EN
আরও পড়ুন
মানসিক সমৃদ্ধি ও সম্পর্ক
দাপুটে পুরুষের আবেগ নিয়ে খেলা করার সমাজে
রাজনীতি
ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে
রাজনীতি
১৯৭৫ থেকে ২০২৪ - যত আত্মঘাতী কর্মকান্ড:
JadeWits Technologies Limited
রাজনীতি

তিন বছর আগে লেখা: মোল্লা মিলিটারি শাসন নিয়ে

ইসলামি আদর্শের সিভিল মিলিটারি মিশ্রিত সাম্প্রদায়িক ছায়া সরকারের বিপদ

গত পঞ্চাশটি স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে এবারের পঞ্চাশতম স্বাধীনতা দিবসটির মত এত ধূসর স্বাধীনতা দিবস আর আসেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ যে চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কার মধ্যে জাতীয়তাবাদকে সকল পুষ্টি সরবরাহ করে বাকি তিনটি এখন অপুষ্টিতে মৃত্যুশয্যায়। একটি দিয়ে বাকি তিনটিকে এর মধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে। 
সংবিধানে 'সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান' থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা থাকলেও ইসলামই এখন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক বা আদর্শিক শক্তি।

সংবিধানে 'মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা' করার কথা থাকলেও আমরা আমেরিকার চেয়েও বেশী ধনতন্ত্রী এখন। সেখানে 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য' বলে নিশ্চয়তা দিলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেকর মধ্যে রাজতন্ত্রের চরিত্র সর্বব্যাপী। অনুষ্ঠানে সচিবদের কার নাম আগে হল বা কার পরে এটি নিয়ে তারা রাগ করে অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যান। যদি গবেষণা করা যায় তাহলে দেখা যাবে ‘আদালত’, ‘সামরিক বাহিনী’ ‘প্রধানমন্ত্রী’ এই শব্দগুলোর প্রয়োগ কমে গেছে কারণ জাতীয়তাবাদ আর ভাবমূর্তি বিনষ্টের নামে নিয়মিত চোখ রাঙানি আর হেনস্থার ভয়ে মানুষ আর এগুলো নিয়ে কথা বলে না। সম্প্রতি এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত পঞ্চাশ বছরে সব সময় পত্রপত্রিকাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনৈতিক কার্টুন ক্যারিকেচার ছাপা হয়েছে, গত দু-তিন বছর আর সেটা হয় না। 

সংবিধানে বলা হয়েছে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল'। 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল'। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং অবমাননা আর মানহানির দোহাই দিয়ে বাকিগুলোকে গিলে ফেলা হয়েছে।

পরিস্থিতি এখন এমন যে সংবিধানের একই বাক্যের প্রথম অংশ দিয়ে দ্বিতীয় অংশকে হত্যা করা হয়েছে এবং নতুন নতুন আইন করে এই হত্যাযজ্ঞ চলমান রয়েছে। অবাক লাগতে পারে যে এটা কিভাবে সম্ভব। সংবিধান অক্ষুন্ন রেখে কিভাবে মানুষের অধিকার হরণ সম্ভব? 

সেটা সম্ভব যদি সংবিধানেরও আগে একটি ছায়া ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। এবং জাতীয়তাবাদের হুজুগ তুলে এই ক্ষমতার অনুশীলন নতুন নয়। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের এই মার্চ মাসে একদিকে যেমন বিক্ষোভ আর তুমুল গণ জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নং তখন যেন ছায়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ক্ষমতা জেনারল ইয়াকুবের হাতে থাকলেও সামরিক বাহিনীর সামরিক অংশ ছাড়া সব কিছু চলছে বঙ্গবন্ধুর ইশারায়। বাংলাদেশে অবস্থানরত পাক জেনারেলরা এতে ভীষন অস্বস্তি অনুভব করছে কারণ তারা বুঝতে পারছে তাদের ক্ষমতাহীনতা। তারা যখন সেটা তাদের হেডকোয়ার্টার তথা জেনারেল ইয়াহিয়াকে জানাতে চাইল, তারা দেখল তারা যাদের সাথে কথা বলছে সেখানেও আছে আর একটি ছায়া সরকার। পশ্চিম পাকিস্তানের কে যে পাকিস্তান সঙ্কটের কলকাঠি নাড়ছে সেটা পরিষ্কার নয়। দৃশ্যমান শুধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া।

