ফার্মগেট বা মহাখালির রাস্তা দিয়ে হাটলেই শুনবেন হকারদের রেকর্ড করা বিশেষ সূরে ছন্দময় আহ্বান “চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা, চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা, চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা” চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা হলে খলিলের গোস্তের দাম তাহলে এত কেন? গরুর মাংসকে সারা দুনিয়াতে ধরা হয় সুস্বাদুতম একটি খাবার এবং এটি প্রোটিন, ভিটামিন এবং নানা প্রয়োজনীয় মিনারেলের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। ভারত ও পাকিস্তানে বাংলাদেশের তুলনায় গরুর মাংসের দাম অর্ধেকেরও কম।
নানা দেশের বাজার তুলনা করে দেখা গেছে যে আমাদের বাজারের গরুর মাংস নিম্নতম মানের কিন্তু সেটির দাম বেশির দিকে। আশ্চর্য হচ্ছে গত কয়েক বছরে মূল্য বৃদ্ধির হার। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। মাত্র ১০ বছরে বাজারে সেই গরুর মাংসের দাম হয়েছে ৮০০ টাকা।
এই উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির কারণ কি। কারণ হিসাবে নানা জন নানা কথা বলছেন কিন্তু সেগুলোর কোনটিই উপযুক্ত নয়। আপনি যদি সাগরে একটি জাহাজ চালানোর দায়িত্ব পান কিন্তু জোয়ার ভাটা সম্পর্কে আপনার ধারনা না থাকে তখন স্রোতের বিপরীতে জাহাজ ধীরে চলার জন্য আপনি হয় ইঞ্জিনের দোষ দেবেন, নয়ত পানির দোষ, নয়ত ভাগ্যের দোষ ইত্যাদি দিয়ে বেড়াবেন। কিন্তু কোনভাবেই নিজের গন্তব্যে ঠিক সময় পৌছাতে পারবেন না। গরুর মাংস নিয়ে ঠিক একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ভারত সীমান্তে ফেলানি হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষোভ প্রকাশ এবং এর ফলস্রুতিতে অনলাইনে ব্যপক ভারতবিদ্বেষী প্রচারণা ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশ বিরোধী মাত্রা যুক্ত করে। এরই ফলস্রুতিতে ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, মোদি সরকার বাংলাদেশ সীমান্তে গবাদি পশু বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গরুর মাংসের বাজারের উপর এই নিষেধাজ্ঞার সূদুরপ্রসারী প্রভাব কি সেটা না বুঝেই বাংলাদেশের সরকার এরং পশুসম্পদ খাতের ব্যবসায়ীর একে টাকা কামানোর সুযোগ মনে করে। এর ফলে পশুসম্পদ খাতের ব্যাপক উন্নয়নে হবে বলে মনে করেন তারা। সরকারী কর্মকর্তাদের অশিক্ষা এবং নির্বুদ্ধিতা এবং ব্যবসায়ীদের দ্রুত টাকা কামাইয়ের লোভ পরবর্তী বছরগুলোতে একটি ক্যাটাস্ট্রোফ বা আকস্মিক বিপর্যয়ের সূচনা করে যাকে বলা হয় ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স।
ছোট বেলায় আমরা দেখেছি মাঠে গরু চরতে। গরুর খাদ্যের পুষ্টিমান ও তার খাদ্য হজম প্রক্রিয়া এমন যে সারাদিনের বেশিরভাগ সময় তাকে খেতে হয়। মাঠে চরা গরু তার সারা জীবনে ঘাস নামে যে খাদ্য খায় সেটা প্রকৃতি উৎপাদিত এবং সেটা ফ্রি। একটি মাঠে প্রকৃতি প্রতিদিন কি পরিমান ঘাস উৎপন্ন করবে সেটা নির্দিষ্ট। বাংলাদেশে যত মাঠ আছে এবং সেখানে কত সংখ্যক গরু প্রতিদিন ঘাস খেতে পারবে সেটার একটা সীমা আছে। সেই সীমার চেয়ে বেশি সংখ্যক গরু হয়ে গেলে গরুর খাবারে কমতি পড়বে বিষয়টা শুধু এমনই নয়। অনিয়ন্ত্রিত চাপের ফলে সকল মাঠের সব ঘাষ শেষ হয়ে যেতে পারে এবং সকল গরু খাদ্যের অভাবে মারা পড়তে পারে। প্রকৃতি উৎপাদিত রিসোর্সের এই ক্যাটাস্ট্রোফিক বা আকস্মিক বিপর্যয়ের নামই হল ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স।
ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স বিষয়টি কি বোঝার জন্য আমরা চিত্র ১ এর দিকে তাকাই। সেখানে দেখব একটি ছোট্ট চারণক্ষেত্র এবং তার চার পাশে চারটে বাড়ি যেখানে প্রতিটি বাড়ির একটি করে গরু আছে। প্রতিদিন এই মাঠে যে ঘাস জন্মে, চারটি গরু পেটপুরে খেয়েও কিছু অবশিস্ট থাকে যার ফলে ঘাসগুলো স্বাস্থ্যবান থাকে এবং তারা প্রতিদিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এখন ধরা যাক একটি বাড়ির একটি ছেলে প্রবাসী হয়ে ইটালি চলে গেল। এর পর সে মাস গেলে অনেক টাকা পাঠায় এবং তার বাবার মনে হলো সে আরো একটি গরু কিনবে। চিত্র ২ এর পাঁচটি গরুর খাবার হয়ত মাঠটি দিতে পারবে কিন্তু কোরবানির আগে সে মনে করল প্রতি মাসে একটি গরু যোগ করলে তো অনেক টাকা যেমন দেখানো চিত্র ৩ এ। এতগুলো গরুর খাবার ঐ ছোট্ট মাঠটি দিতে পারবে না তাই দ্রুতই সব ঘাস সবগুলো গরু মুড়ে খেয়ে ফেলবে এবং পরদিন থেকে কোন ঘাসই জন্মাবে না, মাঠ হয়ে যাবে ঘাস শূণ্য। ফলে সব গরু না খেয়ে মারা যাবে। অতিরিক্ত আহরণে প্রাকৃতিক উৎসের উৎপাদনের এই হঠাৎ শুণ্য হয়ে যাওয়াই হল ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স।
