ক্যাপ্টেন আবিদ আবার বলে “বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট কর”।

ফার্স্ট অফিসার পঞ্চম বারের মত জবাব দেয় “ল্যান্ডিং চেকলিস্ট কমপ্লিট করেছি স্যার”।

তার পর তারা আবার রানওয়ে হারিয়ে ফেলে। 

ফার্স্ট অফিসার আবার রানওয়ে দেখতে পায় বলে “স্যার রানওয়ে থ্রি-ও ক্লক”। 

কাঠমুন্ডু টাওয়ার তাদের গতিবিধি দেখে ও তাদের বিমান রানওয়ের সাথে এলাইনড না দেখে তাদের ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স বাতিল করে, আবার আকাশে উড়ে যেতে বলে। 

তখন টাওয়ারের নিষেধাজ্ঞায় পাত্তা না দিয়ে ক্যাপ্টেন আবিদ “বলে রানওয়ে দেখতে পাচ্ছি আমরা কি ল্যান্ড করার জন্য ক্লিয়ার”?

কাঠমুন্ডু টাওয়ার বলে “এটা রানওয়ে না, উড়ে যাও, ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স বাতিল”।

ফার্স্ট অফিসার তখন বলে “ও মাই গড, স্যার...”

যারা বিমানের ককপিটে থেকেছেন টেকঅফ বা বিশেষ করে ল্যান্ডিং এর সময় বা যারা ফ্লাইট সিমুলেটর চালিয়েছেন তারা জানেন কি প্রচন্ড শব্দে এলার্ম ও কলগুলো বেজে ওঠে। তেমনই প্রচন্ড শব্দে বাজছিল ঐ ককপিটে [“BANK ANGLE, BANK ANGLE, BANK ANGLE, SINK RATE, SINK RATE”] [“50”] [“BANK ANGLE, BANK ANGLE”] এই সময় ক্যাপ্টেন আবিদের কানে কিছুই ঢোকেনি। এটাও ঢোকেনি যে তার ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স ক্যানসেল করা হয়েছে তাকে এখন আকাশে উড়ে যেতে হবে। বিমানকে রানওয়ের সাথে ঠিকমত এলাইন করতে হবে ও পুনরায় ঠান্ডা মাথায় ল্যান্ডিং করতে হবে। তার মত অভিজ্ঞ পাইলটের এটা ইন্সটিংট হয়ে যাবার কথা এবং এটা কোন বিষয়ই না। কিন্তু এসব কিছু না করে সে যেন চলে গোছিল ৩৩ বছর আগের তার বিমান বাহিনির পাইলট ক্যাডেট জীবনে যখন একটা ফাইটার প্লেন নিয়ে সে বন্ধুদের একটা ঝুঁকিপুর্ণ ম্যান্যুভার করে বাহবা পেত হয়ত। সে হয়ত সেটা করেই তরুণী কো পাইলট পৃথুলাকে ইমপ্রেস করতে চেয়েছিল।  তার মনেই ছিল না যে পেছনে বসা ৭০ জন মানুষের জীবন তার হাতে। এই বিমানে শেষ কথা শোনা যায় অতি আতঙ্কিত ফার্স্ট অফিসার পৃথুলার কন্ঠে “স্যার স্যার....”

পৃথিবীতে বহু বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে মানব ভুল বা হিউম্যান এররের জন্য। এর একটা বড় কারণ ক্রুদের মানসিক চাপ ও ক্রিটিক্যাল সময়ে এক বা একাধিক ভুল সিদ্ধান্ত। এমনও বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে যে বাম দিকের ইঞ্জিনের ব্লেড ভেঙে গেছে কিন্তু পাইলটেরা ডানদিকের ভাল ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে, তার পর ক্রাশ করেছে। কিন্তু ইউ এস বাংলা বিএস ২১১ ফ্লাইটে তেমন কোন ক্রিটিক্র্যাল মুহুর্ত আসেনি। ছিল সব ঠিকঠাক একটা মামুলি ফ্লাইট। যতগুলো ভুল হয়েছে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সবগুলো ছিল সংশোধনযোগ্য শুধু একটি বিষয় ছাড়া – সেটি হল ক্যাপটেন আবিদ সুলতানের মন। 

