আগের পর্ব: ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -১
সাত বছর বয়সী রোহান দিনের বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার বা মোবাইলে গেম বা ইউটিউব ভিডিও দেখে কাটায়। ইউটিউব রোহানের খাদ্যভ্যাসও পরিবর্তিত করে দিয়েছে। পিজ্জা, বার্গার এবং কোক ছাড়া সে আর কিছু খেতে চায় না। রোহান পানির বদলে কোক খায়। সাত বছর বয়সী রোহানের দেহটি দেখে মনে হয় না তার বয়স সাত বছর। তার ওজন বারো বছরের শিশুর সমান। রোহানের মায়ের সাথে বিয়ের আগে রোহানের বাবা জার্মনিতে থাকত। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে সে দেশে ফিরে একটি বড় কোম্পানীতে চাকুরি পায়। বিয়ের আগে রোহানের বাবা অনেক সামাজিক ছিল। ছুটির দিনে তার বাসায় আড্ডা বসত বন্ধুদের সেখানে গল্প বিতর্ক হত নানা বিষয়ে হাতে থাকত বিয়েরর ক্যান বা কোন হার্ড লিকারের গ্লাস। গল্প বিতর্কই ছিল আনন্দ, খাওয়াটা হত শুধুই প্রয়োজনে।
বিয়ের পর রোহানের বাবাকে মদ্যপান পরিত্যাগ করতে হয়েছে, তার স্থানে এসেছে কোক, মিষ্টি এবং পোলাও কোর্মা। রোহানের বাবা এখনও সামাজিক কিন্তু এখন ছুটির দিনে তার বাসায় যে মেহমানরা আসে গল্প বিতর্কে তাদের অ্যাড্রিনালিন রাশ হয় না। পোলাও কোর্মা মিস্টি আর কোক তাদের লক্ষ্য। সফল ও সচ্ছল রোহানদের পরিবার শীঘ্রই মারাত্মক সঙ্কটে পড়বে। রোহানের টাইপ-১ ডায়াবেটিস ধরা পড়বে এবং ডায়াবেটিসে ভোগা রোহানের বাবার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যাবে।
রোহানের বাবা বা মা রাজনীতি বা ধর্মের গভীরতা নিয়ে উৎসাহী নয়। ছোট বেলা থেকেই তারা তাদের জীবনে সবচেয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এবং পরবর্তিতে পেশাগত দক্ষতায়। কিন্তু রোহানদের পরিবার তাদের খাদ্য, পানীয় এবং জীবনাচারণ পরিবর্তনের জন্য শীঘ্রই মারাত্মক সঙ্কটে পড়বে তার পেছনে রয়েছে ষাটের দশকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং সত্তুরের দশকের শেষের দিকে পাকিস্তনের বিরোধী দলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর দুটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
সত্তুরের দশকের শুরুতে অন্যায়ভাবে শুরু করা ভিয়েতনাম যুদ্ধে তখন পরাজয়ের মুখে আমেরিকা। যুদ্ধের কারনে মার্কিন অর্থনীতির তখন ভঙ্গুর অবস্থা। এখনকার মতই একদিকে মূদ্রাস্ফীতি এবং অপর দিকে মন্দা মিলে স্ট্যাগফ্লেশন চলছে। সাধারন মানুষ বিপর্যস্ত এবং যুদ্ধের বিপক্ষেও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে অনেক মানুষ। গণ আন্দোলনে সরকার পতনের ভয়ে ভীত তখন নিক্সন-কিসিঞ্জার সরকার। জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিদের ডেকে সারা দুনিয়ার তথ্য ঘেঁটে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হল গণ আন্দোলনে সরকার পতনের কারনগুলো। সারা দুনিয়ার তথ্য ঘেঁটে তারা জানালো শত সমস্যা থাকলেও মানুষ পুলিশের বন্দুকের সামনে সরকার পতনের আন্দোলনে আসে না যদি হাতে খাবার কোনার টাকা থাকে বা তাদের ক্ষুধার সমস্যা থাকে। এই রিপোর্ট পেয়ে দুটি কাজ করল নিক্সন-কিসিঞ্জার জান্তা। এক ১৯৭১ সালে তারা টাকার সাথে বাস্তব সোনার যে স্থিতি সম্পর্ক সেটা উঠিয়ে দেয় যাতে ইচ্ছামত টাকা ছাপানো যায়। দুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যে তারা বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া শুরু করে। হাতে অনেক টাকা আর দোকানে সস্তা খাবার থাকলে সরকার আর রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াস হয় না মানুষ এটাই প্রমাণিত হয়।