পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া এই পিন্ডটি সোভিয়েত মহাকাশচারী ভ্লাদিমির কোমারভের দেহাবশেষ। ১৯৬৭ সালে তাঁর মাহাকাশযান স্যয়ুজ-১ এর নানা সমস্যা ও পরিশেষে প্রধান প্যারাসুট না খোলার কারনে যিনি মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে পড়ে গিয়েছিলেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কোমারভের অগ্নিদগ্ধ দেহাবশেষ যা সোভিয়েত কর্মকর্তারা তার শেষকৃত্যের সময় দেখছিলেন।
কোমারভ নিজে সহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই আগে থেকেই যেন বুঝছিলেন যে এমন কিছু ঘটবে। দুর্ঘটনাটি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার ৫০ তম বার্ষিকীর সাথে সম্পর্কিত ছিল। সেই সময় সোভিয়েত সরকার মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে সারা বিশ্বকে নাটকিয় কিছু দেখতে চাইছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের তখনকার একনায়ক লিওনিদ ব্রেজনেভ দুটি সোভিয়েত মহাকাশযানের মধ্যে একটি দর্শনীয় মধ্য-মহাকাশ ডকিং (দুটি মহাকাশযানের সংযোগ) দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন।
পরিকল্পনাটি ছিল একটির পর আর একটি এমন দুটি সোভিয়েত মহাকাশযান মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে এবং একটি নাটকীয় অরবিটাল ডকিং করা হবে যা মহাকাশচারীদের উভয় যানের মধ্যে চলাচল সম্ভব করবে।
প্রথম ক্যাপসুল লঞ্চ করা হবে স্যয়ুজ-১, যার ভিতরে একা কসমোনাট কোমারভ থাকবে। পরের দিন, একটি দ্বিতীয় যান স্যয়ুজ-২ আরো দুজন মহাকাশচারীসহ যাত্রা করবে। দুটি যান মহাকাশে কাছাকাছি যাবে, ডক করবে, কোমারভ এক যান থেকে অন্য যানের একজন কসমোনাটের সাথে স্থান বিনিময় করবে এবং দ্বিতীয় যানে তারা বাড়ি ফিরবে। ব্রেজনেভ এটাতে খুব উৎসাহী ছিলেন এবং স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে এটা অবশ্যই ঘটতে হবে।
কোমারভকে ১৯৬৭ সালে সয়্যুজ-১ কে কমান্ড করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, যেখানে ইউরি গ্যাগারিন তার ব্যাকআপ মহাকাশচারী হিসাবে ছিলেন। তাঁরা দুজনেই জানতেন যে সয়্যুজ-১ এর স্পেস ক্যাপসুলটি নিরাপদ নয়, তবে স্পেস প্রোগ্রামের সবাই মিশন বিলম্বিত বা বাতিলের বিষয়ে ব্রেজনেভের প্রতিক্রিয়ায় আতঙ্কিত ছিল। কোমারভ তার বন্ধুদের বলেছিলেন যে তিনি জানেন যে তিনি সম্ভবত মারা যাবেন। কিন্তু তবুও তিনি মিশনটিতে যেতে অস্বীকার করেননি কারণ গ্যাগারিন ছিলেন তাঁর বিকল্প। তিনি চাননি তাঁর বেঁচে থাকার বিনিময়ে সেরা বন্ধুদের একজন ইউরি গ্যাগারিন মারা যাক।
গ্যাগারিন ওই মিশনের এবং ক্যাপসুলগুলোর কয়েক ডজন ত্রুটি খুঁজে পান এবং মিশন স্থগিত করার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রশ্ন ছিল: সেটা ব্রেজনেভকে বলবে কে? গ্যাগারিন একটি ১০ পৃষ্ঠার মেমো লিখেছিলেন এবং এটি কেজিবিতে তার সেরা বন্ধু ভেনিয়ামিন রুসায়েভকে দিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই এটিকে চেইন অফ কমান্ড ভেঙ্গে পাঠাতে সাহস করেনি।
লঞ্চের আগে এক মাসেরও কম সময় যখন বাকি, কোমারভ বুঝতে পেরেছিলেন মিশন স্থগিত করা কোনও অপশন নয়। কেজিবিতে থাকা কোমারভের একজন বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাঁর উড্ডয়নে অস্বীকার করা উচিত। জেমি ডোরান এবং পিয়ার্স বিজোনির ‘স্টারম্যান’ বই অনুসারে, কোমারভ বলেছিলেন: "যদি আমি এই ফ্লাইটটি না করি, তবে তারা পরিবর্তে ব্যাকআপ পাইলটকে পাঠাবে" যিনি তিনি ছিলেন ইউরি গ্যাগারিন"।
লঞ্চের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছিল, সবাই আরও বেশি হতাশাবাদী হয়ে উঠছিল। এমন গুরুতর সমস্যা ছিল যা এই যানটিকে মহাকাশে নেভিগেট করা বিপজ্জনক করে তুলবে। প্রাক-পরীক্ষার ফ্লাইটগুলিও হতাশাজনক ছিল। যে প্রযুক্তিবিদরা সয়ুজ-১ পরিদর্শন করেছিলেন তারা ২০৩টি কাঠামোগত সমস্যা খুঁজে পেয়েছিলেন।
পরিশেষে সয়্যুজ-১ লঞ্চের সময় উপস্থিত হয় এবং গ্যাগারিন সম্পূর্ণ স্পেস গিয়ার পরে লঞ্চ প্যাডে উঠেছিলেন এবং ক্রুদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁরা তাকে ক্রাফটটি চালাতে দিতে পারেন, কিন্তু কোমারভ সহ অন্যান্য ক্রুরা তাকে সেটা দিতে অস্বীকার করেছিল এবং কোমারভ প্রায় নিশ্চিতভাবেই জেনেছিলেন যে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে।
.
উৎক্ষেপণের আট মিনিট পর কোমারভকে নিয়ে সয়্যুজ-১ কক্ষপথে পৌছায় এবং কোমারভ তখন পর্যন্ত উৎক্ষেপিত সবচেয়ে জটিল মহাকাশযানগুলির একটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ঠিক তখনই সমস্যাটি শুরু হয় যখন সয়্যুজ-১ এর দুটি সৌর প্যানেলের একটি খুলে স্থাপিত হতে ব্যর্থ হয়। বিদ্যুতের ঘাটতি নেভিগেশন ও যোগাযোগের যন্ত্রপাতিগুলোকে অকার্য্যকর করে তোলে।
সয়্যুজ-১ তার অক্ষের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে এবং কোমারভ যখন সমস্যাটি সংশোধন করার চেষ্টা করে তখনই সেটি আরও বেশি জোরে ঘুরতে শুরু করে। তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়, ভূমির সাথে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং বিদ্যুতের অভাব নেভিগেশন ব্যবস্থাকে কাজ করতে বাধা দেয়। এই সমস্ত সমস্যা দেখে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সয়্যুজ-২ উৎক্ষেপন বাতিল করে এবং প্রথম সুযোগেই কোমারভকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কোমারভ পাঁচ ঘন্টার জন্য সয়ুজ মডিউলটিকে ভূমি অভিমুখী করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। নেভিগেশন, যোগাযোগ ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছিল না।
প্রশিক্ষণে তিনি কখনই অনুশীলন করেননি এমন পদ্ধতি ব্যবহার করে, ম্যানুয়্যালি কোমারভ মহাকাশযানকে এলাইন করতে সমর্থ হন এবং নিজেই রেট্রোরকেটগুলিকে ফায়ার করতে সক্ষম হন ফিরে আসার পুনঃপ্রবেশ (রি-এন্ট্রির) এর জন্য। মিশন বাঁচাতে তার বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছিল। তিনি সফলভাবে তার ১৯ তম কক্ষপথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করেছিলেন।
ক্যাপস্যুলটি বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে নেমে আসার সাথে সাথে ড্র্যাগ প্যারাসুটটি খুলে যায় কিন্তু মূল প্যারাসুটটি তার পাত্রে অনড় থাকে, সেটা খুলে যেতে বা ডিপ্লয় হতে ব্যার্থ হয়। মূল প্যারাসুটটি না খোলার ফলে যখন রিজার্ভ প্যারাসুটটি খুলতে যায়, তখন সেটি মূল প্যারাসুটের ড্র্যাগ স্যুটের দড়িতে জট পাকিয়ে যায়। ফলে রিজার্ভ প্যারাসুটটিও ডিপ্লয় হতে ব্যার্থ হয়। ফলে সয়ুজ-১ সকাল ৭ টায় ওরেনবার্গের স্টেপে প্রচণ্ড গতিতে বিধ্বস্ত হয়, এতে কোমারভ নিহত হয়। আঘাতে ক্যপসুলটি বিস্ফোরিত হয় এবং যখন সোভিয়েত এয়ার ফোর্স পুনরুদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছায় তখন তারা দেখতে পায় সেটা একটি জ্বলন্ত ধাতব পিন্ড।
কোমারভ যখন তার সর্বনাশের দিকে যাচ্ছিল, তখন তুরস্কের মার্কিন রেডিও মহাকাশ পোস্টগুলি তাকে ক্রোধে কাঁদতে শুনেছিল, "সে তার লোকদের অভিশাপ দিচ্ছিল যারা তাকে একটি জঘন্য মহাকাশযানের ভিতরে পুরে রেখেছিল"। তিনি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল আধিকারিকদের বলেছিলেন যে তিনি জানেন যে তিনি মারা যেতে চলেছেন। সোভিয়েত প্রিমিয়ার আলেক্সি কোসিগিন তখন রেডিও ফোনে তাকে বলে যে তিনি একজন নায়ক।
ইউরি গ্যাগারিন দুর্ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে প্রাভদাকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে সেই কর্মকর্তাদের তীব্র সমালোচনা করেন যারা তার বন্ধুকে উড়তে পাঠিয়েছিল। এর পর ১৯৬৭ সালের গ্যাগারিন ১৯৬১ সালের চিন্তাহীন যুবক থেকে অনেক আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। কোমারভের মৃত্যু তার কাঁধে অপরাধবোধের একটি বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল।
এক পর্যায়ে গ্যাগারিন বললেন, "আমাকে অবশ্যই নেতার (ব্রেজনেভ) সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে যেতে হবে"। তিনি গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন যে তিনি ব্রেজনেভকে কোমারভের উৎক্ষেপণ বাতিল করতে রাজি করাতে সক্ষম হননি। কোমারভের মৃত্যুর এক বছর পর, একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে ইউরি গ্যাগারিন মারা যান। এর পর থেকে সোভিয়েত মিশনগুলো ছিল ব্যর্থতায় ভরা।
একনায়কতন্ত্রে সবকিছুই কোন না কোন ভাবে সুপ্রিম কমান্ডাারের মেজাজ মর্জি বা ইমেজের সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং এভাবেই একনায়কতন্ত্র একটি দেশের উদ্ভাবন, দেশপ্রেম ও উদ্দিপনায় পূর্ণ ক্রিয়েটিভ মানুষদের উৎসাহকে হতাশায় পরিণত করে। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবার চেয়েও, “ব্রেজনেভকে বলবে কে” সেই সমস্যা বড় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি স্যাংচুয়ারি এলাকা বৃদ্ধি ও তিনমাস বন্ধের কারণে যে আমাদের সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কতৃপক্ষের বেশিরভাগ লোক সেটা বুঝলেও, “ব্রেজনেভকে বলবে কে” সেই ভীতিই সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।