EN
আরও পড়ুন
মানসিক সমৃদ্ধি ও সম্পর্ক
দাপুটে পুরুষের আবেগ নিয়ে খেলা করার সমাজে
রাজনীতি
ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে
রাজনীতি
১৯৭৫ থেকে ২০২৪ - যত আত্মঘাতী কর্মকান্ড:
JadeWits Technologies Limited
ধর্ম ও দর্শন

সেই রাজ পুরোহিত আজ কোথায়?

শাসক ইন্দ্রের রাজনীতিপাঠ

"আছে আকাশ সে ইন্দ্র নাই, কৈলাসে সে যোগীন্দ্র নাই
অন্নদা-সুত ভিক্ষা চায়, কি কহিব এরে কপাল বৈ"
- গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা - কাজী নজরুল ইসলাম

দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। একবার এক বিশাল দানব এসে জগতের তাবৎ প্রবাহীত জল আটকে দিল। দুনিয়াব্যপি খরা আর দুর্ভিক্ষে মানুষের দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। অনভিজ্ঞ ইন্দ্রের খেয়ালই ছিল না যে তার একটি অস্ত্র আছে বজ্রতীর। দেরীতে বুঝলেও একটা বজ্রতীর ধনুকে ভরে মেরে দিল সে সেই দানবের মাথায়। ব্যাস। সব সমস্যার সমাধান। এই দেখে ইন্দ্রতো মহা খুশি। এত ক্ষমতা তার! এর পর সে পৃথিবীর কেন্দ্রে যে পর্বত তার চুড়ায় ফিরে গেল যেখানে তার বাস। তখন তার মনে হল তার বাসস্থানটি তার যোগ্যতায় যথেষ্ট উন্নত নয়, একে উন্নত করতে হবে। ডাক দিল সে দেবতারাজ্যের রাজ স্থপতিকে।

স্থপতি এসে চমৎকার এক প্রাসাদের কাজ শুরু করল। প্রসাদ শেষ হলে ইন্দ্র এসে দেখে তার মনে হল তার ক্ষমতা অনুসারে এটা যথেষ্ট উন্নত নয়। সব ভেঙে আবার নতুন করে নির্মান চলতে থাকল। আবার নির্মান শেষ হলে আবার ঘটল একই ঘটনা। প্রতিবারই ইন্দ্র আরও উন্নত প্রসাদ চান। হতাশ হয়ে গেল স্তপতি। ভাবল ইন্দ্রও অমর তিনিও অমর, এই নির্মান প্রক্রিয়ার তো কেন শেষ নাই। এ কোন চক্রে সে বাধা পড়ে গেল। উপায়অন্তর না দেখে স্রষ্টা ব্রম্ভার কাছে গেল সে নালিশ করতে। ব্রম্ভা তাকে আশ্বস্ত করলেন, তুমি বাড়ী যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।

পরদিন সকালে ইন্দ্র যখন তার প্রাসাদে তখন ফটকে দেখা গেল এক অচেনা বালক। প্রহরী তাকে নিয়ে এল ইন্দ্রের কাছে। বালকটিকে ইন্দ্র প্রশ্ন করল তার এখানে আসার হেতু কি।

বালকটি বলল "শুনলাম আপনি এমন এক প্রাসাদ নির্মান করছেন যা আগের কোন ইন্দ্র করেন নি"?

শুনে ইন্দ্র বলল "বৎস, এ তুমি কি বলছ? আগের কোন ইন্দ্র? এর অর্থ কি"?

বালকটি বলল “হ্যা, কত ইন্দ্র দেখলাম, এলো আর গেল"।

বিষ্ণু নিদ্রারত ব্রহ্মান্ডের মহাসমুদ্রে। তার নাভিতে ফুটে আছে বিশ্বপদ্ম। সেই পদ্মের পাপড়িতে ধ্যানরত বসে আছেন ব্রহ্মা যিনি স্রষ্টা। তিনি চোখ খোলেন তো সৃষ্টি হয় বিশ্ব, যার শাসক ইন্দ্র। তিনি চোখ বোজেন তো ধ্বংশ হয় বিশ্ব। আবার তিনি চোখ খোলেন তো সৃষ্টি হয় নতুন বিশ্ব যার শাসক নতুন ইন্দ্র।

এমন সময় প্রাসাদের মেঝেতে দেখা যায় একসারী পিপড়ে। এটা দেখে হেসে ওঠে বালক। এটা দেখে ইন্দ্রের মাথার চুল দাঁড়িয়ে যায়। আরও কি ভয়্ংকর সত্য অপেক্ষা করছে সেটা জানার জন্য অধীর হয়ে ওঠে সে।

বালকটিকে বলে ইন্দ্র, "হাসছ যে"?

