ধরুন আপনি বিজ্ঞানে খুব ভাল ছাত্র। শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন সবসময়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন, পিএইচডি করেছেন। এর পর আপনাকে প্রচুর বেতনে একটা জব অফার দেওয়া হল একটি আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসাবে যেখানে আপনার কাজ হবে শিশুদের ধর্মীয় মতবাদে শিক্ষিত করা। কাজটি কি আপনি নেবেন? কাজটি নেওয়া কি নৈতিকভাবে ঠিক? এই কাজটি নিলে কি কোনভাবে আপনি নিজের অতীত শিক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হবে না? কাজটি নিলে কি আপনি আপনার ভবিষ্যত কর্মের সাথে বেঈমানী করতে পারেন? এবার বিসিএসে নাকি সফলদের বেশিরভাগ প্রকৌশলী ও ডাক্তার - পুলিশ হলে তারা কি করবেন?
ইংরেজিতে যাকে করাপশন বলা হয় যার অর্থ দুর্নীতি এবং যার প্রতিশব্দ অনেস্টি বা সততা। আমাদের সমাজে অনেস্টি শব্দটি যত বহুল ব্যবহৃত ইনটিগ্রিটি শুদ্ধাচারিতা শব্দটি সেই তুলনায় একেবারেই ব্যবহৃত নয়। ইংরেজি ইনটিগ্রিটি শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ হল ১) চারিত্রিক সরলতা ও সততা; অখন্ডতা; অভেদ্যতা; শুদ্ধতা; সাধুতা; সত্যশীলতা এবং ২) সম্পূর্ণতা; অখন্ডতা।
অনেস্টি ও ইনটিগ্রিটির মধ্যে তাহলে তফাৎ কি? অনেস্টি বা সততা হল চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, শঠতা না করা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলী থাকা সেগুলো আচরণ কেন্দ্রিক। অপরদিকে ইনটিগ্রিটির অর্থও চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, শঠতা না করা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলী থাকা কিন্তু সেগুলো শুধু আচরণ কেন্দ্রিক না হয়ে যখন হয় অন্তর্গত অখন্ড ও শুদ্ধতা থেকে আসা। একজন অনেস্ট বা সৎ মানুষ প্রচলিত মূল্যবোধের ভিত্তিতেই শুধু সৎ। প্রচলিত মূল্যবোধের বাইরের বা নতুন বিষয়ে সে দায় নেয় না। কিন্তু ইন্টিগ্রিটি থাকা একজন মানুষ প্রচলিত মূল্যবোধের বাইরের বা নতুন বিষয়ে নিজের অন্তর্গত বিচারবোধ থেকে অখন্ড ও শুুদ্ধ। উপরের যে ভাল ছাত্রটির কথা বলা হল তিনি খুবই সৎ মানুষ হতে পারেন কিন্তু তার ইনটিগ্রিটি বা শুদ্ধতা নাই।
যারা প্রতিষ্ঠান প্রধান যেমন এমডি বা সিইও তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি? তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মানুষ চেনা। এবং তার মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হল ইন্টারভিউ নেওয়া। অনেকেই মনে করে বড় ডিগ্রি বা ভারী অভিজ্ঞতার তালিকা থাকা প্রার্থিদের ইন্টারভিউতে বাছাই করা ভাল। কিন্তু সফল প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা লোকজন সবসময় বলে ব্যক্তিটি শুদ্ধ কিনা সেটা দেখা প্রথম কাজ। এই শুদ্ধতা শুধু আর্থিক সততা নয়, এটা সে কথা ও কাজে সে এক কিনা, অর্থাৎ তার চারিত্রিক শুদ্ধতা বা ইনটিগ্রিটি সবার আগে। বিল গেটস বলেছেন খুব মেধাবী কিন্তু ইনটিগ্রিটি নাই এমন লোকের মেধা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে কাজ করতে পারে।
ইলন মাস্ক দুবাইতে ওয়ার্লড লিডার সামিটে বলছে যে ব্যক্তি নিজের জীবনের জটিল কোন সমস্যা সমাধান করেছে তাকে চেনা ও বাছাই করা দরকার। যে ব্যক্তি নিজ জীবনে কোন জটিল সমস্যার সমাধান করেছে সে প্রতিষ্ঠানেরও জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সে আসলেও জটিল সমস্যার সমাধান করেছে কিনা এটা বুঝতে ইলন মাস্ক ইন্টারভিউতে প্রার্থির জীবন সম্পর্কে জানতে চায়। খুটিনাটি প্রশ্ন করলে জানা যায় সে সত্যই সেই সমস্যার সমাধান করেছে কিনা। যারা সত্যিই কোন সমস্যার সমাধান করে তারা সেটার খুঁটিনাটি জানবে ও বলতে পারবে। মাস্ক বলেছে একসময় সে ভাবত যে দক্ষতাই আসল। কিন্তু পরবর্তিতে সে বলেছে যে আগ্রহ, কমিটমেন্ট ও ইনটিগ্রিটি আসল।
জার্মানীতে একটা সেমিনারে গিয়ে শিখলাম জার্মানিতে স্কলার ও ইন্টেলেকচুয়াল এই দুটো শ্রেণীর মানুষদের সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখা হয়। অথচ আমরা এই দুটোতো ঘোঁট পাকিয়ে বুদ্ধিজীবি নাম দিয়েছি।
স্কলার তাদেরকেই বলা হয়:
১. যারা একাডেমিক সাধনার উপর ফোকাস করেন এবং উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা এবং অবদানে জড়িত থাকেন।
