EN
আরও পড়ুন
রাজনীতি
পলিটিক্যাল সিস্টেমস থিংকিং এর শিক্ষা
রাজনীতি
JadeWits Technologies Limited
ধর্ম ও দর্শন

"দুঃখ ও কষ্টের অন্যতম মূল হল নিজ আত্মাকে অন্যের আত্মার থেকে পৃথক জ্ঞান করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া।"

ব্যক্তিগত অহংবোধের ঊর্ধ্বে

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন একজন ধনী খ্রীস্টান, একজন ধনী মুসলিম বা একজন ধনী হিন্দুর বাসায় গিয়ে দেখেন, দেখবেন তাদের বাসাগুলো এবং তাদের আচরণ একই রকমের। কিন্তু ওই তিনটি ধর্মের যে কোন ধর্মের একটি ধনী ও একটি গরীব বাড়িতে গিয়ে দেখুন তাদের বাসাগুলো এবং তাদের আচরণে কত তফাত।

ধর্মগুলোর বিশ্লেষণ ও তুলনা করতে গিয়ে দেখেছি ধর্মগুলোকে এখন যেমন দেখা যাচ্ছে কিছুদিন আগেও মোটেই সেগুলো এমন ছিল না। জীব বিবর্তনের চেয়েও আরো আজবভাবে বিবর্তিত হয় ধর্ম যদিও নাম একই থাকে।

মনোবিজ্ঞানে আমার উৎসাহ থাকায় আমি লক্ষ্য করেছি মানুষ পরিবর্তিত হয় সময়ের সাথে। পেশা ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে গণমানুষের নিরাপত্তা শঙ্কা পরিবর্তিত হয় যার ফলে তাদের সমষ্টিগত অবচেতনা (Collective Unconscious) পরিবর্তিত হয়। এতে তাদের মনোজাগতিক আচরণ (psychological Attitude) বিবর্তিত হয় যেটা ধর্মকে ক্রমেই বিবর্তিত করে।

আমি আরো দেখেছি ধর্মের এই বিবর্তিনের জন্য দায়ী আমাদের মস্তুিস্কের চিন্তাগত ক্ষমতা বা কগনিটিভ প্যাটার্নের (Neural pathways) পরিবর্তন যেটা নির্ভর করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর। হান্টার গ্যাদারার থেকে কৃষিকাজে পেশা পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন ধর্মের উন্মেষ হয়। কিন্তু পুরোনো ধর্ম যেখানে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সহযোগীতায় শাসনের অংশ হিসাবে, সেখানে ধর্মগুলো নামে পরিবর্তিত না হয়ে চরিত্রে পরিবর্তিত হতে থাকে। এটি যেমন হিন্দুধর্মে ঘটেছে তার কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে, তেমন অন্য ধর্মগুলোতেও ঘটেছে যেগুলো নিয়ে পরে বিস্তারিত লেখা যাবে।

যখন আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন আয়োজন দেখা যাচ্ছে না তখন নিজের পরিবারের বাইরে যারা সেটা নিয়ে সামান্য উৎসাহ দেখাত সেটা হল বিবাহিত বান্ধবী বা বন্ধুদের স্ত্রীরা। তেমনই এক বিবাহিত বান্ধবী একবার বলল তুমি তো জ্ঞান বিজ্ঞানে অনেক পন্ডিত, আবার একা থাক, সেক্যুলার চিন্তাধারা, তো আমার এক বান্ধবী আছে সেও মহা পন্ডিত মানুষ, ওকে বিয়ে কর, মিলবে ভাল যদি না সে হিন্দু বলে তোমার আপত্তি না থাকে।

আমি বললাম পন্ডিতে পন্ডিতে মেলে না, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়, দাঙ্গা বাধে – পরিকল্পনাটা ঠিক না। কিন্তু মেয়েদের ইগো যেমন হয়, ধরেই নিল যে হিন্দু মেয়ে বলে আমি কোন উৎসাহই দেখাচ্ছি না। ধর্মের চেয়ে স্বভাব যে আরও অনেক বড় বিভেদ তৈরী করতে পারে এটা আমাদের সমাজে বুঝতে পারে খুব কম লোক। দেখা করতে রাজি হতেই হল এবং ক’দিন পরেই আমার বান্ধবীটি তার বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালো এবং সেখানে এলো সেই মেয়েটিও।

