ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -৪

তালমুদের গেমারা

জন্ম থেকেই রোজার দিনে সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে সুন্দর সুরালো কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনে। ২০১৯ সালে আম্মা নানা রকম অসুস্থতায় ভুগে মারা যাবার আগে যতদিন সুস্থ ছিলেন, রোজার দিনে ভোর থেকেই কোরআন পড়তেন খতম দেবার জন্য। বুদ্ধি হলে প্রশ্ন করেছি আপনি যেটা পড়ছেন সেগুলোর অর্থ বোঝেন কিনা? উনি বলেছেন না। অথচ আশি উত্তর বয়সেও তিনি ছিলেন একজন কনসার্ন ব্যক্তি। প্রতিদিন কবরের কাগজ পড়তেন। টেলিভিশনে খবর দেখতেন। আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও মতামত দিতেন। আমার মাকে কখনও গান গাইতে শুনিনি। কোরআনই ছিল তাঁর কন্ঠের একমাত্র সূরেলো প্রকাশ। কোরবান কেন এই বিশেষ সুরেলো ভঙ্গিতে পড়া হয়? ঐতিহাসিকেরা বলেন ইসলামপূর্ব আরবে মক্কায় কাবাঘরের সামনে এক নারী কবিয়াল এভাবে সূর করে নৈতিক কবিতা পড়ত। তরুণ মুহম্মদ সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতেন।

সেই সব ইতিহাস আর একদিন হবে। আজকের আলোচনা হল আমাদের ইসলাম বিপথে যাওয়া নিয়ে। কোরআনের এই সূর করে পড়ার বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ নবী মুহম্মদ তার অল্প বয়সেই দেখেছেন যে বাইবেলের পুরোনো নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) লিখিত হয়েছে, পরবর্তিতে পুরোনো নিয়মের বহু ব্যাত্যয় ঘটিয়ে লিখা হয়েছে নতুন নিয়ম (নিউ টেস্টামেন্ট) যেখানে একেশ্বরবাদের মৌলিক নীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। তিনি দেখেছেন যখন নৈতিক ও আদর্শগত শিক্ষার জন্য কোন কিছু লেখা হয়, লেখাটাকে শুদ্ধ ও নির্দিষ্ট করার জন্য সেটা থেকে অলঙ্করণ বাদ দেওয়া হয়। তার পর যখন সেগুলো পড়া হয়, মানুষ সেটাকে নিজ স্বার্থে পরিবর্তিত করে বুঝতে পারে। এর অর্থ হল তিনি ধরতে পেরেছিলেন যে লেখাকে শুদ্ধ করতে সেখান থেকে আবেগ ও মানবিক অংশ বাদ দিতে হয়। কোন মানব যখন আবার সেটা পড়ে তখন সেটি পাঠকের মনোভাবে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এই কারনে ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলো তাদের ধর্মগুরু বা রেবাই ছাড়া পড়া নিষেধ ছিল।

মুহম্মদ তাই নিষেধ করেছিলেন কোরআন যে নির্দিষ্টভাবে তেলাওয়াত করা শেখেনি, লিখিত পাঠ তার জন্য নিষিদ্ধ। এর আর একটি কারণ ছিল সেই সময়কার লিখিত আরবী ভাষার অপূর্ণতা। আরবী ভাষা তখনও ওরাল ল্যাঙ্গুয়েজ। কথায় যতকিছু নির্দিষ্ট করে বলা যায়, লেখায় তত নির্দিষ্ট করে লেখা যায় না। একই লিখিত শব্দের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে।

