ইন্টারভিউ দিতে যখন মেয়েরা আসে তখন তাদের যে মেয়েলি আবেদন বা ফেমিনিন অ্যাপিল সেটা আমাদের নজর এড়ায় না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসাবে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বটা ঘাড়ের উপর থাকলে পরিশেষে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যটাই নির্নায়ক হয়ে ওঠে।
কখনও কখনও ফেমিনিন অ্যাপিলে আকর্ষিত না হয়ে এর উল্টোটাও ঘটে। একবার এমন এক ইন্টারভিউতে নানা পরীক্ষার পর দুজন মেয়ে বাছাই হল যাদের মধ্যে একজনকে নিয়োগ করা হবে। একজন অসম্ভব সুন্দরী আর একজন সাধারণ। ফাইনাল ভাইভা যখন নেওয়া হল ছোট একটি মিটিং রুমে, দেখতে সাধারণ মেয়েটি ঢোকার সাথে সাথে একটি অস্বস্তিকর দেহের গন্ধ ভরে গেল পুরো ঘরটায়। যদিও এটি তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন প্রভাব ফেলল না। কাজের জন্য তাকেই অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত মনে হল।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে দেহের গন্ধ এবং ফেরোমন (দেহ থেকে নির্গত বাতাস বাহিত হয়ে যাওয়া একপ্রকার জৈব রসায়ন যা অন্য ব্যক্তির হরমোন নিঃসরন বা আবেগে প্রভাব ফেলে) আমাদের সামাজিক সংযোগে প্রভাব ফেলে সবচেয়ে বেশী। ফেরোমন হল একটি রাসায়নিক সংকেত যেটার মাধ্যমে দেহ দেহের সাথে কথা বলে, আত্মীয়তা খুঁজে বের করে। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে আমরা যাদের নিকট বন্ধু করি তাদের সাথে আমাদের জিনগত মিল থাকে। এই জিনগত মিল খুঁজে বের করার জন্য আরটি পিসিআর টেস্টের মত জেনম সিকোয়েন্স মেলাতে পারা উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি দরকার।
আমাদের দেহে ঘন লোম আছে যে সব স্থানে সেই সব স্থান থেকে নির্গত ফেরোমন অণুগুলো যে বাতাসে ছড়াচ্ছে, সেগুলো অন্য দেহ গ্রহণ করে সেই জিনগত মিল খুঁজে পায়। এই কারণেই অচেনা কোন কোন মানুষ দেখলেই অনেক সময় মনে হয় তারা কত আপন, মনে হয় যেন কত দিনের চেনা। অথবা কোন কারণ ছাড়াই তাদের পাশে বসে থাকতে ইচ্ছা হয়, মনে হয় এভাবেই আজীবন কেটে যাক।
এর বিপরীতটাও ঘটে। দেখতে সুন্দরী হলেও কোন কারণ ছাড়াই হয়ত কাউকে ভাল লাগে না। অথবা অযথা কারও সব কিছুই বেসুরো লাগে, অল্পতেই কারও উপর মেজাজ খারাপ হয়। এটাও ফেরোমন সংকেতের কারণে হরমোনের হযবরল ঘটার কারণে হতে পারে।
এখন থেকে হাজার দশেক বছর আগে মানুষ পোশাক পরত খুব কম। তারা দাঁত মাজত না, নিয়মিত গোসল করতে না, সাবান বা প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করত না। ফেরোমন সহ দেহ থেকে নিঃসৃত অর্গ্যানিক বা জৈব অণুরা তাই প্রতিটি ব্যক্তির জিন ও দেহ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সম্প্রচার করতে পারত বিনা বাধায়। অনেকটা আমার ড্রোনটি আকাশে ওড়ার সময় যেমন এডিএস-বি (Automatic Dependent Surveillance–Broadcast (ADS–B) বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে নিজের গতি, অবস্থান, দিক এইসব সংকেত প্রদান করতে থাকে চারিদিকে।