মেয়েটি খুব ভাল ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটি এনজিওতে গবেষণার কাজ করছে এবং চেষ্টা করছে বিদেশী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনরোল করার, লক্ষ্য হল পিএইচডি করা। মেয়েটি গড়নে ছোটখাট হলেও বেশ নিটোল এবং চেহারাটা মন্দ নয়। আচরণে বেশ চুপচাপ এবং একটু যেন ভীত, আড়ষ্ট। পরিচয় পর্ব হয়ে গেলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে ঘটক দুই পক্ষকেই জানান দিয়ে এনেছে নাকি শুধু আমিই জানি শখের ঘটকের মনের ইচ্ছা। যেটুকু আন্দাজ করতে পারলাম তাতে মনে হল মেয়েটিকে আসলে না বলেই আনা হয়েছে। এতে আমি একটু আশ্বস্ত হলাম কারণ এটা না হলে বিষয়টা অস্বস্তিকর।

অনুষ্ঠানের শেষে ডিনার শেষ করে আড্ডা জমে উঠলে আমি মেয়েটা সম্পর্কে একটু জানতে উৎসাহী হলাম। মেয়েটার বাবা ছিল নামকরা এক পেশাজীবি, মা শিক্ষিকা। তার এক ভাই আছে সে বয়সে বেশ বড়, বিদেশে থাকে। ছোট বেলা থেকেই সে একা একা বড় হয়েছে এবং এখনও পড়াশোনা ক্লাস, বইপত্রই তার দিনের প্রায় সবটা সময় নিয়ে নেয়। নারীমুক্তি এবং নারী স্বাধীনতা নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ এবং সেটা নিয়েই সে গবেষণা করছে। এদেশে নারীর পরাধীনতা ও পিছিয়ে পড়ার জন্য কারণ কি এটা জানতে চাইলে তার জবাব ছিল ধর্ম ও পুরুষ।

হিন্দু ধর্ম নিয়ে কথা হলে দেখলাম হিন্দু ধর্মে যে কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণপ্রথা আছে, উঁচুনীচু জাত আছে সেটার কারণেই যেন সে ধর্ম বিরোধী। দেশ, ধর্ম ও পুরুষ এই শব্দগুলো যখন সে বলছিল তখন আমার মনে হচ্ছিল সে যেন আলোচনা করছে না, বিদ্বেষ প্রকাশ করছে দেশ, ধর্ম ও পুরুষ সম্পর্কে। আমার মনে হলো যেন এই মেয়েটা তার যা কিছু আপন, সেগুলোকে ঘৃণা করে বা সহ্য করতে পারে না।

তার স্বামী যে হবে, তাকেও সে সহ্য করতে পারবে না, অসহ্য লাগবে। নিজের সামাজিক জীবনের ভিত্তি যাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে – সেগুলোকেই যেন তার অসহ্য লাগছে। এর ফলেই মেয়েটা যেন ভাবছে পশ্চিমা দেশগুলোর কথা, যেন সেখানকার সমাজে এই ত্রুটিগুলো নেই, সেখানে সবাই সমান, দেশগুলো তাদের জনগণের জন্য উদার আর পুরুষেরা সেখানে সব ফেরেশতা।

মেয়েটার সাথে কথা বলার পর আমার মনটা ভেঙে গেল। এটা এই কারণে নয় যে একটা সম্ভাব্য পাত্রী হারালাম কারণ সেই আগ্রহটি কেন যেন তৈরীই হয়নি। মনটা ভেঙে যাবার কারণ হল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যারা, তাদের জীবন যাত্রাটিই যেন বিপরীতমুখী – জীবন বিরোধী। আত্মকে ঘৃণা – দূরকে ভালবাসা।

বহু আধুনিক মানুষ এমন কি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই জানে না হিন্দু ধর্মের সঠিক রূপ এমন কি হিন্দু নামটাও যে আসলে বিদেশী। বৌদ্ধধর্ম, খৃষ্টধর্ম বা ইসলাম যেমন কোন নবী বা ধর্মপ্রচারক দ্বারা প্রবর্তিত, হিন্দু ধর্মে এমন কোন একক প্রবর্তক নাই। হিন্দু নামটা এসেছে একটি নদীর নাম থেকে। পাক ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদীর পারে যারা বাস করত তাদের ‘সিন্ধুস’ বুঝাতে ফারসি ভাষায় সেটা ‘হিন্দুস’ হয়ে গেল যেটা অনেকটা ছিল বরিশালের মানুষদের মত সেই ভানু বন্দোপধ্যায়ের ‘স’ কে ‘হ’ বলার সমস্যায়।