ঢাকায় অবস্থানরত পাক আর্মির নেতৃত্বের মধ্যে যাদের বাস্তবতা জ্ঞান আছে তারা বুঝতে পারছে যে দুই ছায়ার মাঝে তারা বলির পাঁঠা হবে। পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যা সামরিক হস্তক্ষেপে সমাধান হবে না এই কারণ দেখিয়ে মার্চের এক তারিখে ভাইস অ্যডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান পদত্যাগ করেন যিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সম্মিলিত ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে তারা অন্তিম চেষ্টা করেন ইয়াহিয়াকে ঢাকায় আনতে যাতে তাকে পরিস্থিতি বোঝানো যায়। তিনি আসবেনই না। এই টানাপোড়েনে একই কারণ দেখিয়ে মার্চের ছয় তারিখে লেফটেনেন্ট জেনারেল ইয়াকুব খানও পদত্যাগপত্র পেশ করেন যাকে ভাইস অ্যডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসানের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল। এরপর মেডেল পাওয়া ফাইটার পাইলট এয়ার কমোডোর মাসুদকে পূর্ব পাকিস্তানের সম্মিলিত সামরিক ফোর্সের প্রধান করা হয় এবং জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর ও মার্শাল ল অ্যাডমিনিসট্রেটর জোন বি করা হয়। 

সামরিক বাহিনীর ভেতরে উচ্চতম পদে এই আস্থাহীনতা ইয়াহিয়াকে বাধ্য করে ঢাকায় আসতে। মার্চের পনেরো তারিখে ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন এবং প্রেসিডিন্টের বাসভবনে শীর্ষ সামরিক কর্তাদের সাথে এক বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে এয়ার কমোডোর মাসুদ দীর্ঘ এক ঘন্টাব্যপী এক বুদ্ধিদীপ্ত ও তথ্য সমৃদ্ধ বাস্তবতা তুলে ধরেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ মানে স্রেফ আত্মহত্যা এবং পাকিস্তানের বিভাজন। তিনি এটাও বলেন যে সামরিক বাহিনী কখনই এই সংঘর্ষে জিতেতে পারবে না। তিনি অনুরোধ করেন রাজনৈতিক আলোচনা বজায় রাখতে এবং বলেন রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটার সমাধান ছাড়া কোন পথ নেই। তার আবেগপুর্ণ বক্তৃতার সময় পিনপতন নিরবতা নেমে আসে কক্ষটিতে। ইয়াহিয়া সব শুনে বলেন “মিট্টি (এয়ার কমোডোর মাসুদের ডাক নাম ছিল মিট্টি মাসুদ) আমি জানি....আমি জানি....”। কিন্তু এয়ার কমোডোর মাসুদ বোঝেন যে কিছুই আসলে ইয়াহিয়া গ্রহণ করছেন না। প্রেসিডিন্টের ফিরে যাবার আগে এয়ার কমোডোর মাসুদ আবার দৌড়ে যান বিমানবন্দরে ইয়াহিয়াকে আবার বোঝাবার জন্য।

কিন্তু কোন ফল হয় না। পঁচিশে মার্চ রাতে পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর। ছাব্বিশে মার্চ টিক্কা খান এয়ার কমোডোর মাসুদকে নির্দেশ দেন নিরস্ত্র বেসামরিক বাঙালীর উপর বিমান আক্রমণের। এয়ার কমোডোর মাসুদ নিরস্ত্র জনগনের উপর এয়ার রেইডে অস্বীকৃতি জানান এবং এয়ার কমোডোর ইনাম আল হকের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দ্রুত পাকিস্তান ফিরে যান। সেখানে উচ্চ ক্যালিবারের খেতাব প্রাপ্ত সৈনিক হিসাবে, যিনি পাকিস্তানের বিমানবাহিনী প্রধান হবার পথে ছিলেন, তার অনুকূলে তাকে অন্যত্র দায়িত্ব দিতে চাইলেও এয়ার কমোডোর মাসুদ সেটা নিতে অস্বীকার করেন এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

সিভিল সামরিক মিশ্রিত ছায়া সরকার একটি বিপজ্জনক পদ্ধতি। এটি আপাতভাবে সফল মনে হলেও এটি উপরে সফলতা, গর্ব ও জাতীয়তাবাদের অহংকার তৈরী করে মিথ্যা আবেগ তৈরি করে যেটা বাস্তবতা থেকে প্রশাসনকে দুরে নিয়ে যায়। দুরে ঠেলে দেয় সকল বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিকে। পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ আজ সেই ভুল পথে যে ভুলের কারণে পঞ্চাশ বছর আগে তার রক্তক্ষয়ী জন্ম।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।