কাছাকাছি থাকা অন্য উড়ন্ত বস্তু (যেমন কোন বিমান) সেই সংকেত ধরতে পারে এবং বুঝতে পেরে এড়িয়ে চলতে পারে সংঘর্ষ এড়াবার জন্য। ফেরোমন সহ আমাদের দেহ থেকে নিঃসৃত জৈব অণুগুলো ওই এডিএস-বি এর মত সংকেত ছড়াতে থাকে যাতে যার সাথে ব্যাপক জিনগত অসমতা আমরা যেন তাদের এড়িয়ে চলি অথবা সমতা থাকলে প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণ অনুভব করি।
মানুষ যখন পোশাক পরত খুব কম তখন নারী পুরুষের মিলন, বিয়ে শাদি বা সন্তান জন্ম দিতে এই ফেরোমনই অবদান রাখত সবচেয়ে বেশী। নারী পুরুষের মিলন তখন প্রধানতঃ নৈকট্যের আনন্দবোধ, যৌন আকর্ষণ ও যৌন উত্তেজনা নির্ভরই ছিল। তখন যেহেতু মানুষের ব্যক্তিগত জমি বলতে কিছু ছিল না তাই পিতার সম্পত্তি পুত্রের পাবার মত কোন বিষয়ও ছিল না। সেই কারণে সন্তান জন্ম দেবার বিষয়ে সামাজিক বিধিনিষেধ ততটা প্রকট ছিল না। জুটি বাঁধা বা বিয়ে ছিল অবৈষয়িক, ছিল নিতান্তই বন্ধুত্ব ও আনন্দের বিষয়।
কিন্ত মানুষ কৃষি সভ্যতায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে জমির ব্যক্তি মালিকানা যখন প্রতিষ্ঠিত হল তখন থেকে পুরুষ অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠল সঙ্গী নারীর পেটে যে শিশুটি তার বাবা যে সে নিজে এই নিশ্চয়তা পেতে। তখন থেকে বিয়ে হয়ে উঠল প্রধানতঃ সম্পত্তি রক্ষা এবং সেটা নিজ ঔরসজাত বংশধরদের হাতে তুলে দেবার একটি সামাজিক আইনগত প্রক্রিয়ায়। এর সাথে তখন থেকে মানুষ শিখল কৃষি পণ্য মজুদ করা, ব্যবসা বানিজ্য করা।
তখন থেকেই ব্যবসা নির্ভর নানা জাতী একত্রে মিশে নগরগুলো গড়ে তুলেছে এবং জিনগতভাবে অনেক ভিন্ন নানা ধরণের মানুষ একত্র বাস করা শুরু করেছে। তখন থেকে বিয়ে প্রধানত হয়ে উঠেছিল একটি সামাজিক ব্যবসায়িক ঘটনা - ব্যক্তির আকর্ষণ, আবেগ, হরমোন, ভাল লাগা এগুলো হয়ে গিয়েছিল গৌণ বিষয়। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল একটা অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও আইনগতভাবে সম্পদ রক্ষার বিষয়।
তাহলে বিয়ে যদি হয় অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার জন্য, যেখানে অভিভাবকেরা প্রধানত পাত্র পাত্রী নির্বাচন করে এসেছে অথবা দুর থেকে ক্ষণিক দেখে পাত্র পাত্রী সেটায় সায় দিয়েছে তাহলে বিয়ের পর যাতে সংঘর্ষ না ঘটে সেই ফেরোমন নির্ভর এডিএস-বি এন্টি কলিশন সিস্টেমের কি হবে? আমাদের সেই বিবর্তনগত রক্ষাকবজ বা দেহের গন্ধ এবং ফেরোমন নির্ভর যে ভাল লাগা মন্দ লাগা সেটার কি হবে? যদি কনের গায়ের গন্ধে বরের দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা জাগে বা বরের ফেরোমন কনের মেজাজ দেয় সবকিছুতেই বিগড়ে?
এই সমস্যার যুগান্তকারী সমাধান হল কাঁচা হলুদ। যেটা পিষ্ট করে গায়ে মাখলে তখন চাপা পড়ে যায় ফেরোমন। গায়ে হলুদের গন্ধ টিকে থাকে পুরো এক মাস, ততদিনে কাগজ পত্র পাকাপাকি এবং ফেরোমন ছাড়াই যান্ত্রিক সহবাস সমাপ্ত। এর পর আর কিসের ফেরোমন আর কিসের অপছন্দ – তখন বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।কাঁচা হলুদ ও ফেরোমন