ফারসি ভাষায় সেই ‘হিন্দুস’ যখন গ্রীকরা ল্যাটিনে লেখা শুরু করল তখন আবার ‘হিন্দুস’ ‘ইন্ডাস’ হয়ে গেল কারণ তারা আবার ‘হি’ বলতে পারে না ‘ই’ বলে ফেলে। সেই থেকেই সেই স্থানের নাম হয়ে গেল ইন্ডিয়া, জনগোষ্ঠীর নাম ইন্ডিয়ান ও তাদের যে ধর্মকর্ম, যেগুলো হাজার ধরণের, সব হয়ে গেল হিন্দু ধর্ম। যদিও এই প্রাচীন ভারতীয় ধর্মাচার ও বিশ্বাসগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য, সেটা ছিল বিশাল যার অধিকাংশই ছিল প্রকৃতিধর্ম বা এনিমিজম।

প্রায় ৬৫ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে এসে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের বসবাস শুরু হলেও তারা ছিল সংখ্যায় খুবই অল্প। প্রায় ১৮ হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগের সময় সাগরের পানি অনেক স্থানে শুকিয়ে গেলে সারা দুনিয়াতেই মানব বিস্তার বা মাইগ্রেশন বেড়ে যায়।

৯ হাজার থেকে ৫ হাজার বছর আগে ইরানের জাগ্রোজ এলাকা থেকে বহু মানুষ ভারতবর্ষে চলে আসে যারা কৃষিকাজে দক্ষ ছিল। আগেই আফ্রিকা থেকে আসা মানুষেরা তখন সংখ্যায় বেড়েছে অনেক এবং তাদের সাথে এই ইরান থেকে আসা জনগোষ্ঠী মিলে ভিত্তি তৈরী করে ভারতবর্ষে হরোপ্পান সভ্যতার। এর পর ৪ হাজার থেকে ৩ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে আসে ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় কথা বলা আর্যরা এই ভারতবর্ষে।

আর্যরা আসার আগে ভারতবর্ষে ছোট ছোট নানা ধর্ম (প্রকৃতিধর্ম) ছিল এবং ধর্মগুলোর মধ্যে বিশ্বাস ও প্রথার ব্যাপক বিভেদ ছিল। পশুপালক আর্যরা ভবঘুরে ছিল। ভারতবর্ষে আসার পরে যখন সুজলা সুফলা ভুমিতে তারা স্থির হয়ে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলল প্রাচীন ভারতীয়দের সাথে মিশে তখনই সূচনা হল বেদ নামক জ্ঞান ও দর্শন নির্ভর ধর্মতত্বের। এখন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তাই শুরু হল হিন্দু ধর্মের বৈদিক যুগের যেটাই হিন্দু ধর্মের ভিত্তি।

"বেদ হল প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ তত্ত্বজ্ঞান-সংক্রান্ত একাধিক গ্রন্থের একটি বৃহৎ সংকলন। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। বেদের সংখ্যা চার: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেকটি বেদ আবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: সংহিতা (মন্ত্র ও আশীর্বচন), আরণ্যক (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম, যজ্ঞ ও প্রতীকী যজ্ঞ), ব্রাহ্মণ (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির উপর টীকা) ও উপনিষদ্‌ (ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনা)।

বেদের বিষয়বস্তু আবার দুই ভাগে বিভক্ত যথা কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা এবং জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা তথা দর্শন ও বিশ্বতত্ব। ব্রহ্মের স্বরূপ কি, জগতের সৃষ্টি কিভাবে, ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কি এসব আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে। জ্ঞানকাণ্ডই বেদের সারাংশ। এখানে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তারই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ ঘটেছে।

এসব ছাড়া বেদে অনেক সামাজিক বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্তেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়।

ঋগ্বেদ থেকে তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদ থেকে পাওয়া যায় তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিস্তারিত বিবরণ। এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবেও গণ্য করা হয়।"