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না নিক্সন-কিসিঞ্জার জান্তা। সস্তায় এবং দ্রুত পেট পুরে এমন খাবার আবিষ্কারে কোটি কোটি ডলার গবেষনা তহবিল ঘোষনা করা হয়। গবেষকরা নেমে পড়েন দ্রুত পেট পুরে এমন খাবার আবিষ্কারের নেশায়। আবিষ্কৃত হয় ফাস্ট ফুড ও পত্তন হয় ফাস্ট ফুড যুগের। এই প্রণোদনায় আবিষ্কৃত হয় সস্তা ভুট্টা থেকে হাই ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ নামে একটি মিষ্টি জাতীয় পদার্থ যেটি চিনির চেয়ে প্রায় দেড় গুন মিষ্টি এবং দামে প্রায় অর্ধেক। সুচনা হয় কোমল পানীয় বিপ্লবের। সেই থেকে এখনও আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারের নেশায় মত্ত আরো সস্তায় মিষ্টি ও সাদা কার্বোহাইড্রেটের ফার্স্ট ফুড গবেষনায়। অপর দিকে মিষ্টি ও সাদা কার্বোহাইড্রেটের ফার্স্ট ফুডের ক্ষতির দিকে নিয়ে গবেষনায় করা হয় অনুৎসাহীত। এসব নেতিবাচক দিক নিয়ে গবেষনা করলে নাম কেটে যায় গবেষণা তহবিলের তালিকা থেকে।
১৯৭৭ সালের জানুয়ারীতে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে ভুট্টোর পিপিপি ২০০ আসনের ১৫৫ আসনে জয়ী হয়ে ভুট্টো ক্ষমতায় এলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট চুরির অভিযোগ আনা হয়। এরই ফলস্রুতিতে মৌলবাদী দলগুলো সংগঠিত হয়ে একটি এলায়েন্স তৈরী করে পাকিস্তান ন্যাশনাল এলায়েন্স বা পিএনএ নামে। পিএনএ শ্লোগান দেয় ভুট্টো মদ্যপায়ী, মাতাল, ভুট্টো নিপাত যাক। এর জবাবে ভুট্টো জনসভায় দম্ভ করে বলে “হ্যাঁ ম্যায় শরাব পিতা হুঁ, মাগার আওয়াম কা খুন নেহি পিতা” (হ্যাঁ আমি মদ খাই, কিন্তু জনগনের রক্ত খাই না)।
১৯৭৭ এর এপ্রিলে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএনএর সদস্যদের কিছু জামাত মুজাহিদ কর্মী লাঠি হকি স্টিক নিয়ে করাচির রাস্তায় দুটো মদের দোকানে ভাংচুর করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে ছাত্ররা দোকান ভাংচুর করলেও মদের বোতলগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসা ভুট্টো আন্দোলনটাকে শুরুতেই ঠান্ডা করার জন্য রাতারাতি এক অর্ডার জারি করে খোলামেলা মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করে। এর আগে পাকিস্তানে দোকানে মদ পাওয়া যেত। ভুট্টো এটা নিষিদ্ধ করলেও এটির প্রয়োগে যায়নি সেই কারণে এটা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল না। কারন সংস্কৃতিগত কারণে পাকিস্থানে বা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে মদ্যপান হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত। একটা রাজনৈতিক খেলা খেললেও সে সেটার প্রয়োগ চায়নি।
মদ নিষিদ্ধ করেও ভোট চোর ভুট্টো ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ঐ বছরই ভুট্টোকে সরিয়ে জিয়াউল হক ক্ষমতা নিয়ে নেয়। সে এসে ইসলাম পন্থীদের সাথে নেয় তার অবস্থান পাকাপোক্ত করতে। ঐ সময় সে ভুট্টোর নিষিদ্ধ করা অর্ডিনেন্সের প্রয়োগ জিয়াউল হক শুরু করে মদ আইন লঙ্ঘনকারীদের ৮০ ঘা চাবুক প্রয়োগের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে জিয়াউল হকের জান্তা সে দেশের সেক্যুলার, ট্রাডিশনাল, পশ্চিমা আধুনিক পন্থী ও বামপন্থীদের অপদস্থ করা ও বিব্রত করার জন্য মদকে ব্যবহার শুরু