বালকটি বলে “মর্মাহত না হতে চাইলে জিজ্ঞাসা করবেন না।“

তখন ইন্দ্র বলে, "জিজ্ঞাসাই করছি বৎস, আমাকে জ্ঞানদান কর"।

বালকটি তখন পিপড়েদের দেখিয়ে বলল, “দেখছেন তো লাইন ধরে আগের সব ইন্দ্রকে? সাধারণ থেকে বজ্রশর পেয়ে তারা ভাবে কি দারুন শক্তিধর আর শ্রেষ্ঠ আমি। তারপর আবার সাধারণ হয়ে যায়।“

এর পর ইন্দ্র এতই হতাশ হয়ে পড়ে যে স্থপতিকে ডেকে তখনই প্রাসাদ তৈরী বন্ধ করতে বলে। সিদ্ধান্ত নেয় যোগী হয়ে যোগসাধণা করবে ও বিষ্ণুর পাদপদ্মে ধ্যান করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে। এটা শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে তার সুন্দরী স্ত্রী ইন্দ্রাণী। রাজ পুরোহিতের কাছে সাহায্য চায় সে।

রাজ পুরোহিত ইন্দ্রাণীকে নিয়ে ইন্দ্রকে পরামর্শ দেন যে প্রত্যকের তার নিজের বর্তমান অবস্থার নিরীক্ষে সঠিক কাজটি করা উচিৎ। তিনি দেবতাদের রাজা। শক্তি ও দম্ভ নয়, রাজনৈতিকভাবে তার সকল সমস্যার পথ খোঁজা উচিৎ।

পুরোহিত বলেন “তোমার জন্য বহু আগেই আমি রাজনৈতিক কলাকৌশল সংক্রান্ত একটি পুস্তক রচনা করেছিলাম। দেবতাদের রাজা তুমি। তোমার অবস্থনটি সকলের কল্যানের লক্ষ্যে ব্যবহারের সবচেয়ে ভাল সুযোগে অবস্থিত তুমি। একে কাজে লাগানোই তোমার কাজ।“

একথা শুনে ইন্দ্র যোগী হবার পরিকল্পনা বাদ দেয় এবং রাজনীতি শিক্ষায় মনোনিবেশ করে। এবং বুঝতে পারে যে সে চিরায়তের প্রতিনিধি মাত্র, যার কাজ বর্তমানের জন্য শ্রেষ্ঠটি দেওয়া, শক্তি প্রয়োগে কল্পনার উন্নততম রাজ্য প্রতিষ্ঠা নয়।

ক্ষমতার চুড়ায় যে উঠে বসে সে যদি দেবতাদের মত সৎ এবং বজ্রের মত শক্তিশালীও হয় তবুও সে উন্নাসিকতা আর আত্ম ক্ষমতার নেশায় ভুল করতে পারে এবং যার ফলে তারই সৎ এবং অনুগত অনুসারীদের শঙ্কা ও বেদনার কারন হয়ে উঠতে পারে।

অসৎ ও গশুসুলভ চরিত্রের কাছ থেকে আসা অপশাসন আমাদের হেনস্থা করে কিন্তু আমাদের মন ভেঙে দেয় না কারন আশা থাকে সৎ ও শুভ ফিরে আসবে। মুক্তি হবেই। কিন্তু শুভই যখন অপশাসন দিয়ে ভাল করতে গিয়ে অন্যায় বেআইনি কাজে ডুবে যেতে থাকে তখন আমাদের মন ভেঙে যায়। তখন মনে হয় আর কিসের আশা রক্ষা করবে শুভকে?