বেদগুলো পড়লে মানতেই হবে যে হিন্দু বৈদিক ধর্ম বলে আমরা যে ধর্মকে জানি সেটি আসলে দার্শনিকদের তৈরী একটি জ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ ও জীবন যাপনের নির্দেশিকা। উপনিষদ হচ্ছে যার বোধযোগ্য সংক্ষেপিত বিশ্লেষণ। বেদ ও উপনিষদের ভিত্তিই ছিল দার্শনিক জ্ঞান ও ন্যায্যতা।

প্রায় হাজার খানেক বছর এই বেদযুগ প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ভারতবর্ষ কৃষি ও ব্যবসায় উন্নতিলাভ করে ও শহরগুলো তৈরী হয়। রাজারা শক্তিশালী হয়। ধর্মের রাজনীতিকরণ হয়। মানুষ যেন জ্ঞান ও ন্যায্যতার কথা আর শুনতে চায় না। এর সাথে আর্য অনুসারী ও ভিন্ন মতধারীদের সাথে যুদ্ধবিগ্রহও বাড়তে থাকে। ধর্ম ক্রমেই জ্ঞান, দর্শন ও ন্যায্যতা ত্যাগ করে রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে।

তখন জ্ঞান, দর্শনকে পেছনে ফেলে ভক্তিবাদ ভিত্তিক ধর্ম প্রচার শুরু হয়। অদৃশ্য তত্বজ্ঞান ও দর্শন বাদ দিয়ে কল্পনাভিত্তিক দৃশ্যমান সব অবতার তৈরী করা হয়। রচিত হয় টিভি ধারাবাহিক সোপ অপেরার মত রামায়ন ও মহাভারত যেগুলো বেদ উপনিষদের তত্ত্ব দর্শন ভিত্তিক চরিত্র নির্ভর কাব্যনাট্য। যুদ্ধবাজ ও প্রতাপশালী রাজারা ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করে মানুষ নিয়ন্ত্রণে এর ফলে সেই আত্মশুদ্ধি ও প্রশান্তির পথপ্রদর্শকের পথ হারিয়ে ফেলে বেদ উপনিষদের ন্যায় ও দর্শনের হিন্দুধর্ম।

এই বিবর্তনের প্রায় পাঁচ’শ বছর পর জন্ম হয় সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের। শান্তি ও সহনশীলতার বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে। মহা প্রতাপশালী ও নিষ্ঠুর সম্রাট অশোক নিজের যুদ্ধকালীন নিষ্ঠুরতা ও মৃত্যু-হাহাকার দেখে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করে। এর পর সম্রাট অশোকের উৎসাহে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে ভারতবর্ষে। ক্রমেই জনপ্রিয়তাও হারাতে থাকে হিন্দুধর্ম।

যে কোন ধর্ম যখন নবীন ও প্রসারমান, সে তখন সহনশীল ও উদার। কিন্তু সে যখন চাপের মুখে পড়ে, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সে তার উপরে নির্ভরশীলদের স্বার্থ হসিলের জন্য ক্রুর হিংসাত্মক এবং রক্ষনশীল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মোল্লা পুরুতেরা।

বেদ উপনিষদে বা রামায়ন মহাভারতেও সমাজ পরিচালনায় পেশাগত বিভাজন থাকলেও জন্মভিত্তিক কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণপ্রথা ছিল না, ছিল পেশাগত বিভাজন। ব্রা‏‏হ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র অর্থাৎ এই চারটি কর্ম বিভাজন ছিল যেখানে ব্রা‏‏হ্মণের কাজ ছিল ধর্মগুরু বা শিক্ষকের, ক্ষত্রিয়রা ছিল যোদ্ধা বা শাসনকর্তা, বৈশ্যরা ছিল কৃষিবীদ বা ব্যবসায়ী এবং শূদ্র হলো যারা কায়িক শ্রম দিয়ে থাকে।

