বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কী তার লেখা “রেমিনিস্যান্স অব লিও নিকোলায়েভিচ টলস্টয়” সংকলনে লিখেছেন একটি ঘটনার কথা। একবার তিনি আর এক বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক লেভ টলস্টয়ের সাথে দেখা করতে গেছেন তার বাড়িতে। সেখানে কথায় কথায় হঠাৎ টলস্টয় প্রশ্ন করলেন গোর্কীকে:
টলস্টয়: “আচ্ছা, ঈশ্বরের প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই কেন”?
গোর্কী: “কেন সেটা এক কথায় বলতে পারব না, তবে আমি নাস্তিক”।
টলস্টয়: “না না তুমি কিছুতেই নাস্তিক হতে পার না। যাই ভাবো না কেন, একদিন তার (ঈশ্বরের) কাছে ফিরে আসতেই হবে। জোর করে তুমি নিজেকে নাস্তিক মনে করছ। কারণ তোমাকে (কষ্ট) সইতে হয়েছে ঢের। কিন্তু এটা কখনো ভেবো না যে পৃথিবীটা তোমার ইচ্ছা মতই চলবে। অনেকে বাহাদুরি পাবার জন্য নিজেকে নাস্তিক মনে করে। বয়স যাদের কম তাদেরই সাধারণত এই মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। হয়ত কোন মেয়েকে তারা ভালোবাসে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারে না। ভয়, সেই সাথে দুর্ভাবনা, মেয়েটি যদি তার ভালবাসার মূল্য না দেয়? অথচ তারা জানে না বস্তুহীন ভালবাসা আসলে অর্থহীন। প্রেমিককেও হতে হবে বিশ্বাসীর মত নির্ভীক। একবার সাহসের সাথে বলতে হবে - বিশ্বাস করি। ভালবাসার আসল আদর্শ হল বিশ্বাস। যার বিশ্বাস নেই সে কখনও ভালোবাসতে পারে না। আত্মা তার ভবঘুরের মত। তুমি তো কিছুতেই এমনটা হতে পার না। তুমি বিশ্বাসী হয়েই জন্মেছো। মিথ্যা দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা তোমার বৃথাই।"
চার্লস ডারউইন যখন বিবর্তবাদ নিয়ে লেখেন তখন সেটা খ্রিস্ট ধর্মের বিপক্ষে যায় এবং খ্রিস্ট ধর্মের সমর্থকেরা ডারউইনকে নাস্তিক বলে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু ডারউইন কি কখনও নাস্তিক ছিলেন বা নাস্তিক্যবাদ প্রচার করেছেন? কখনও না। ৪০ বছর পর্যন্ত ডারউইন পুরাদস্তুর খ্রিস্টান ছিলেন, তারপর খ্রিস্ট ধর্মের ঐতিহাসিক শুদ্ধতা নিয়ে তার মনে সংশয় এলেও নাস্তিক তিনি কখনোই ছিলেন না। তিনি আজীবন ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে গেছেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন "একজন মানুষ একই সাথে বিশ্বাসী এবং বিবর্তনবাদী হতে পারে।" তিনি আরও বলেছেন "আমার মনের চরম বিচ্যুতিতেও কখনও আমি নিজেকে নাস্তিক ভাবিনি বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করিনি - তবে বয়স যত বেশি হয়েছে বিষয়টাতে আমি অজ্ঞ বলেই বেশিরভাগ সময় নিজের কাছে মনে হয়েছে।"
মহাজগতের আকার ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সার্চ ফর এক্সট্রা টেরিসট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স (SETI) প্রকল্পের প্রধান মহাকাশ বিজ্ঞানী কার্ল সেগান বিশ্বাস করতেন যে এই পৃথিবীর বাইরেও মহাজগতের অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হল ঈশ্বর কি আছেন? আপনি কি নাস্তিক? কার্ল সেগান উত্তর দিলেন “নাস্তিক হবার জন্য নিশ্চিত প্রমাণ চাই যে ঈশ্বর নেই, তেমন প্রমাণ আমার কাছে নেই। ঈশ্বর আছেন কি নেই সে প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে যে পরিমান জ্ঞানের প্রয়োজন - তা আমাদের এখনও নেই।”
আমাদের চারপাশে আজ অনেক স্ব-ঘোষিত নাস্তিক। যে ব্যক্তির কাছে ধর্ম বা ধর্মের দর্শন একটা গবেষণার বিষয় বা জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য যে ব্যক্তিগত দর্শনের সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত সেই ব্যক্তি হয়ত এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে যে ঈশ্বর নেই। তারা ছাড়া আর যারা ভাবে ঈশ্বর নেই তারা আসলে বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবে না। পড়াশোনাও করে না। সেই টলস্টয় যেমন গোর্কিকে বলেছিলনে তেমন করেই হয়ত জোর করে তারা নিজেকে নাস্তিক মনে করছ। কারণ তাদেরও হয়ত অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে। তারাও অনেকে হয়ত বাহাদুরি পাবার জন্য নিজেকে নাস্তিক মনে করে। বয়স যাদের কম তারা হয়ত কোন মেয়েকে ভালবাসে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছে না। ভয়, সেই সাথে দুর্ভাবনা, মেয়েটি যদি তার ভালবাসার মূল্য না দেয়? তাদের মনের কথা ঈশ্বর শুনছে না, ঈশ্বর কিছু করছেন না তাই তারা নাস্তিক। তাই তারা ঈশ্বর সম্পর্কে ভেবে নয়, গবেষণা করে নয়, দার্শনিক সিদ্ধান্ত থেকে নয়, তারা যেন অগভীর যুক্তি-তর্ক আর গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে ঈশ্বর নেই।