প্রথমে আমরা দেখেছি তার অসম্ভব ক্ষুব্ধ আচরণ ও অত্যাধিক নেগেটিভ ইমোশোন তার কতৃপক্ষের প্রতি। তার শীতল ও নিয়ন্ত্রণমুলক আচরণ তার কো পাইলটের প্রতি যাকে সে কো পাইলট ভাবেনি, ছাত্রী, মুরিদ ভেবেছে। তারপর আমরা দেখেছি তার ব্যক্তিগত বিষয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ভেঙে পড়া এবং ল্যাক অব ইন্টার-পার্সোনাল বাউন্ডারি। অপর কলিগ/শিক্ষানবীশ নারী পাইলট সম্পর্কে তার অত্যন্ত কুরুচিপুর্ণ বক্তব্য যেটি আর একজন নারীর সামনে ও পেশাগত পরিবেশের চরম লঙ্ঘন। এর পর আমরা দেখেছি ককপিটে সিগারেট ধরানোর মত রেকলেস আচরণ। আমরা দেখেছি হোল্ড ক্যানসেল না করা। হেডিং মোডে বিমান চালানো অথচ বাতাসের বিচ্যুতি সংশোধন না করা। বহুবার যাওয়া একটা এয়ারপোর্টে রানওয়ে না পেলেও সেটা বুঝতে না পারা ও টাওয়ারের সহযোগীতা না চাওয়া। একবার যেখানে বিফোর ল্যান্ডিং চেকলিস্ট করা হয় সেখানে সেটা সম্পন্ন করা সত্বেও পাঁচবার সেটি করার জন্য বলা। অভিজ্ঞ ও বার বার যাওয়া পাইলটের রানওয়ে দেখতে না পাওয়া। দেখতে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলা। প্রচন্ড শব্দে সকল ওয়ার্নিং ও কল ইগনর করা। পরিশেষে রানওয়ে দেখতে পেলেও তার সাথে এলাইন না থাকার জন্য ল্যান্ডিং ক্যানসেল করে গো এরাউন্ড না করা। কাঠমুন্ডু টাওয়ার ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স ক্যানসেল করলেও জেট ফাইটারের মত বিমান চালিয়ে ল্যান্ডিং করার চেষ্টা করা। 

ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস ২১১ (ইউবিজি ২১১) বিমানের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কারণ এখন দাপ্তরিকভাবেও ক্যাপ্টেন আবিদের মন। কি ঘটছিল ক্যাপ্টেন আবিদের মনে যার ফলে একজন রেসপন্সিবল, মেথডিক্যাল দক্ষ পাইলটের এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী ডিসওরিয়েনটেশন (সে কোথায় আছে এই স্থানিক ধারনার বিলোপ), কমপ্লিট ল্যাক অব সেন্স অব রিয়্যালিটি (বাস্তবতাবোধ সম্পুর্নরূপে হারানো), ইমপেয়ার্ড কগনিটিভ ও এক্সিকিউটিভ ডিসফাংশন (চিন্তা ও ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনে অযোগ্যতা)। আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং মনোচকিৎসার যে সকল সর্বাধুনিক জ্ঞান, সেগুলো প্রয়োগ করে আসুন দেখা যাক কি হতে পারে। এটি গুরুত্বপুর্ণ এই কারণেই যে ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়াতে গেলে এই বিষয়ে আমাদের আলোকপাত করতে হবে যেটি শুধু বিমান চালনাতেই সীমাবদ্ধ নয়।    

দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া ক্যাপ্টেন আবিদকে কেন বিমান বাহিনীর বৈমানিকের চাকুরি ত্যাগ করতে হয়েছিল সেটা সম্পর্কে শুধু “ডিপ্রেশন” কথাটি ছাড়া আমরা আর কিছু জানি না। দুর্ঘটনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিশন সুপারিশ করেছে, স্বাস্থ্য বা মানসিক অবসাদের কারণে কোনো পাইলটকে দায়িত্ব পালনে বিরত রাখার ইতিহাস থেকে থাকলে তার লাইসেন্স নবায়নের আগে অবশ্যই স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

পত্র পত্রিকা থেকে ক্যাপ্টেন আবিদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় সেগুলো হলো ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ এক সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তার সাড়ে ৫ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল এবং তিনি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ চালিয়েছেন ১৭০০ ঘণ্টার বেশি। ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানকে ‘মাস্টার অব ল্যান্ডিং’ এবং একইসঙ্গে ল্যান্ডিং অ্যাপ্রোচে তার মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ পাইলটের বলে অভিহিত করেছেন তার প্রশিক্ষণ ক্লাসের শিক্ষার্থী সৌরভ আল জাহিদ। 

তার এক বন্ধু লিখেছেন যে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান তুখোড় ছাত্র ছিলেন। তিনি লেখেন, ‘আমরা একসাথে স্কুলে ভর্তি হই, একসাথে স্কুল পাস করি। তুখোড় ছাত্র ছিল ও। আশির দশক, তখন আমরা ফুটবল খেলতাম। আমি গোলকিপার হয়ে খেলতাম। সে যে কতবার ওর রংধনু শর্টে আমাকে পরাজিত করেছে। স্বজনরা জানায়, আবিদের বাবাও পাইলট ছিলেন। বাবার মতোই একজন দক্ষ পাইলট ছিলেন তিনি। ৩২ বছরের ক্যারিয়ারে কোনো প্রকার সম্পদের মালিক হননি। ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি।

ভাই খুরশিদ মাহমুদ বলেন ও খুব পারদর্শী ছিল ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’। ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কোর্সমেট ক্যাপ্টেন সিকদার মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘আবিদ ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য পাইলট। বিমানবাহিনীর একজন ফাইটার পাইলট হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৩৫ স্ক্রোয়াড্রনে ছিলেন তিনি। বিমানবাহিনীতে মিগ ২১ ও এফ ৭-ও চালিয়েছেন তিনি।

এ সকল তথ্য থেকে বোঝা যায় ক্যাপ্টেন আবিদ খুব ভাল ছাত্র ছিলেন, ভাল ফুটবল খেলতেন, অত্যন্ত দক্ষ পাইলট ছিলেন, ল্যান্ডিং অ্যাপ্রোচে পার্ফেকশনিস্ট ছিলেন, ছিলেন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ পারদর্শী। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাদের বলা হয় পার্ফেকশনিস্ট ও হাই পার্ফমার। আমাদের দেশে হাই পার্ফমার না হলে বিমান বাহিনীর পাইলট হওয়া সহজ নয় এবং পার্ফেকশনিস্ট ও হাই পার্ফমারদের আমাদের দেশে অত্যাধিক মুল্যায়িত করা হয় শুধুমাত্র তাদের পার্ফমেন্স দেখে। অথচ এই পার্ফেকশনিস্ট ও হাই পার্ফমারদের অনেক রকম চিন্তাগত ও মানসিক ঝুঁকি থাকতে পারে সেগুলো নিয়ে আমরা মোটেই অবগত নই। 

পাইলট, ডাক্তার, ইন্জিনিয়র, প্রশাসন এসব বিষয়ে পেশাজীবি হতে আমাদের দেশে এখন প্রতিযোগীতা প্রবল এবং এই সব প্রতিযোগীতায় যারা যত ভাল করে তারা তত ঝুঁকিপুর্ণ। উন্নত দেশগুলোতে এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জ্ঞান ও পেশাজীবিদের নিয়োগে সাইকোমেট্রিক পরীক্ষা এবং পেশাজীবিদের জন্য নিয়মিত সাইকোলজিক্যাল ইভ্যালুয়েশন আবশ্যিক করা হয়েছে অথচ আমার এসব বিষয়ে এখনও কোন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করি না।

ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান সম্পর্কে যতটুকু আমরা জেনেছি তাতে তার সায়ক্রয়াট্রিক ডায়াগনোসিস করা সম্ভব নয় এবং আমি সেটা করার অধিকার রাখি না, সেটা পেশাদার সায়ক্রাটিস্টদের কাজ। আমি শুধু এখানে তুলে ধরতে চাই কোন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ট্রেইটস (বৈশিষ্ট্যগুলো) ও সায়ক্রায়াট্রিক এপিসোড (সামায়িক অস্বাভাবিক আচরণ) এর সাথে বিএস ২১১ এর ককপিটে থাকা পাইলট ইন কম্যান্ডের আচরণ ও কার্যকলাপ মিলে যায়।

“অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (ওসিপিডি)”

পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সম্পর্কে অনেকেই সঠিকভাবে অবহিত নন তাই সেটা সংক্ষেপে বলে নিতে চাই। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার হল এমন একটি মানসিক সমস্যা যাতে একটা দীর্ঘস্থায়ী ছকে (প্যাটার্নে) বাধা থাকে ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ অনুভব ও আচরণ তথা চিন্তা, অনুভূতি, আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্ক ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। এই ছক সামাজ সাংস্কৃতিতে যে স্বাভাবিকতা বিদ্যমান, তার থেকে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এই ছক অপরিবর্তনীয় এবং যতটুকু না উপকারী তার চেয়ে বেশী অপকারী হয়ে থাকে। যত দিন যায় এই ছক তত স্থায়ী হয়। এটা ঐ ব্যক্তিকে ক্রমাগত আচরণ, কর্মফল ও সামাজিকতায় বিপর্যয় ও অকর্মণ্যতার দিকে নিয়ে যায়।

অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ওসিপিডি এমনই একটি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার যেখানে ব্যক্তির অন্তর্জগত হল প্রচন্ড রাগ, ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা, বিদ্রোহ, ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদে পরিপূর্ণ। অবচেতনে সে একটা বিদ্রোহী চরিত্র যে আসলে সবকিছু অবজ্ঞা করতে চায়, খেয়াল খুশি মত চলতে চায়। সে আসলে একজন সমাজবিরোধী (এন্টিসোশ্যাল) চরিত্র। সে যেহেতু অত্যন্ত অসুখী ও বিষাদগ্রস্থ, সমাজের নিয়ম কানুন, মানুষের প্রেম ভালবাসা আন্তরিকতা, মানুষের প্রাত্যাহিক ছোট ছোট আনন্দ, তার জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা এগুলো তার কাছে নিম্ন মানের ও চারিত্রিক দুর্বলতার প্রকাশ। সে এগুলো বোঝে না তাই সে এগুলো থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখে। 

অপর দিকে তার সবসময় মনে হয় তার যা করা উচিত সে তা করছে না। সে নিজে একটা ব্যর্থ চরিত্র। তাই সে যা করছে সেটা যে খুব ভাল করছে সেই নিশ্চয়তা সবসময় পেতে চায়। আচরণের দিক থেকে সে একজন নির্ভরশীল (ডিপেন্ডেন্ট) চরিত্রের যার একজন ঈশ্বরসম নেতৃত্ব দরকার যে তাকে গাইড করবে ও কিছু তার চেয়ে অনেক নিম্নমানের অনুসরণকারী (মিনিয়নস) দরকার যারা তাকে ঈশ্বরসম ভক্তি প্রসংশা করবে। 

নিজের এই সমাজবিরোধী বা এন্টিসোশ্যাল চরিত্র সম্পর্কে সে অবহিত। তাই সবসময় সে নিজেকে নিয়ম কানুন শৃঙ্খলা ও দায়িত্বের মধ্যে কঠোরভাবে আবদ্ধ রাখে। সে ভাবে এই নিয়ম কানুন ও শৃঙ্খলার বিচ্যুতি ঘটলে তার স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়বে ও সে যে কত ব্যর্থ সেটা সবাই জেনে যাবে। নিজের অন্তরের এই সংঘাতময় বিপরীতমুখী সমস্যা সমাধানে, তথা ভেতরে বিদ্ধংসী রেবেল এন্টিসোশ্যাল ও বাইরে ‘ভাল’ সাব্যস্ত হওয়া  নির্ভরশীল ডিপেন্ডেন্ট সে একটি পরস্পরবিরোধী কৌশল গ্রহণ করে। সেটা হলো সবার কাছে (এবং নিজের কাছেও) ভাল হবার জন্য ডোমিনেন্ট পক্ষ (বাবা, মা, শিক্ষক, বস) যা করতে বলে সেটাতে আচ্ছন্ন (অবসেসড) হয়ে যাওয়া এবং সেটা করতে অন্ধ তাড়না (কম্পালশন) অনুভব করা এবং নিরলস ভাবে সেটা করে যাওয়া।