বেদ উপনিষদে বা রামায়ন মহাভারতে এই চার রকম কাজ যে বংশগতভাবে আসতে হবে এমন কোন নির্দেশনা নাই। কারন ক্ষত্রিয় সেনাপতির পুত্র যে দক্ষ যোদ্ধা হতে পারবে সেই নিশ্চয়তা কোথায়? ব্রা‏‏হ্মণ পুত্র যে মুনি ঋষি হবে সেটাও নিশ্চিত নয়। ওই সময় যখন হিন্দু পুরোহিতেরা যখন হিন্দুত্বের বিলোপের ভয়ে ভীত এবং নিজেদের পেশা হারানোর শঙ্কায় তখন সেই ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা রাষ্ট্রিয় আইনের অনুকরণে মনুসংহিতা নামে ধর্মীয় আইনের একটি গ্রন্থ রচনা করে।

সুধীর রঞ্জন হালদার নামে একজন লিখছেন “অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠার অনেক পরে অশোকের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্ম করার ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের হীনাবস্থায় বহুকাল গত হলে ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে পুষ্যমিত্র কর্তৃক সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠার পরে এই গ্রন্থ (মনুসংহিতা) রচিত হয়। প্রধানত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এবং পুরোনো ধর্মশাস্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে বর্ণব্যবস্থাকে জন্মগত করে ব্রাহ্মণকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে হাজারো জাতপাতের সৃষ্টি করে একেবারেই নতুন করে ব্রাহ্মণ্যধর্মী এই গ্রন্থ রচিত হয়।

এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল রাজহত্যাকারী ব্রাহ্মণ সেনাপতি স্বয়ং পুষ্যমিত্র যে তখন সিংহাসনে আসীন। অথচ এই গ্রন্থ স্বয়ম্ভূ মনু কর্তৃক রচিত বলে প্রাচীনত্বের ভণিতা করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয়। বারোটি অধ্যায়ে রচিত এই গ্রন্থ ‘সৃষ্টি প্রকরণ‘ থেকে শুরু করে ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্ত আইনকানুন নিয়ম ইত্যাদি সবই যে সুচতুর ব্রাহ্মণদের কল্পনাপ্রসূত, নিজেদের সুখসুবিধা চরিতার্থ করার একখানি যন্ত্রবিশেষ হিসাবে লিখিত হয়েছে, এ কথা যুক্তি-বিজ্ঞানের আলোয় কারও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

অশোক বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্ম করেছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র মানুষে মানুষে সমতা ফিরে আসায় সমাজে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আর ছিল না। ব্রাহ্মণ্যধর্মের লোকদের কাছে এটা ছিল একটা বিরাট ধাক্কা। ব্রাহ্মণেরা বর্ণশ্রেষ্ঠ- এই দাবির সুবাদে প্রাপ্ত সকল সুযোগসুবিধা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে সাম্রাজ্যের সকল ক্ষেত্রে গৌণ ও অবহেলিত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের মর্যাদার চেয়ে সমাজে তাদের আলাদা কোনো বিশেষ মর্যাদা ছিল না। এক কথায় ব্রাহ্মণ্যবাদকে দমন করা হয়েছিল।

অশোক সব ধরণের পশুবলি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার ফলে পশুবলিদানের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের পাওনা মোটা রকমের দক্ষিণা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছিল, যা ছিল তাদের জীবনধারণের প্রধান উপায়। মৌর্যদের শাসনকাল ছিল ১৪০ বছর। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে ব্রাহ্মণেরা বলতে গেলে নিপীড়িত ও অবদমিত শ্রেণি হিসাবে বাস করতে বাধ্য হয়। ব্রাহ্মণদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ছিল বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। সামবেদী ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র সুঙ্গই সেই বিদ্রোহের ধ্বজা ধরে প্রথম এগিয়ে আসে।”

আশ্চর্য হলো ইংরেজরা এই মনুসংহিতাকেই হিন্দু আইনে পরিণত করে হিন্দুদের উপরেই প্রয়োগ করে দমন নিপিড়ন করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ যেন ইসলাম ধর্মের জন্মের এক হাজার বছর পর সালাফি বা ওয়াহাবিজম দ্বারা রাষ্ট্রসমুহের ইসলামি শাসনের হিন্দু ভার্সন।

মনুসংহিতাই আসলে হিন্দু ব্রা‏‏হ্মণদের বংশরক্ষায় আর শূদ্র বা দলীতদের দিয়ে হীন কাজ করাতে এই কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণপ্রথাকে বংশনির্ভর করে। এটা যে মিথ্যা ও অকার্যকরী সেটা প্রমাণীত হয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য মানে যোদ্ধা বা শাসনকর্তা ও কৃষিবীদ বা ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এই বংশনির্ভর নিয়মটি মানা হয় না কারন সেটি সম্ভব নয়।

ফিরে যাই আমার গল্পে। মেয়েটা হিন্দু হলেও সে নারী এবং নারী পুরুষ একে অপরের পরিপুরক। বিবাহ ইচ্ছুক নারীর মনে পুরুষের সাথে একীভূত হবার ও পুরুষের মনে নারীর সাথে একীভূত হবার দৃঢ় বাসনা থাকতেই হবে, বাইরের তর্ক, বিবাদ, বিসম্বাদ যতই থাক। মনের গহীনে এই একীভূত হবার বাসনা অনেকের থাকে না। তারা বাইরের পোশাক দেখে নিজের স্বভাব-প্রকৃতি, দেশ, ধর্ম, মানুষকে ছেড়ে চলে যায় অলীক কল্পনার বিদেশী ফানুসের পিছনে।

বেদ-উপনিষদও তাই বলেছে একীভূত হওয়াই মানুষের জীবনের লক্ষ্য শ্রেণীবিভেদ নয়। এটা শুধু নারী-পুরুষের নয়, সকল মানুষের, সকল প্রাণী বস্তু ও ব্রহ্মান্ডের। বেদ-উপনিষদের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হলো মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণা যা হল পরম সত্য। সেই হিসাবে আমরা সবাই ব্রহ্মকে ধারণ করি।

আমাদের আত্মা হল ব্রহ্মের অংশ সত্য আর ন্যায্য যার মধ্যে নিজে থেকেই জন্ম নেয়। মানুষ হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের যে ভৌত বিভেদ যেমন নারী পুরুষ, ধনী, গরীব, পুরোহিত, শিক্ষক, শাসক, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক; ভৌত বাস্তবতার এই বিচ্ছিন্নতাগুলো হলো মায়ার দেওয়াল দ্বারা বিভাজিত বা বিভক্ত। মায়ার এই বিভাজিত পরিবেশটাই হলো 'সংসার'।

আমাদের নেতিবাচক কর্ম তথা অপচিন্তা, অপকর্ম, অপআবেগ তথা রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, ইগো এই দেওয়ালগুলোকে আরও বড় করে তোলে। আমরা যদি আমাদের ধর্মকে অনুসরণ করি অর্থাৎ পুরোহিতের কথা বা উপাসনার ধর্ম নয়, যে মায়ার বাঁধনে আমরা আবদ্ধ তার প্রকৃতিকে অনুসরণ করি; যেমন নারী তার নারীধর্ম, পুরুষ তার পুরুষধর্ম, পুরোহিত, শিক্ষক, শাসক, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক সবাই যে যার দায়ীত্ব-প্রকৃতিকে অনুসরণ করি তাহলে মায়ার বিভাজন থেকে আমরা ক্রমেই মুক্ত হই।

মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী মায়ার দেওয়ালগুলো তখন উবে যায় – তখনই আমরা মোক্ষ লাভ করি। যেটাই মানব জীবনের উদ্দেশ্য।

"যস্ত সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি ৷
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে ৷৷"
- ঈশোপনিষদ ৬-৭

অর্থ: দুঃখ ও কষ্টের অন্যতম মূল হল নিজ আত্মাকে অন্যের আত্মার থেকে পৃথক জ্ঞান করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। এই পৃথক জ্ঞান আসে অস্তিত্বের প্রকৃতিকে সংঘর্ষশীল দ্বৈতজ্ঞান করার থেকে। এই জ্ঞানে একজনের আনন্দ ও বেদনা অন্যের আনন্দ ও বেদনার থেকে পৃথক মনে হয়।

উপনিষদের মতে, যদি একজন ব্যক্তি সকল বস্তুতে আত্মাকে অনুভব করতে পারেন, তাহলে এই কষ্ট আর থাকে না। এই অদ্বৈত জ্ঞান থেকে তিনি বুঝতে পারেন সকল অস্তিত্বের মধ্যে একটি একত্ব রয়েছে। তখন তিনি ব্যক্তিগত অহংবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান এবং বিশ্বজনীন মূল্যবোধ, আত্মা ও প্রকৃত জ্ঞানের অনুসন্ধানে লিপ্ত হন।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।