এই যে লিখিত কোরবানের সীমাবদ্ধতা, সেটি এখন ধ্বংস করে ফেলছে আমাদের ধর্মকে এবং তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সমাজের নৈতিকতা ও আদর্শ। কোরআনের এই আরবী ভাষাগত সীমাবদ্ধতার ফলে হাদিস নামক যে ডক্টরিন প্রচলিত হয়েছে সেটি ইহুদী তালমুদের মধ্য এশীয় রুপন্তরের দুর্বল নকল। অনেকটা হলিউডের ছবি নকল করে তামিল ছবি এবং সেটার জনপ্রিয়তা দেখে সেটা নকল করে যেমন হিন্দি ছবি তৈরী হয় তেমন।

এই বিষয়টা বুঝতে গেলে তালমুদকে বুঝতে হবে। তালমুদ হল সবচেয়ে আদি ইহুদি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও নৈতিক উপকথা ও তার ব্যাখ্যার সংগ্রহ। যে উপকথাগুলো একসময় আফ্রিকাতে প্রচলিত ছিল, সেগুলো প্রচলিত হয়েছে প্রাচীন পার্শিয়ায়, এর পর সেগুলে প্রচলিত হয়েছে দুইভাগ হয়ে ব্যাবিলন ও প্যালেস্টাইনে।

"তালমুদ হল রাব্বিনিক ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রীয় পাঠ এবং ইহুদি ও ধর্মীয় আইনের প্রাথমিক উৎস। আধুনিকতার আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে, তালমুদ ছিল ইহুদি সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু এবং সমস্ত ইহুদি চিন্তাধারা ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তি। তালমুদ ছিল ইহুদিদের দৈনিক জীবনের পথপ্রদর্শক।

তালমুদ শব্দটি সাধারণত ব্যাবিলনীয় তালমুড (তালমুদ বাভলি) নামে লেখাগুলোর সংগ্রহকে বোঝায়। জেরুজালেম তালমুদ (তালমুদ ইরুশালমি) নামে পরিচিত একটি পূর্বের সংগ্রহও রয়েছে।

তালমুডের দুটি উপাদান রয়েছে যার একটি হল মিশনাহ যেটি হল মৌখিক তাওরাতের (হিব্রু বাইবেল) একটি লিখিত সংকলন; এবং অপরটি গেমারা যেটি হল হিব্রু বাইবেলের উদাহরণ ও গল্প সহ মিথিক্যাল ব্যাখ্যা। "তালমুদ" শব্দটি হয় একা গেমারাকে বোঝাতে পারে, অথবা মিশনা এবং গেমারাকে একসাথে বোঝাতে পারে।

তালমুদ মিশনাইক হিব্রু এবং ইহুদি ব্যাবিলনীয় আরামাইক ভাষায় রচিত। তালমুদে ইহুদি নীতিশাস্ত্র, দর্শন, রীতিনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে হাজার হাজার রাব্বিদের (খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত) শিক্ষা ও মতামত রয়েছে। রয়েছে ইতিহাস এবং লোককাহিনী, এবং অন্যান্য অনেক বিষয়। তালমুদ হল ইহুদি আইনের সমস্ত কোডের ভিত্তি।"

আমাদের দেশে বর্তমানে হাদিস নামে যেটি প্রচলিত সেটি তালমুদের সেই গেমারার দুর্বল ইসলামিকরণ। বাংলাদেশে গাজী শামসুর রহমান নামে একজন আইনবিদ ও আইন সংস্কারক, বিচারক, বাগ্মী, ভাষাবিদ, গ্রন্থকার, বিশিষ্ট কলামিস্ট এবং টেলিভিশন ও বেতার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বাংলায় আইন বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার রচিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। এই শতাধিক আইন গ্রন্থ এক ব্যক্তি কিভাবে লিখেছিলেন? দুষ্ট লোকে বলে তিনি পাকিস্তানী গ্রন্থগুলো নিয়ে পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ বানিয়েছিলেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোও তাই। তালমুদের রূপকথা ও সামাজিক আইন কানুনগুলো নিয়ে সেগুলোর ইসলামের আবির্ভাবের দুইশ বছর পর দুই হাজার কিলোমিটার দুরে সেগুলোর মুসলমানী করা।