হঠাৎ অর্থ ক্ষমতা পেয়ে বাংলাদেশের শাসনেও ক্ষমতার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর একটাই কারন যারা ক্ষমতায় তারা রাজনীতি বোঝে না। বাংলাদেশকে শাসন করার নীতি যারা তৈরী করছেন যারা প্রধানমন্ত্রীকে গাইড করছেন, দেশের অবস্থা দেখেই বোঝা যায় যে তারা স্টেম (STEM) মানসিকতার। যারা বিজ্ঞান প্রযুক্তি ইন্জিনিয়ারিং বা গণিতের পেশাদার।

আসলে শুধু স্টেম নয়, এটি যে কোন হস্তান্তরযোগ্য জ্ঞানের (Transferable knowledge) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন অর্থনীতি, প্রসাশন ইত্যাদী। অর্থাৎ তাদের মস্তুিষ্ক শুধুমাত্র মূর্ত বিষয় নিয়েই চিন্তা করতে পারে। অথচ রাজনীতি বিমূর্ত। সমাজ কাজ করে, মানুষ প্রতিদিন সকালে যে উদ্যম নিয়ে কাজে ঝঁপিয়ে পড়ে তার পেছনের কারনটাও বিমূর্ত।

স্টেম মানসিকতা আর সামরিক মানসিকতা একই। সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষন ও কন্ডিশনিং মাধ্যমে বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হয়। তাই তারা বহু দেশ শাসন করেছে কিন্তু কোনদিন রাজনীতি বোঝেনি। শাসন করেছে শক্তি ক্ষমতা দিয়ে। যার কারনে রাজনতি হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ। উন্নয়ন গেছে থেমে।

আমি যদি রাজনীতি না বুঝি তাহলে রাজনীতি বোঝে এমন লোকেদের আমি আর পছন্দ করব না। তাদেরকে আমার মনে হবে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বা কন্সপিরেটর। হয় আমি তাদের দুরে সরিয়ে দেব না হয় তারা আমার কাছ থেকে দুরে সরে যাবে। তখন আমার চটপটে বা স্মার্ট উইটি বা চতুর মানুষ দের পরামর্শ আমার পছন্দ হবে। তারাই ঘিরে রাখবে আমাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বে এই পদ্ধতি কাজ করেছে। কারন তারা সারা বিশ্ব থেকে লুটপাট করে এনে সম্পদ ও আয়েশের ইন্দ্রিয় উদ্যমে নিজেদের সমাজকে এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। দক্ষিনপুর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশেও এই পদ্ধতি কাজ করেছে। কারন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তাদের পুরো দেশটাই উন্নত দেশগুলোর কারখানায় পরিণত হয়েছে।

অ্যানথ্রোপোলজিস্টরা, সমাজ বিজ্ঞানীরা বার বার বলেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের চিন্তা ভাবনার ধরন ভিন্ন। তারা দীর্ঘ-কাল, অর্থাৎ হাজার বছরের স্কেলে চিন্তা করে যেটা পশ্চিমারা বা দক্ষিনপূর্ব এশিয়রা করতে পারে না। তারা ইন্দ্রীয়পরায়ণতাকে ভেতর থেকে অপছন্দ করে।

তারা আদর্শকে উচ্চ মূল্য দেয় (ভ্রান্ত হলেও)। তারা প্রত্যেকেই ফিলসফার। এই সব গভীর সাংস্কৃতিক কারনেই বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় ভোগের উন্নয়ন মডেল এখানে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। আদর্শহীন উন্নয়ন এখানে অপশক্তিকে ক্ষমতাশীল করবে। সেই কারনেই এখানে সামরিক শক্তি কখনও টেকে নাই, সমাজতন্ত্রও কখনও আসে নাই, কোন দিন আসবেও না।

বর্তমানের বাংলাদেশ তাই রাজনীতিজ্ঞানশুন্য সেই কিশোর ইন্দ্রদের হাতে, যারা তাদের উন্নয়নের প্রাসাদ আর বজ্রধনুর শক্তিতে আত্মহারা - সেই রাজ পুরোহিত আজ কোথায়, তাকে এখন বড় প্রয়োজন।

 
JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।