এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই যে উপমহাদেশে ও বাংলাদেশে যে ইসলামী শিক্ষা প্রচলিত এবং সেই শিক্ষা অনুসরণ করে যে ধর্মপ্রচার হয় সেগুলোর সিংহভাগ হাদিস নির্ভর। কোন রেফারেন্স ছাড়া কোরআনের একটি আয়াত নিয়ে নিজে থেকে ব্যাখ্যা দিতে বললে সেটা সঠিকভাবে তুলে ধরার মত ব্যক্তি একেবারেই আমরা দেখি না।
জানলে অনেকেই অবাক হবেন যে হাদিস, যদি আমরা সহিহ হাদিসও ধরি, সেগুলোর মধ্যে ছয়টি সংকলন (কিতাবুস সিত্তাহ) গৃহিত। এই ছয়টি হাদিস গ্রন্থ সংকলিত করেছেন ছয় ব্যক্তি যারা বাস করছেন মক্কা থেকে দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দুরে দুরে। এবং তাঁরা তাঁদের হাদিস সংকলনগুলো প্রকাশ করেছেন কোরআন প্রণয়নের প্রায় ২০০ বছর পর। আমার মনে প্রশ্ন একজন মানুষ মারা যাবার পর তাঁর কথা ও জীবনাচারণ প্রকাশ করতে ২০০ বছর লাগল কেন? এবং সেটি কোন সৌদি বা আরবের হাতে না হয়ে ইরান, উজবেকস্থান, তুর্কেমনিস্তান এমনকি আফগানিস্তানের মানুষদের করতে হল কেন? যে সব দেশে প্রথম কোরআন অনুবাদিত হয়েছে হাদিস প্রকাশের আরো ১০০ বছর পর? ফার্সীত প্রথম কোরআন অনুবাদিত হয় দশম শতকে।
একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম গত সপ্তাহে যার প্রতিক্রিয়ায় নীচ মানসিকতা প্রদর্শন করায় অনেককে ব্লক করতে হয়েছে। অনেকে বেয়াদবি করেছে এবং কটু কথা শুনেছে। যে কোন আলোচনায় সমালোচনা ও প্রতি আলোচনা স্বাগতম। কিন্তু মন্দ কথা বলে নীচ মানসিকতা প্রদর্শন, ব্যক্তি আক্রমণ, লেখককে ছোট করে বেয়াদবি পাবলিক ডিসকোর্সে গ্রহনযোগ্য নয়। এধরণের আলোচনায় বেশ কিছু মানুষ রেফারেন্স জানতে চায়। তারা জানে না ওপিনিয়নের তো রেফারেন্স হয় না। আমি বললাম “আপনি উলঙ্গ হয়ে বের হয়ে এসেছেন, লজ্জা ঢাকুন”, এই কথার রেফারেন্স না চেয়ে নিজের পোশাক আছে কিনা সেটা পরিক্ষা করা বেশি প্রয়োজন। প্রথমে সেই স্ট্যাটাসটা আবার একবার দেখে নেওয়া যাক:
“ইহুদীদের তোরাহ সাধারণ ইহুদীদের পড়া নিষেধ ছিল। তেমনই কোরআন একসময় সাধারণ মুসলমানদের পড়ার জন্য ছিল না। কোরবান অনুবাদও বহুদিন নিষেধ ছিল। সেটাই ছিল সালাত যেখানে ধর্মজ্ঞান ও নীতিজ্ঞানে বিজ্ঞজন কোরআনের শিক্ষাকে বর্তমান সমাজের জীবনযাপন সাপেক্ষে মানুষের সামনে তুলে ধরবেন এবং মানুষ সেটা নিজের জীবনে পালন করলে সালাত আদায় পূর্ণ হবে। সেটা বাদ দিয়ে কিছু সুরা মুখস্ত করে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত প্রচন্ড জোরে মাইক বাজিয়ে ডাক দিয়ে নামাজ নামের এক অদ্ভুত রছম (রিচ্যুয়াল) আমরা পালন করা শিখেছি যেটা কোরআনে কোথাও নেই।”
অনেকে আবার রেফারেন্স চান ভিন্ন কারণে। সেটা হল স্ট্যাটাসের বক্তব্য যে সত্য সেটা তারা জানেন, জেনেও সেটাকে তারা মূল্যহীন করতে চান। সেটা করার পথ হল আলোচনাটিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে লেখককে অবমূল্যায়িত করা। এটা করতে গিয়ে তারা দুটো অপতর্ক বা ফ্যালাসি অনুসরণ করে। একটি হল অ্যাড হোমিনিম ফ্যালাসি, যার মাধ্যমে তারা লেখার বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত ক্ষুঁত বিচারের দিকে আলোচনাটিকে নিয়ে যায়। অপর অপতর্ক বা ফ্যালাসিটি হল স্ট্রম্যান ফ্যালাসি। যেখানে তর্কে লেখক যা বলেন নাই, তেমন একটি একটি কল্পিত বিষয় তৈরি করে সেটাকে ভুল প্রমাণ করা।