এভাবই তৈরী হয় একজন ভাল ছাত্র, দক্ষ কর্মী যে ওয়ার্কহলিক, নিরলস কর্মী যে সব সময় কতৃপক্ষের বা ডোমিনেন্ট পক্ষের (বাবা, মা, শিক্ষক, বস) বাহবা পাওয়ার জন্যই শুধু বেঁচে থাকে ও নিরলস ভাবে খেটে যায়। কিন্তু যেহেতু এটা তাদের অন্তরের উৎসাহ থেকে আসে না, আসে অন্তরের রাগ, ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা, বিদ্রোহ, ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদকে ধামাচাপা দেবার প্রতিকর্ম হিসাবে, এটা করতে গিয়ে তার কোন সীমারেখা তারা বজায় রাখতে পারে না।

এর ফলে তার বাড়তে থাকে অবসাদ। তার যে নকল বাইরের শৃঙ্খলা ও আদর্শ জগত সেটা ভেঙে পড়তে পারে কোন একটা বড় চারিত্রিক আঘাতে। যে আঘাতে তার সার্বক্ষণিক চেষ্টায় গড়ে তোলা আদর্শ চরিত্র ভেঙে পড়াবে বলে সে সবসময় ভীত। সেই আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা ভাঙার আঘাতে সে চলে যেতে পারে ক্ষুব্ধ আগ্রাসী মানসিকতায়,  হতে পারে তার স্থানিক চিন্তার লোপ (ল্যাক অব স্পেশিয়াল কগনিশন), ওয়ার্কিং মেমোরির সীমাবদ্ধতা যা তৈরী করে পরিস্থিতিগত সচেতনতার অভাব ও হাতে থাকা কাজ বা টাস্ক ভুলে যাওয়া। এক্সিকিউটিভ ফাংশনালিটির ইমপেয়ারমেন্ট যার ফলে প্রসিডিউর না মানা, ইম্পালসিভিটি ও ঝুঁকি নেওয়া ও রিস্ক টেকিং বিহেভিয়র। এর সাথে ক্রমেই তার কমে আসতে পারে ভবিষ্যত চেতনা, যে তার বর্তমান কর্মকান্ডের ফল কি হতে পারে এটার বোধ ও আত্ম নিয়ন্ত্রণ। 

তার যে সাজানো জগত সেটা ভেঙে পড়তে পারে কখনই যখন সে প্রশংসা আশা করছে এমন কেউ যদি অকস্মাত তার খোলাখুলি দুর্নাম শুরু করে বা তাকে অবজ্ঞা করে, মন্দ কথা বলে। তখন সে চলে যেতে পারে অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার জনিত ডিসঅ্যাসোসিয়েটিভ এপিসোডের ভেতরে। যার ফলে তার তৈরী হতে পারে আত্ম সচেতনতা, আইডেন্টিটি, স্মৃতি ও স্থানিক সচেতনতার বিলোপের অবস্থায়।

পরবর্তী পর্বে ওসিপিডির ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞা, আচরণগত প্রকাশ, ডায়াগনোস্টিক ক্রায়টেরিয়া, ভেরিয়েশন ও কি কারণে শিশুকাল থেকে ব্যক্তি ওসিপিডির দিকে যেতে তাকে সেটা নিয়ে কথা বলব। ওসিপিডি হল আধুনিক সভ্যতার চারিত্রিক বিকার। ওসিপিডি ব্যক্তিরা হল সবচেয়ে দক্ষ প্রফেশনালস। আমাদের শিক্ষকেরা বেশিরভাগ ওসিপিডির লক্ষণযুক্ত বলে আমি মনে করি। ওসিপিডিতে আক্রান্তরা মধ্যম মানে গিয়ে থেমে যায় যেহেতু তাদের আভ্যন্তরীণ লক্ষ্য জ্ঞান, প্রকৃতি সম্পর্কে উৎসাহ, উদ্ভাবন তথা অন্তরের উৎসাহ নয়। তাদের কোর ড্রাইভ হল কাউকে না কাউকে তুষ্ট করা। ওসিপিডি ব্যক্তিদের চেনার সবচেয়ে দৃশ্যমান লক্ষণ হল তারা ডোমিনেন্ট ফিগারদের প্রতি নতজানু এবং অধিনস্তদের উপর দমনমূলক ও আগ্রাসী।