EN
আরও পড়ুন
মানসিক সমৃদ্ধি ও সম্পর্ক
দাপুটে পুরুষের আবেগ নিয়ে খেলা করার সমাজে
রাজনীতি
ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে
রাজনীতি
১৯৭৫ থেকে ২০২৪ - যত আত্মঘাতী কর্মকান্ড:
রাজনীতি
একমাত্র সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পাকিস্তান ছাড়া
JadeWits Technologies Limited
চলচিত্র

দারসু উজালা:

প্রাচীন প্রাকৃতিক জাতিগত মানসিকতা বনাম সামরিক আদর্শের শহুরে মানসিকতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সংঘাতটা চলছে সেই পাকিস্তান স্বাধীন হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত, সেটা হল পশ্চিমা শহুরে আদর্শের সামরিক শক্তির সাথে প্রাচীন প্রাকৃতিক জাতিগত মানসিকতার দ্বন্দ্ব। ধর্ম, ভারত বিরোধীতা, সমাজতন্ত্র বনাম ধনতন্ত্র সহ এটাকে নানা রকম লেন্স দিয়ে দেখা হলেও আমার মতে গভীরতম দ্বন্দ্বটি হচ্ছে পশ্চিমা শহুরে মানসিকতার সাথে বাঙ্গালী জাতিগত মানসিকতার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

একটি সমাজে মানুষকে একত্র, সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ ও উৎপাদনমুখি রাখার উপায় কি? ধনতন্ত্রের মত বিশ্বব্যাপী মুনাফার জন্য জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেওয়া? নাকি সম্পদের সুষম বন্টনের আদর্শে জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেওয়া সমাজতন্ত্র? গত শতাব্দীতে আমরা দুটোরই চরম বিকাশ দেখেছি এবং একটির পতন হয়েছে ও আর একটি পতনের দ্বারপ্রান্তে।
 
এই পতন কেন? মনোবিদ্যার দৃষ্টিকোন থেকে এই ব্যর্থতার কারণ দার্শনিক বোধ ও সুক্ষ্ম জীবনবোধের অক্ষমতা। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার সরকার খুব ভাল করে বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন যে চরম বিকশিত সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মূল কারণ সমাজতন্ত্রের নামে সোভিয়েত দেশগুলোর জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি বিসর্জন। পুতিন এবং তার সরকার তাই চেষ্টা করছেন কিভাবে প্রাচীন রাশিয়ার সেই জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা যায় যাতে মানুষের দার্শনিক সক্ষমতা ও সুক্ষ্ম জীবনবোধের চর্চা ফিরিয়ে আনা যায়।
 
আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয়তাবাদ ও প্রাচীন সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে নিয়-লিবারেলিজমকে বেছে নেয় যেটা আসলে সংস্কৃতিহীনতা। এশিয়ায় আমেরিকার শ্রমদাস রাষ্ট্রগুলো যেমন জাপান কোরিয়া এরাও একই পথ ধরে। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও সমাজ অবক্ষয়ে ধ্বসে পড়তে থাকে। পুঁজিবাদের পতনের মুখে এসে আমাদের দেশেও জাতীয়তাবাদ ও প্রাচীন সংস্কৃতি নির্মূলের চেষ্টা শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যে একে প্রতিহত করতে হবে। 

শহুরে আদর্শের সামরিক মানসিকতার সাথে প্রাচীন প্রাকৃতিক জাতিগত মানসিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে জাপানী পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার একটি চমৎকার সিনেমা আছে দারসু উজালা (Dersu Uzala) নামে। ছবিটির রিলিজের সাল ১৯৭৫ এবং ভাষা রাশিয়ান।           
দারসু উজালা

দারসু উজালা সিনেমাটি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভ্লাদিমির আরসেনিভের একটি অনুসন্ধানী অভিযান এবং তার সঙ্গী দারসু উজালার জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এই সিনেমাটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, প্রাচীন প্রাকৃতিক জীবন এবং আধুনিক সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের ওপর আলোকপাত করে।

১৯০২ সালে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভ্লাদিমির আরসেনিভের নেতৃত্বে একটি দল সাইবেরিয়ার দুর্গম অঞ্চলে মানচিত্র তৈরির উদ্দেশ্যে একটি অনুসন্ধানী অভিযানে বের হয়। এই অভিযান চলাকালীন, তারা একটি অদ্ভুত পায়ের ছাপ খুঁজে পায় যা তাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। তখনই তাদের দেখা হয় দারসু উজালা, একজন বয়স্ক স্থানীয় শিকারী এবং পথপ্রদর্শকের সঙ্গে।

দারসু প্রথমে আরসেনিভের দলের সদস্যদের চোখে একজন সাধারণ, বয়স্ক মানুষ বলে মনে হয়। অনেকেই তাকে অবজ্ঞা করে এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে থাকে। তারা তাকে একজন "পুরনো বোকা" এবং অযথা বাড়াবাড়ি করে এমন লোক হিসেবে দেখে। তবে ক্যাপ্টেন আরসেনিভ প্রথম সাক্ষাতেই বুঝতে পারেন যে দারসু একজন বিশেষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি প্রকৃতির গভীর জ্ঞান এবং তার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করেন।

দারসু দলে যোগ দেওয়ার পর, তিনি খুব দ্রুত তার অসাধারণ প্রাকৃতিক জ্ঞান ও দক্ষতার প্রমাণ দেন। তিনি বাতাসের দিক পরিবর্তন, গাছের পাতার আওয়াজ, এবং পশুদের পায়ের ছাপ দেখে পরিবেশের পরিবর্তন অনুমান করতে পারেন। তার এই দক্ষতা প্রমাণিত হয় যখন একদিন দলের সদস্যরা শীতের কঠোর অবস্থায় আটকে পড়েন এবং দারসু তাদের দ্রুত একটি অস্থায়ী আশ্রয়স্থল তৈরি করে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করেন।

যখন দলের সদস্যরা দারসুর প্রাকৃতিক জ্ঞান ও দক্ষতা দেখতে শুরু করেন, তখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। যারা আগে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিল, তারাই এখন তাকে গুরুতুল্য ভাবে দেখতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারে যে দারসু শুধু একজন শিকারী নন, তিনি প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রকৃতির নিয়মের ওপর নির্ভরশীল।

অভিযানের দিনগুলোতে দারসু এবং ক্যাপ্টেন আরসেনিভের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটে। দারসু আরসেনিভকে শেখান কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকতে হয় এবং প্রকৃতির ভাষা বুঝতে হয়। তিনি তাকে শেখান যে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেবল শিকার ও সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মধ্যেও একটি গভীর মানবিকতা ও দার্শনিকতা রয়েছে।

দারসুর জীবন দর্শন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলেমিশে থাকা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির প্রতিটি সত্তা একটি জীবনের অংশ এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি আরসেনিভের মনেও গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি দারসুর প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা অনুভব করতে শুরু করেন।

অভিযান শেষে, ক্যাপ্টেন আরসেনিভ এবং তার দল শহরে ফিরে আসে। আরসেনিভ দারসুকে তার সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। যদিও দারসু প্রথমে রাজি হননি, শেষ পর্যন্ত তিনি আরসেনিভের অনুরোধে শহরে আসেন। শহরে এসে দারসু শহরের জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না; তিনি শহরের কোলাহল, যান্ত্রিকতা, এবং প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন দেখে ভীষণ অস্বস্তিতে ভোগেন।

শহরে দারসুর থাকার সময়, ক্যাপ্টেন আরসেনিভ দারসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে তাকে একটি নতুন রাইফেল উপহার দেন। পুরনো রাইফেলটি ভেঙে যাওয়ায় শিকারের জন্য নতুন রাইফেলটি দারসুর খুব দরকার ছিল। এই রাইফেল উপহার দেওয়ার সময় ক্যাপ্টেন আরসেনিভ দারসুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা দেখান এবং দারসুর জন্য একটি বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকে।

শহরের যান্ত্রিক ও কৃত্রিম জীবন থেকে দারসু ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং নিজের প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আরসেনিভ তাকে বিদায় জানান এবং তার নিরাপদ যাত্রার জন্য অর্থ ও রাইফেল উপহার দেন। কিন্তু, প্রকৃতিতে ফিরে গিয়েও দারসুর জীবন আর আগের মতো ছিল না।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারসুর দৃষ্টি শক্তি কমতে শুরু করে, যা তার জন্য শিকার করা কঠিন করে তোলে। নতুন রাইফেলটি ব্যবহার করতে তার আরো অসুবিধা হয়, কারণ তার দৃষ্টিশক্তির অবনতি হয়। একদিন, যখন দারসু শিকারে বের হয়েছিলেন, একজন অপরিচিত ব্যক্তি তার নতুন রাইফেলটি দেখে লোভে পড়ে এবং সেটি ছিনতাই করে। দারসু তার প্রিয় রাইফেল হারিয়ে ফেলে এবং আত্মরক্ষা বা শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

দারসু তার রাইফেল হারিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। রাইফেলটি ছিল তার জীবিকার একমাত্র উপায় এবং এটি হারানোর ফলে তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও বিপদাপন্ন হয়ে ওঠেন। এই অবস্থায়, দারসু একা একা বনে ঘুরতে ঘুরতে মারা যান।

দারসুর এই মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং আধুনিক জীবনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতার মধ্যে একটি গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। দারসু যে রাইফেলটি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, সেটিই পরবর্তীতে তার জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠে। এটি দেখায় যে কখনও কখনও আধুনিক জীবনের বস্তুগত জিনিসগুলি প্রকৃতির সহজ ও নির্ভরযোগ্য জীবনের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।