১৮৩৩ সালে প্রথম ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনসের ধারণা দেন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফর্স্টার লয়েড। গ্রামের একটি চারণভূমিতে সবাই মিলে গরু চরালে এবং গরুর সংখ্যা বাড়িয়ে সেটা চারণভূমির প্রতিদিনের ঘাস উৎপাদনের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে ফলাফল কী হবে, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ধারণা আসে তাঁর মাথায়। পরবর্তীতে বিষয়টি হয়ে ওঠে পরিবেশবিদ গ্যারেট হার্ডিনের ১৯৬৮ সালের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম। লয়েড এবং হার্ডিন উভয়েই ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্সকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য দেখেছেন এবং সমাধান হিসাবে জনসংখ্যা বা মানুষের সন্তান নেবার স্বাধীনতা ক্ষুন্ন ও অধিক সরকারী নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দিলে সমালোচিত হন।
পরবর্তীতে এই ধারণার আধুনিকিকরন করেন এলিনর অস্টর্ম। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এলিনর অস্টর্ম ২০০৯ সালে 'ট্র্যাজেডি অব দ্য আনম্যানেজড কমন্সে' এর ধারণার জন্য অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন অলিভার ই. উইলিয়ামসনের সাথে মিলে। তিনিই এই পুরষ্কার জয়ী প্রথম মহিলা। জন ভন নিউম্যান ও জন ন্যাশের গেম থিওরি এবং এলিনর অস্টর্মের 'কমন্স’-এর ধারণা মিলে 'কমন্স' মানে এমন একটা যূথবদ্ধ সমষ্টি, যাকে ঠিকমত না বুঝলে বা তাকে গভর্ন বা শাসন বা আরও সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করতে হয় সেটা না শিখলে প্রকৃতি নির্ভর যে কোন সিস্টেমের ক্যাটাস্ট্রোফ বা আকস্মিক বিপর্যয়ের সূচনা হবে। যারই ফল হচ্ছে গরুর মাংস মূল্য বিপর্যয়।
আমাদের গরু পালন বা গরুর মাংস উৎপাদনে এই ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স বিপর্যয়ের ফাঁদে পড়েছে। কোন কোন আকস্মিক ঘটনা বা ইভেন্ট ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স শুরু হতে বা ট্রিগার করতে পারে। আমাদের গরুর মাংস ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স ট্রিগার করেছে চারটি ঘটনা। এক - মোদি সরকারের বাংলাদেশ সীমান্তে গবাদি পশু বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। দুই - ভারতীয় গরুর খাদ্য কি ছিল এবং দেশের প্রাকৃতিক খাদ্য এবং কৃত্তিম খাদ্যের বিশদ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করেই এই নিষেধাজ্ঞার সূদুরপ্রসারী প্রভাব কি সেটা না বুঝেই বাংলাদেশের সরকার এরং পশুসম্পদ খাতের ব্যবসায়ীর একে সুযোগ মনে করে এর ফলে পশুসম্পদ খাতের ব্যাপক উন্নয়নে হবে বলে মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়া। তিন - কোরবানী, যেখানে গত কোরবানীতে এক দিনে প্রয়োজন হয়েছে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু। চার - টাকা ছাপানো এবং মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বাজারে অনেক টাকার সরবরাহ।
বাজার ও উৎপাদন ব্যবস্থা বুঝতে সিস্টেমস আন্ডারস্ট্যান্ডিং যদি না থাকে, পলিসি এনালিসিস ও মডেলিং এর প্রয়োগ না থাকে, প্রকৃতি ও মানুষ মিলে যে কমপ্লেক্স সিস্টেমস তাকে বোঝার এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান প্রয়োগের কোন পথ যদি খোলা না থাকে, দেশের বাজার ও অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে যদি খলিলের উপর নির্ভর করতে হয় তাহলে গরুর মাংস ৮০০ নয়, ১৬০০তে যাওয়া খুব দুরের কিছু নয়। খুব শিঘ্রই এই ঘটনা আমরা আরো অনেক ক্ষেত্রে ঘটতে দেখব।