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের মোদাব্বের মিয়ার ছেলে আক্কাস গ্রামে স্কুল তৈরি করতে চায় যেটা ধর্ম ক্ষমতার মজিদের অপছন্দ। গ্রামে মক্তব থাকার পরও স্কুল বানানোর চিন্তা মজিদকে ভীত করে তোলে। মজিদ তখন বিষয়টা নিয়ে শালিস বসায়। আক্কাস প্রস্তুত ছিল স্কুল কেন প্রয়োজন সেই বিতর্কে তথ্য প্রমাণের জন্য। কিন্তু শালিস শুরু হবার শুরুতেই মজিদ আক্কাসকে প্রশ্ন করে "তোমার দাড়ি কই মিয়া?" মক্তব থাকলেও স্কুলের প্রয়োজন আছে কিনা এই বিতর্ককে যদি দাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে সমাজে অনিষ্টকারীদের বিজয় নিশ্চিত। ১৯৪৮ সালে রচিত কাহিনীতে বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ের ভিলেজ পলিটিক্সে যে ফ্যালাসি প্রচলিত ছিল, ২০২৪ সালের এআই যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেই একই ফ্যালাসি প্রয়োগ করে অপশিক্ষা ও অপধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যত মানুষ।
আমাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। ইতিহাস প্রমাণ করে গণতন্ত্র ধ্বংস হয় সমাজ থেকে নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস উঠে গেলে। চুড়ান্ত ও নগ্ন পুঁজিবাদ যখন অর্থনৈতিক মন্দায় পতিত হয়, তখনই সমাজ থেকে নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস উঠে যায়। তখন শিকড় গেড়ে বসে এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় দমন নিপীড়ণের একনায়ক রেজিম। এমন উদাহরণ দুনিয়ার অনেক সমাজে আছে। কিন্তু আমাদের পুঁজিবাদতো চুড়ান্ত পর্যায়ে যায় নাই। তেমন অর্থনৈতিক মন্দাতেও আমরা পড়িনি। তাহলে আমাদের সমাজ থেকে নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে কেন? সমাজে নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস বজায় রাখে মানুষের ধর্মাচিন্তা এবং নীতিবোধ। আমাদের পুঁজিবাদ যখন চুড়ান্ত পর্যায়ে যায় নাই এবং অর্থনৈতিক মন্দাও যখন ততটা প্রকট নয় তাহলে সমাজে নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস উঠে যাবার জন্য নিশ্চই ধর্মাচিন্তা এবং নীতিবোধের শিক্ষায় বড় ধরনের কোন সমস্যা আছে।
যে কোন ধর্মে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে শিক্ষা আলাদাভাবে থাকে। একটি হল বিশ্বদর্শন - যেটি হল কিভাবে এই বিশ্ব তৈরি হয়েছে এবং সেটা কিভাবে চলছে ও মানুষ কিভাবে সৃষ্টি হল সেগুলো। এর পর থাকে মানুষকে কিভাবে এই সমাজে বাস করতে হবে অর্থাত সামাজিক নিয়ম নীতি সম্পর্কে। তার পর থাকে মৃত্যুর পর কি হবে। এই তিনটি বিষয়ের সাথে থাকে ইশ্বরের বর্ণনা ও তাকে ও তার প্রতিনীধিদের মান্য করার বিষয়টি। থাকে ধর্মে নিষিদ্ধ কি সেই বিষয়ে এবং সেই সব নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করলে ইহকালে কি ক্ষতি হবে ও পরকালে কি শাস্তি হবে সেই বিয়য়ে।
কিন্তু ধর্ম যখন থেকে রাজ্য শাসনের একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে তখন থেকে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা কোনটা অবজ্ঞা করলে ইহকালে কি ক্ষতি হবে ও পরকালে কি শাস্তি হবে সেগুলোও রাজ্য শাসনের যে আইনি ব্যাখ্যা বা জুরিসপ্রুডেন্স, তার অংশ হয়ে গেছে। অনেক ইসলামী রাষ্ট্রের এই জুরিসপ্রুডেন্সই হল শরীয়া আইন। এই বিষয়ে আর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম একই সময়ে:
“ইসলাম ধর্ম ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মের সাথে একই ঈশ্বর ও একই বিশ্ববিক্ষা শেয়ার করে। ইসলাম ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মে সৃষ্টিতত্ব, আদর্শ ও পরিণতি বা পরকালের ধারণা ও হারাম হালালের ধারণা একই। ইসলাম ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মে পরস্পর বিরোধের শুরু হয় অনেক পরে এবং বিচ্ছিন্ন নতুন চিন্তার সাথে যেমন ইহুদি ধর্ম ও জাতি এক ও অবিচ্ছেদ্য হবার ফলে যে স্বার্থের সংঘাত ও বিদ্বেষ। খ্রীস্টানদের মধ্যে বিভিন্ন ভাগ হওয়া, নিউ টেস্টামেন্টের প্রকাশ এবং যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র মানার পর শুরু হওয়া বিপত্তি।
কিন্তু পরিবর্তীতে যতই বিভেদ হোক না কেন ইসলাম ধর্ম ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মের সাথে যে একই ঈশ্বর ও একই বিশ্ববিক্ষা ও পরিণতি শেয়ার করে সেটা এখনও বিদ্যমান। ইসলামেও কোরআন অনুসরন করলে ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্মের সাথে বিরোধ ও সংঘাত তেমন একটা নেই গুটিকয়েক বিষয় ছাড়া। সমস্যা শুরু করে হাদিস নামে প্রচারিত হাজার হাজার মিথ্যা বয়ান, বক্তব্য ও ব্যাখ্যা।
এই কারণে বুঝে কোরআন পড়া ও সেই লক্ষ্যে ইসলাম চর্চা প্রয়োজন যারা ধর্মচর্চা করতে চান বা প্রকৃত ধার্মিক হতে চান। কিন্তু সমস্যা হল কোরআন অনেক সময়ই খুব একটা বোধগম্য নয় এবং অনেক কিছু সেখানে বিস্তারিত নেই। এর ফলে সঠিক কনটেক্সট না বুঝে সেটা পড়লে বিভ্রান্ত হতে হয়। সেই কনটেক্সট পেতে হলে আপনাকে সেই আমলের প্রচলিত আইন ও মূল্যবোধগুলো বুঝতে হবে। সেগুলো পেতে হলে আপনাকে প্রথমে তোরাহ বা ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়তে হবে। এরপর পড়তে হবে তালমুদ এবং নিউ টেস্টামেন্ট যেগুলো থেকে ঐ সময়ের অনেক কনটেক্সট পরিষ্কার হবে।
বিষয়টা অনেকটা এরকম যে ভিনগ্রহের কেউ যদি বাংলাদেশের আইন কানুনগুলো দেখে তখন দেখবে যে সেখানে অনেক ভাল ভাল সব আইন আছে। কিন্তু সেগুলোর কোন কনটেক্সট বা গবেষণা বা কেন কোন আইন সে সেটা খুঁজে পাবে না। এর কারণ বাংলাদেশে আইনগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে বৃটিশ আইন, ভারতীয় আইন ও পাকিস্তানী আইনর উপর ক্রমান্বয়ে নির্ভর করে। এখন বাংলাদেশের আইনের কনটেক্সট বুঝতে গেলে আপনাকে বৃটিশ আইন, ভারতীয় আইন বা পাকিস্তানী আইন পড়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে যারা ধর্মচর্চা ও ধর্মরক্ষার ভার নিয়েছেন তারা এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ধার ধারেন না। তারা চট করে হাদিসে ভর করেন যেগুলো বেশিরভাগ ভুয়া। দুনিয়াতে অনেক দেশে অনেক বিজ্ঞজনের অনেক বই আছে যেখানে ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সব দেশে ধর্ম একটি সৎ ও আদর্শ সমাজ তৈরীতে অবদান রেখেছে। অপরদিকে আমাদের দেশে ধর্মচর্চা পচে যাওয়াতে সেই পচন সর্বত্র ছুঁয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আচরনও দুর্গন্ধযুক্ত করছে।”
বাংলাদেশে ইসলাম শিক্ষা যেভাবে চলছে এবং যেভাবে ধর্ম প্রচার হচ্ছে সেটা হাদিস নির্ভর। এইসব হাদিস আবার বেশিরভাগ তৈরি হয়েছে ৭০০ থেকে ৯০০ সালের মধ্য এশীয় দেশগুলোর আইন ও জুরিসপ্রুডেন্স নির্ভর করে। সেইসব জুরিসপ্রুডেন্স আবার অনেকটাই এসেছে ইহুদি খ্রীস্টান অর্থাৎ ওল্ড চেস্টামেন্টের যে বিধি নিষেধগুলো থেকে। অবৈধ যৌনতা বা জেনাকারী নারীদের পাথর ছুঁড়ে হত্যার কথা হাদিসে আছে কিন্তু কোরআনে নেই কিন্তু আবার ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে।
পরের পর্ব: ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -২