একবার এক বন্ধু পরিবারের সাথে শ্রীমঙ্গল গেছি লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে। সাধারণত আমি সবসময় যেখানে রাতে থাকি সেখানে না থেকে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের রেষ্টহাউজে থাকার ব্যবস্থা হল। তাদের বিশাল এলাকা। ভেতরেই অনেক গাছপালা। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যবস্থাপকে সাথে পরিচয় হল। তিনি নতুন এসেছেন। কথায় কথায় বললেন এলাকাটা ভাল না। বনে নিয়মিত গাছ চুরি হয়। এতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এবং বন কর্মকর্তারা জড়িত। বললেন এমনকি আগে কখনও যা হয় নি, ইদানিং তাও হচ্ছে। কিছুদিন আগে এক রাতে তাদের কম্পাউন্ড থেকে সবগুলো সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। গাছগুলো হারিয়ে তিনি যে মনঃক্ষুণ্ণ, তার মনের ভাবে সেটা প্রকাশ পেল।
বিষন্ন লাগল কথাগুলো শুনে, যে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর পর কথায় কথায় তিনি আরও যোগ করলেন তিনি আসলে এখানে থাকতে চান না, এই শ্রীমঙ্গল জায়গাটা তার ভাল লাগে না। এখানে কিছুই নেই। অল্প কিছুদিনের জন্য বদলি হয়ে এসেছেন, মাস তিনেক পরেই চলে যাবেন। এখানে ফার্নিচারের কাঠ খুব ভাল দামও খুব কম। সস্তায় কিছু ফার্নিচার নেবার জন্যই এখানে বদলিটা তিনি করিয়েছেন। আমি হতবাক হয়ে গেলাম ভদ্রলোকের এই আপাতঃবিরোধী চিন্তা দেখে। তিনি কি বুঝছেন না এখানে ফার্নিচারের কাঠ খুব ভাল দামও খুব কম কেন? তিনি কি এতটাই নির্বোধ? তাহলে এত বড় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কিভাবে করেন? বন বিনাশ ও গাছ চুরির জন্য তার মনঃক্ষুণ্ণ ভাবটি কৃত্রিম নয়, আবার সস্তা ফার্নিচার কেনার আনন্দটিও যথেষ্ট। এই আনন্দ বিষাদ একসাথে তার মনে বিরাজমান অনেকটা শ্রোয়েডিংগারের বিড়ালের মত।
অস্ট্রিয়ান ফিলোসফিক্যাল রাইটার রবার্ট মুসলি লিখেছেন “বাস্তব জীবনে নির্বোধ ব্যক্তি হিসাবে আমরা তাকেই বুঝি যার ‘মগজে বুদ্ধির স্বল্পতা আছে’। কিন্তু এর বাইরেও এমন বিস্তর রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক বিচ্যুতি থাকতে পারে যেগুলো প্রয়োগে এমন সব বিপর্যয়, হতাশা ও পথভ্রষ্টতা আসতে পারে যার জন্য সেই একটি মাত্র শব্দই প্রযোজ্য আর সেটি হলো ‘নির্বুদ্ধিতা’। এর মানে হলো নির্বুদ্ধিতা শব্দটি মৌলিকভাবে দুটি ভিন্ন ধরণ নির্দেশ করতে পারে: একটি সরল ও সাদামাটা নির্বুদ্ধিতা, এবং দ্বিতীয়টি অনেকটা উপরে বুদ্ধিমত্তায় ছাওয়া আপাতঃবিরোধীতায় ডুবে থাকা নির্বুদ্ধিতা। যেখানে প্রথমটি নিতান্তই বোধের দুর্বলতার নির্বুদ্ধিতা। আর দ্বিতীয়টি খন্ডিত বোধের নির্বুদ্ধিতা যেটি অনেক বেশি ভয়ংকর।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন “আত্মম্ভরী মূর্খরা আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। সাধারণ বোকারা ঠিক আছে; আপনি তাদের সাথে কথা বলতে পারেন এবং তাদের বুঝতে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আত্মম্ভরী বোকারা - সেই মানুষেরা যারা বোকামিটা ঢেকে রাখার জন্য সবরকম চেষ্টা করে এবং যারা তাদের সমস্ত ছল-চাতুরী প্রয়োগে মানুষকে প্রাভাবিত করতে ব্যস্ত যে কতটা দুর্দান্ত তারা, আমি তাদের একদম সহ্য করতে পারি না। একজন সাধারণ বোকা মিথ্যাবাদী নয়; একজন বোকা সৎ হলে সমস্যা নেই, কিন্তু একজন অসৎ বোকা ভয়ানক!”
তাহলে এখানে তিন ধরণের নির্বোধ আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রথম প্রকার হল বোধের দুর্বলতার নির্বুদ্ধিতা, যেটা শিশুদের ও অপরিণতদের থাকে এবং থাকে কোন পরিস্থিতিতে নতুনদের অথবা যাদের বোধের সীমাবদ্ধতা আছে। শেখায় আগ্রহ এবং জ্ঞান অর্জনে তারা সেটা কাটিয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় প্রকার নির্বোধ হল খন্ডিত বোধের নির্বুদ্ধিতা, যেটা একটি চিন্তাগত ত্রুটি বা কগনিটিভ সীমাবদ্ধতা, যখন সে একই সাথে দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাকে ধারণ করে। শেখায় আগ্রহ বা জ্ঞান অর্জনে এই ত্রুটি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। তৃতীয় প্রকার হল আত্মম্ভরী অসৎ নির্বোধ, এরা হল নার্সিসিজম, ম্যাকিয়াভেলিজম বা সোশিওপ্যাথিক নির্বোধ। যেটা সাইকোলজিক্যাল ডার্ক ট্রায়াডের মধ্যে পড়ে।
সমস্যা হল সমাজে আইন ও ন্যায় বিচার না থাকলে এবং বন্দুকের নলের ক্ষমতা বিরাজ করলে তৃতীয় প্রকার নির্বোধেরা দ্বিতীয় প্রকার নির্বোধদের মগজ ধোলাই করে ফেলে যারা প্রথম প্রকার নির্বোধদের সমর্থন পায়। এভাবে তারা ক্রমেই সমাজ ও সেটার শৃঙ্খলা ধ্বংস করে ফেলে। খেয়াল করে দেখেন, দেশের বর্তমান ক্ষমতা পরিবর্তনে আমেরিকান ও পাকিস্তানীরা হল তৃতীয় প্রকার, দেশের সরকারে যারা আছে তারা দ্বিতীয় প্রকার আর তাদের যারা সমর্থন করছে তারা প্রথম প্রকার।