২০১৬ সালে ১৮ দিনের এক ভ্রমণ। এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম ভুটান। উদ্দেশ্য সারা ভুটান ঘুরব। টুরিস্টরা ভুটানে ঘুরতে পারে দুটো প্রশাসনিক এলাকা ও তার আশেপাশে। এদুটো ছাড়া অন্য এলাকায় যেতে গেলে লাগে বিশেষ অনুমতি। আমরা টুরিস্ট নই, ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। পাখি ও বন্যপ্রাণী নিয়ে আমরা গবেষণা করি ও ছবি তুলি। ভুটানের রাজাও একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। ভুটানের রাজার ফটোসঙ্গী যারা তারা আমাদেরও ফটোবন্ধু। সহজেই আমরা পেয়ে গেলাম প্রায় পুরো ভুটান ঘোরার অনুমতি।
সারা পৃথিবীর বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক বসবাস হয় খাদ্য, জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির ধরণের উপর নির্ভর করে। প্রকৃতিতে বনের পাখিরা বাস করে গাছের পাতার যে আকৃতি তার উপর নির্ভর করে যে বিভাজন, তার উপর নির্ভর করে। ভুটানে গাছের পাতা আকৃতি কেমন সেটার উপর নির্ভর করে আলপাইন, মিশ্র বা ব্রডলিফ এমন ভিন্ন ভিন্ন এলাকা রয়েছে যার উপর নির্ভর করে কোন পাখিরা কে কোন অঞ্চলে বাস করবে। পাখিদের মধ্যে হিমালয়ের সুন্দরতম পাখিদের মধ্যে উপরের দিকে আছে হিমালয়ান মোনাল, স্যাটয়ির ট্রাগোপান এরা যারা উচ্চ পর্বতের আলপাইন এলাকায় বাস করে।
পরিকল্পনা হল উত্তর-পূর্ব ভুটানের উঁচু আলপাইন এলাকা বিমানবন্দর শহর পারো থেকে রাজধানী থিম্পু এসে সোজা দক্ষিনে আসামের সীমানায় সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি উচ্চতায় নেমে যাব আমরা মানস এলাকায় যেখানে ছোট ছোট অসংখ্য ছড়ায় ব্রহ্মপুত্রের সৃষ্টি। এর পর উঠতে থাকব আমরা উত্তর পশ্চিম ভুটানের দিকে মঙ্গার ব্রডলিফ ফরেস্ট এলাকাগুলো দিয়ে আবার হিমালয়ের চুড়ায়। উঁচু পাহাড়ের উপর দিয়ে বিভিন্ন উচু পাস অতিক্রম করে সোজা উত্তরপূর্বে যাত্রা হবে আবার ফেরার পথে।
ভুটানের বুমথাং জেলার চুমি উপত্যকার চমৎকার পরিবেশে অবস্থিত থারপালিং মঠ, যা "মুক্তির স্থান" নামে পরিচিত, যেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিঙ্গমা বৌদ্ধ মঠ। এখান থেকে চুমি উপত্যকার পাহাড়ের বরফ জমা চুড়াগুলোর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। এই থারপালিং মঠে আমরা যাব অবিশাস্য সৌন্দর্যের হিমালয়ান মোনালের ছবি তোলার জন্য।
থার্পালিং মঠ বুমথাং-এর চুমে উপত্যকায় ৩,৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, নাতিশীতোষ্ণ এবং আল্পাইন বনের সংযোগস্থলে। এখানে যাবার পথে আছে ব্লু পাইন বন, শীতল ব্রডলিফ বন, স্প্রুস বন, হেমলক বন এবং জুনিপার-রডোডেনড্রনের ঝোঁপ এগুলো। ভুটানের প্রায় ৭১% এলাকা বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত, এবং এটি তিনটি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত: উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় (দক্ষিণে), নাতিশীতোষ্ণ (মধ্যাঞ্চলে) এবং আল্পাইন (উত্তরে)।