করে। জিয়াউল হকের এই আচরনের আসল কারণ সৌদি অর্থের লোভ যেটা তারা হাসিল করে মুসলিম বিশ্বকে দেখিয়ে যে পাকিস্তান কতটা মুসলিম যখন সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে। তখন আমেরিকাও মুসলিমদের পরম বন্ধু মনে করত কারণ মুসলিমরা নীতিগতভাবে সমাজতন্ত্রকে ঘৃণা করে। নয়া শরীয়াহ আইনের পাকিস্তানকে তারা উদার হস্তে সহযোগীতা করেছে। পেট্রো ডলার নির্ভর ইসলামী রাজনীতিই আকার দিয়েছে আমাদের পরবর্তী ধর্ম শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের।
মদ ও চিনি উভয়ই নেশা তৈরী করে। উভয় নেশাই একইভাবে মস্তিষ্কে আকাঙ্ক্ষা (craving) তৈরী করে। যখন আমরা বোর ফিল করি, কিছু একটা করতে চাই তখন একটি না পেলে আমরা অপরটি দিয়ে সেই নেশা মেটাই।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র (হরমোন নিঃসরণ গ্রন্থির কার্যক্রম) বিশেষজ্ঞরা বলছেন চিনি বা সুক্রোজ খাবার পর সেটা ভেঙ্গে পরিণত হয় গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজে। গ্লুকোজ শক্তি তৈরি করে। সেই শক্তি খরচ না হলে সেটা পেটে ও চামড়ার নিচে চর্বি হিসাবে জমা হয়। কিন্তু ফ্রুকটোজ সরাসরী লিভারে চলে যায় এবং সেটা অতিরিক্ত হয়ে গেলে এন্ডোক্রাইন সিস্টেম ও তার নিউরাল সংকেতে গোলমাল সৃস্টি করে। এর ফলে খেলেও আর ক্ষুধা কমে না। তৈরি হয় অপ্রয়োজণীয় মাত্রায় হরমোন। শরীর তৈরী করে হরমোন রেজিস্টেন্স এর ফলে শরীরে প্রতিটি কোষের মাইট্রকান্ড্রিয়া (যেটা শক্তি তৈরি করে) হয়ে যায় অসুস্থ। এটাই ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা।
এর ফল শুধু ডায়াবেটিস নয়, ক্যান্সার ও হৃদরোগও। কারণ এন্ডোক্রাইন সিস্টেম ও বিপাকপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত নিউরাল সংকেতে গোলমাল সৃস্টি হলে শরীরের কোষ গুলোর অতিবৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরী হয় যেটা ক্যান্সারের সূচনা ও ক্যান্সার কোষের দ্রুত বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করে। ফ্রুকটোজের আধিক্য এবং এন্ডোক্রাইন সিস্টেমে গোলমালের ফলে ফলে হয় ফ্যাটি লিভার। ধমনীর ভেতরে জমে চর্বি যার ফলে বৃদ্ধি পায় করোনারী হৃদরোগের মত সমস্যা।
এভাবে চলতে থাকলে দ্রুতই মুসলিম বিশ্বে বেশীরভাগ মানুষ এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের গোলযোগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো যেমন ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হবে। বাড়বে করোনারী হৃদরোগ ও ক্যান্সারের বিস্তার ব্যপকভাবে।
নিক্সন-কিসিঞ্জার এবং ভুট্টো-জিয়াউল হকের এইসব রাজনীতির খবরাখবর রাখা কখনই প্রয়োজন মনে করেননি রোহানের বাবা মা। কিন্তু দূর দুরান্তের ওইসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই প্রভাব ফেলেছে রোহানের বাবা মায়ের ধর্মীয় মূল্যবোধে এবং পরিবর্তীতে জীবনাচারন ও পরিণতিতে। ধর্ম ও রাজনীতিকে না বোঝার ফলে নিক্সন কিসিঞ্জারের গদি রক্ষার রাজনীতি ধর্মকে বক্র করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মানুষকে খুশি রাখার আমেরিকান রাজনৈতিক অস্ত্র ভুট্টো জিয়ার বদৌলতে উপমহাদেশের পরিবারের শিশুগুলোকে খুশি রাখার নেশায় পরিণত হয়েছে যার কারণ মনের আনন্দ থেকে স্বাদের আনন্দে পারিবারিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
পরের পর্ব: ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -৩