২. যাদের সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনে দক্ষতা থাকে এবং নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার মধ্যে গভীর এবং বিশেষ জ্ঞান থাকে। তারা প্রায়শই গবেষণা, প্রকাশনা এবং একাডেমিক বক্তৃতার মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তারে অবদান রাখেন।
৩. যাদের সাধারণত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে এবং যারা স্নাতকোত্তর বা ডক্টরেট ডিগ্রির মতো উন্নত ডিগ্রি অর্জন করে থাকন এবং যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং একাডেমিক পদ্ধতি মেনে চলার উপর জোর দিয়ে থাকেন।
৪. যারা সাধারণত কঠোরভাবে পদ্ধতি অনুসরণ করে বৃত্তি, গবেষণা পদ্ধতির কঠোর আনুগত্য, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, এবং একাডেমিক সম্প্রদায়ের মান ও অনুশীলনের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করে চলেন।
৫. যারা অনেক সময়ই কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে কর্তৃপক্ষ হয়ে ওঠেন। তাদের কাজ প্রায়শঃই একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং সেমিনারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
অপরদিকে ইন্টেলেকচুয়াল হলেন:
১. এমন একজন ব্যক্তি যার জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে। ইন্টেলেকচুয়ালরা প্রায়শই জগত সম্পর্কে একটি কৌতূহল, শেখার আকাঙ্ক্ষা এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা (ডিসিপ্লিন) জুড়ে সংযোগ করার ক্ষমতা রাখেন।
২. তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানগত চিন্তা প্রতিফলনের ক্ষমতা থাকে। তারা চিন্তার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে এবং প্রায়শই একাডেমিক শৃঙ্খলার সীমার বাইরে ধারনা যুক্ত করেও চিন্তা ভাবনা ও সমস্যার সমাধান করতে পারে।
৩. ইন্টেলেকচুয়ালদের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। তাদের থাকে স্বয়ংক্রিয়তাবাদ (অটোডিডাকটিজম) বা স্ব-নির্দেশিত শিক্ষা। ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে থাকে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যেটা হল তারা ঐতিহ্যগত বা প্রতিষ্ঠিত একাডেমিক সেটিংসের বাইরে নিজেদের শিক্ষিত করতে পারেন।
৪. ইন্টেলেকচুয়ালরা প্রায়শই সামাজিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা ও তার সমাধানে জড়িত থাকে এবং পাবলিক ডিসকোর্সে অবদান রাখেন। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য করার জন্য বিভিন্ন ডিসিপ্লিন সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও জ্ঞান প্রয়োগ করে থাকেন।
৫. ইন্টেলেকচুয়ালরা জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য জ্ঞানের বিভিন্ন ডিসিপ্লিন এবং নানা তত্ত্ব সংযুক্ত করে একটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তারা শুধুমাত্র একটি বিশেষ এলাকায় ফোকাস করার পরিবর্তে বিভিন্ন ডোমেন থেকে জ্ঞান একত্রিত করতে চান।
শুধু জার্মানীতে নয়, পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে আধুনিক জ্ঞানের সুতিকাগার ইউরোপে এই বিভাজনটা প্রকট। জার্মানীর মত টেকনিক্যাল সোসাইটিতে ইন্টেলেকচুয়ালদের থেকে স্কলারদের বেশি সম্মান দেওয়া হয় আবার বনেদি জ্ঞানের সমাজগুলোতে ইন্টেলেকচুয়ালদের বেশি সম্মান দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হল আমরা কেন এই বিভাজনটা অনুভব করিনি? এর কারণ মনে হয় আমাদের অর্থলোলুপ দাস সংস্কৃতি এবং প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যক্তিকে ঘায়েল করার আত্মঘাতি চরিত্র। স্কলার ও ইন্টেলেকচুয়াল এই দুটো শ্রেণীকে নির্দেশ করতে আমরা বুদ্ধিজীবি শব্দটি ব্যবহার করি জীবিকাকে এর সাথে যুক্ত করে। ভাবখানা এমন যে যত বড় প্রতিষ্ঠানে যত বেশী জীবিকা যিনি আয় করেন, তিনি তত বড় জ্ঞানী।
ইন্টিগ্রিটি ও অনেস্টি আলাদা না করা অথবা স্কলার ও ইন্টেলেকচুয়াল আলাদা না করা শোষক শ্রেণীর কাছে নতজানু স্কলারদের কুটচাল ও ষড়যন্ত্র। এর সাথে আছে ইন্টেলেকচুয়ালদের গভীরতায় না যাবার আলস্য। আমাদের সংস্কৃতিতে ইন্টিগ্রিটির অভাব যে গভীরে প্রেথিত ভাষা যেন তার সিলমোহর বহন করে চলছে সততা বা বুদ্ধিজীবির মত ডিসটোপিক টার্ম ব্যবহার করে যাতে প্রকৃত কুচরিত্রদের চেনা না যায়।
© সিরাজুল হোসেন, ২০২৫