থার্পালিং মঠে আমাদের উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে এল। রাতটা ৩,৬০০ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় কোথাও কাটাতে হবে। সাথে আমাদের তাঁবু আছে, আছে খাবার হিসাবে কিছু কাপ নুডুলস, ফ্লাক্সে গরম পানি, যেটা আমরা পাহাড়ে ওঠার আগে একটি খাবার দোকান থেকে ভরে নিয়েছি। আর আছে বড় এক বক্স ভারতীয় পনির ও কিছু শুকনো খাবার।
আমাদের 4x4 প্রায় নতুন হুন্দাই এসইউভিটা কিছুটা ধীর গতিতে চালিয়ে আমরা একটি সমতল এলাকা খুঁজছি যেখানে আমাদের তাঁবুগুলো পাতব। এর মধ্যেই বেশ বাতাস শুরু হয়েছে যা অসম্ভব ঠান্ডা। তার উপর দিয়ে শুরু হল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভাল যায়গা বলতে যা বোঝায় আমরা তার মান দ্রুত নামিয়ে আনলাম। রাস্তার ধারে একটা যায়গা একটু চওড়া মনে হওয়াতে আমরা সেখানেই গাড়ি থামিয়ে দ্রুত তাঁবু খাটাতে শুরু করলাম।
এত ঠান্ডা যে আমরা ঠিকমত কাজ করতে পারছি না। এর সাথে মনে ভয় যে আমাদের কারো তাবুই খুব বেশী ঠান্ডা বা চরম আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তবুও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে তাবু খাটানো শেষ হল। গাড়ির পেছনের হ্যাচ খুলে আমরা আমাদের ডিনার প্রস্তুত করলাম। সেটা শেষ করতে না করতেই বৃষ্টির ধারা বাড়তে লাগল। আমরা দ্রুত তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলাম তখন কেবল সন্ধ্যা নেমেছে।
পাহাড়ে তাঁবুর ভেতরে চারিদিক থেকে ঠান্ডা আসে এমনকি নিচে থেকেও। যত রকম পোশাক ছিল সেগুলো দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিজেকে উষ্ণ রাখাই এখন কাজ। কিন্তু ভয়ের কথা হল বৃষ্টি যেন বাড়তেই থাকল যেন বাংলাদেশে বর্ষা নেমেছে এবং যেটা থামার কোন নাম নেই। সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে এই ভ্রমণে আমরা চরম আবহাওয়া বা এক্সট্রিম ওয়েদার চিন্তা করি নাই। তাঁবু দিয়ে যদি পানি ঢোকে তাহলে সর্বনাশ। এই ঠান্ডায় নিজে সহ সব কিছু ভিজে গেলে সেটা জীবন মরণ সমস্যা। শেষ ভরসা হচ্ছে সব ফেলে গাড়িতে চলে যাওয়া।
সেই বৃষ্টি থামে না এবং তার ধারা বাড়তেই থাকল রাত দুটো পর্যন্ত। এর পর কমতে থাকলে ঘুমিয়ে গেছি। ভোরে ঘুম ভাঙ্গল তখন বেরিয়ে দেখি চারদিকে সব সাদা, তাপমাত্র ১ ডিগ্রির কম। সাথের বন্ধুকে ডাক দিলাম যে কফি বিশেষজ্ঞ। সাথে আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম আমার ইতালীয় এক বান্ধবীর উপহার দেয়া একটি মোকা পট। পরিবেশ যাই থাক সকালে গ্রাউন্ড বিনের গন্ধ আর একটু ভাল কফির কোন বিকল্প নাই।
ডেকে তুললাম আমাদের গাড়ির চালক, যে গাড়ির মালিক ও আমাদের গাইড, যে ঘুমিয়ে ছিল গাড়ির ভেতর। তাকে বললাম তুমি ছিলে খুব আরামে, আমরা এদিকে বৃষ্টি আর ঠান্ডায় ঘুমাতেই পারি না। সে বলল তোমাদের চেয়ে আমি অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এরকম বৃষ্টিতে এরকম এলাকায় পাহাড় ধ্বসে যায়। আমার গাড়ি ও তোমাদের তাঁবু তেমন ধ্বসে যাবার মত যায়গাতেই আছে। আমি দেখলাম যায়গাটা পাহাড়ের ধারে রাস্তার পরে একটি ঝুলন্ত ক্লিফের মত।
সকালেই আমরা তাঁবু তুলে উপরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। উঠতে উঠতে বাম দিকে পাহাড়ের ধারে ধারে জঙ্গলে দেখা মিলল হিমালয়ান মোনাল সহ হরক রকমের পাখি। আর ডানে কুয়াশা ভেদ করে ফুটে উঠল রোদে ঝকঝকে চুমি উপত্যকার পাহাড়ের শুভ্র সাদা চুড়াগুলো।
আমরা যখন পাহাড়ের চুড়ায় থারপালিং মঠে পৌঁছালাম তখন সূর্য বেশ উপরে। রোদ থাকলেও বেশ বাতাস এবং প্রচণ্ড, অসম্ভব ঠান্ডা। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম বেশ কয়েকটা হিমালয়ান মোনালকে। মন ভরে ছবি তুলে যখন আমরা একত্র হয়ে শীতে কাঁপছি যে এখন তো যেতে হবে। এরকম স্বর্গের মত পরিবেশটা ছেড়ে যেতেও মন চাইছে না। ওদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। গত সন্ধ্যায় ভাল করে আহার হয়নি। তার উপর রাতে যে ধকল। সকালেও খাবার সময় হয়নি। লোকালয়ে ফিরতে লাগব কয়েক ঘন্টা। এমন সময় দেখলাম গেরুয়া বসনে দুজন ভিক্ষু আমাদের দিকে আসছেন। ভাবলাম পাখির ছবি তুলতে গিয়ে যেভাবে আমরা উনাদের ধর্মীয় পবিত্র স্থানে যেখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করেছি, হয়ত অভিযোগ জানাতে আসছেন।
ভিক্ষু দুজন আমাদের কাছে এসে মাথা নুইয়ে সম্ভাষণ করে বললেন তাদের প্রধান ভিক্ষু আমাদের আমন্ত্রণ করেছেন তাদের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে, তিনি খুশি হবেন। তাঁরা আমাদের নিয়ে গেলেন একটি কাচ ঘেরা দোতালা হলরুমে যে ঘরটা যেমন আরামদায়ক তেমনই সুদৃশ্য, যেমন কাঠের প্যানেলের ভেতরটা তেমনই পাহাড়ের চুড়া ঘেরা বাইরের দৃশ্য। আমাদের বসিয়ে আহ্বান করলেন গরম গরম খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে। ওই ঠান্ডায় ওই রকম পরিবেশে এমন গরম সুস্বাদু খাবার যেন আমাদের বেহেশতি অনুভব দিল এবং ঈশ্বরের আশির্বাদের মত মনে হল। উনারা আমাদেরকে বলননি যে উনাদের ধর্ম কত ভাল আর উনারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ।
বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ এলাকা নিয়ে গঠিত প্রায় ৭০ ভাগ বন্য এলাকার ভুটানে মানুষ মাত্র সাত লাখ। এই ভুটানে আমরা যেখানেই গেছি, কখনও আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। গাড়ি নিয়ে রাতে যেখানে খুশি থেমেছি, যেখানে প্রয়োজন তাঁবু খাটিয়েছি এবং নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করেছি একমাত্র ভারতীয় সীমন্ত এলাকা ছাড়া। শহরের ট্রাফিক পুলিশ আর কিছু চেকপোস্ট ছাড়া আমার দেখিনি কোন পুলিশ বা সামরিক সদস্যদের।