মনোবিদ্যায় একটি টার্ম আছে অটোমেটিক থিংকিং। এটা হলো কোন চিন্তা না করে ধারণা করা। যেমন “রাজনীতিবিদেরা খারাপ”, “পুরুষ মানেই সে যৌন দৃষ্টিতে দেখে” “ইসলাম মানেই সন্ত্রাস” এইসব ধারণার ভিত্তিতে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করা বা মতামত প্রকাশ করা। অর্থাৎ তার চিন্তার স্বতঃসিদ্ধগুলো ভিত্তিহীন। পত্রিকার হেডিং, সামাজিক মাধ্যমের স্টাটাস, টিকটক ক্লিপ, টিভি টক শো, সস্তা সাহিত্য। অগভীর দর্শন বক্তৃতা, উড়ো গুজব, উড়ো কথা, মুখরোচক সমালোচনা। ঐ বিষয় সম্পর্কে নির্বোধ খ্যাতনামা ব্যক্তিদের উক্তি – এসব থেকেই চিন্তা ভাবনায় অনভ্যস্ত ব্যক্তির মনে দৃঢ় হয় অটোমেটিক থিংকিং। আজ সমাজে যারা নাস্তিক্য নিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে নেমেছে তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে নাস্তিক্যও একটি অটোমেটিক থিংকিং।
ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিষয়টা মানুষের মনে সব বয়সে একরকম থাকে না। পারিবারিক বিশ্বাস থেকে এক ধরণের গভীর বিশ্বাস মানুষের মনে বাসা বাঁধে। কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকালে এসে যখন ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে তখন বাবা, মা, পরিবার, সমাজ এমনকি ধর্ম ও ঈশ্বর – সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বিরোধ বাধে এবং তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এক ধরণের বিদ্রোহ তৈরী হয়। এটা স্বাভাবিক। বয়ঃসন্ধি পার হয়ে পরিণতি লাভ করলে তখন একদিকে যেমন সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অপর দিকে জীবনের বাস্তবতাকে আরও অনেক পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পারে। তখন তার সেই বয়ঃসন্ধিকালের ক্ষোভ ও অসহায়ত্ব চলে যায়। তখন সে নিজের অজ্ঞতা ও সামর্থকে মেনে নেয়। ঈশ্বর তার কোন প্রার্থনা শুনছেন না বলে তিনি নেই – এই রাগ আর সে পুষে রাখে না। নিজেকে বাদ দিয়ে সারা দুনিয়া কিভাবে চলছে সেটা দিয়ে সে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত করে। আর যদি সে প্রকৃতিবিজ্ঞান বা দর্শনের ছাত্র হয়, তখন সারা দুনিয়া কিভাবে চলছে তার তত্ত্ব অনুসন্ধানে নিয়োজিত হয়।
কিন্তু কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকালে এসে যখন ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে তখন অনেকে থাকে খুবই ভীত ও কাপুরুষ। কৈশোরে যখন ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে তখন বাবা, মা, পরিবার, সমাজ এমনকি ধর্ম ও ঈশ্বর – সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যখন বিরোধ বাধে এবং তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এক ধরণের বিদ্রোহ তৈরী হয়, ভীত ও কাপুরুষেরা সেই বিদ্রোহে নিজেকে সাহস করে সমর্পণ করতে পারে না। পরিবার থেকে শিশুকালের যে গভীর বিশ্বাস, সেটাকেই তারা জোর করে পোশাকের মত সারা জীবন পরে থাকতে চায়। সব সময় তাদের অবচেতনে ভয় যে যখন তখন যে কেউ তাদের এই মেকি পোশাকী বিশ্বাস ধরে ফেলবে ও অন্তরের গভীরে তারা যে আসলে শূন্য সেটা প্রকাশ হয়ে পড়বে। এই কারণে তারা সেই পোশাকী বিশ্বাসকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করতে চায়। কেউ তার বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেও তারা তাকে শেষ করতে ফেলতে চায়।
এটাই হল ডগম্যাটিজম বা গোঁড়ামী। সেটা ঈশ্বরে বিশ্বাসেই হোক বা নাস্তিক্যে অথবা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে বা বামপন্থায় বা তথাকথিত মুক্তচিন্তায় বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের। নাস্তিক হোক বা গোঁড়া মৌলবাদী, যারা অসহিষ্ণু, ক্ষমাহীন ও ভাবমূর্তীর কঠোর রক্ষাকর্তা – অন্তরে তারা আসলে ভীত যে কখন তাদের পোশাকটা খুলে পড়ে কারণ ভেতরে তারা শূন্য। এরাই উয়োক মাইন্ড ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, নিজ চিন্তা যাদের অগভীর তারা বড় শক্তির ভারবাহী গাধায় পরিণত হয়।