সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সরকার উৎখাত বা রেজিম চেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে এবং এই অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্যই ঘটানো হয়েছে। এর সাথে এর পরিকল্পনাকারীদের লোভ দেখানো হয়েছে মার্কিন কোম্পানীগুলোর ব্যাপক বিনিয়োগ ও দেশকে সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডের মত করে দেবার। এই পরিকল্পনাকারীদের সাথে পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘকাল অতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন করে এবং নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উপর ক্ষুব্ধ বিরোধী পক্ষ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে ভীতির রাজ্য কায়েম করে দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নষ্ট করার ফলে রাজনীতি ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষদের সরকার পরিবর্তনের আবেগ।
কোন সন্দেহ নেই বেশীরভাগ মানুষ বিগত দমনমূলক ও একদলীয় গণতন্ত্র ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অবসান চেয়েছে। তারা সরকার পরিবর্তন চেয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের পরিবর্তন চেয়েছিল কি? মার্কিন পরিকল্পনা, অর্থায়ণ ও সহযোগীতায় দমনমূলক ও দীর্ঘ সময়ের একনায়কদের ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ২০১০-১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় (মিনা অঞ্চলে) আরব বসন্ত বলে খ্যাত একই মার্কিন ফর্মুলায় অনেকগুলো দেশে এমন প্রধানত বিদেশী স্বার্থে বিপ্লব ঘটানো হয়। কিন্তু সবগুলো দেশেই মার্কিন কোম্পানীগুলোর ব্যাপক বিনিয়োগ বা মার্কিন সমর্থক সরকার থাকার মত সাদামাটা লক্ষ্য ছিল না। অনেক দেশেই লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রটাকেই পরিবর্তিত করা, সংবিথান পরিবর্তন করা, দেশটাকে অস্থিতিশীল করা এমনকি সিআইএর স্থানীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গৃহযুদ্ধ লাগানো।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে একই কায়দায় আরব বসন্তের ফর্মুলাতেই মানুষ ক্ষেপিয়ে আং সান সু চি কে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। সেই সু চির সময়েই হয়েছে রোহিংগা গণহত্যা। উদ্দেশ্য ছিল সু চি কে সামনে রেখে সামরিক শাসন চালানো। এখন সেখানে গৃহযুদ্ধ। উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেটাকে একটি প্রি-স্টেটে রূপান্তরিত করা। প্রি-স্টেট হল বর্তমানে বাংলাদেশ যেটা চলছে সেটা। লাঠি বা অস্ত্র হাতে একটি দলের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা। যেটা হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র বা মর্ডান রিপাবলিকের আগের স্টেজ।
ধরে নিলাম আরব বসন্তের ফর্মুলাতেই দমনমূলক ও একদলীয় গণতন্ত্রকে উৎখাত ভালই, কিন্তু এর পরিণতি কি? যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তার কতটুকু সফল হয়? ২০১০-১১ সালে ঘটা এসব আরব বসন্তের রাষ্ট্রগুলো দশ বছর পর কেমন হয়েছে সেটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক দেশে। সেই সব গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আরব বসন্তের ফলে কোন দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে, অনেক দেশে অকার্যকর বা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কোন কোন দেশে ঘটে চলছে বারবার সরকার পরিবর্তন। কোন দেশে এসেছে সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসন। কোথাও বা চলছে চরম মানবিক সংকট। বেড়েছে আই এস এর মত উগ্রবাদ। আক্রান্ত হয়েছে বিদেশী শক্তিদের দ্বারা। ধ্বংস হয়েছে সমাজ।
ছোট্ট দেশ তিউনিশিয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছুটা কার্যকরী হলেও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে কেউই মুক্ত হতে পারেনি। বিভিন্ন দেশের জরিপে দৃশ্যমান যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মাত্র ২০ ভাগ মানুষ মনে করে যে ভাল কিছু হয়েছে। আর পরিশেষে আরব বসন্তে কারা লাভবান হয়েছে? সেই প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে যে নতুন রেজিমের শাসনকর্তারা বা তাদের ভাই ব্রাদারেরা ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা দরীদ্রদের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। দেশভিত্তিক কিছু জরিপের ফল ছবিতে।
আরব বসন্ত: দেশভিত্তিক ঘটনাবলী
১. তিউনিসিয়া
১৭ ডিসেম্বর ২০১০: মোহাম্মদ বৌআজিজি, একজন রাস্তায় ব্যবসায়ী, পুলিশের হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আত্মদাহ করেন, যা ব্যাপক প্রতিবাদের সূচনা করে।
• ১৪ জানুয়ারি ২০১১: প্রেসিডেন্ট জিন এল আবদিন বেন আলি সৌদি আরব পালিয়ে যান, প্রতিবাদের সপ্তাহগুলোর পর।
• মার্চ ২০১১: একটি কেয়ারটেকার সরকার গঠন করা হয় এবং অক্টোবর মাসে নির্বাচনের পরিকল্পনা করা হয়।
• ২৩ অক্টোবর ২০১১: প্রথম মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা ইসলামী দল এনাহদার বিজয়ের ফলে ঘটে।
• ২০১২-২০১৩: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকে। সেক্যুলার এবং ইসলামী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে।
• ২০১৪: নতুন সংবিধান গৃহীত হয় এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিদা তিউনিস পার্টি বিজয়ী হয় এবং এনাহদার সাথে একটি জোট সরকার গঠন করে।
ফলাফল: তিউনিসিয়া একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলেও, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে।
২. মিসর
• ২৫ জানুয়ারি ২০১১: কায়রোর তাহরির স্কোয়ার-এ প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ শুরু হয়।
• ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১: ১৮ দিনের গণ আন্দোলনের পর মুবারক পদত্যাগ করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমান তার বিদায় ঘোষণা করেন।
• মার্চ ২০১১: সামরিক বাহিনী (SCAF) ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং একটি বেসামরিক শাসনে স্থানান্তরের তত্ত্বাবধান করে।
• জুন ২০১২: মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মোরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন।
• ৩ জুলাই ২০১৩: মোরসি সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে উৎখাত হন, সাধারণ আবদেল ফাত্তাহ সিসির নেতৃত্বে।
• অগাস্ট ২০১৩: সামরিক বাহিনী মোরসির সমর্থকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালায়, যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।
• মে ২০১৪: আবদেল ফাত্তাহ সিসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ফলাফল: মিসর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে একটি সামরিক শাসনের দিকে চলে যায়, যেখানে মতবিরোধের দমন ঘটে।
৩. লিবিয়া
• ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১: মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয় বেনগাজিতে।
• ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১: সংঘর্ষ গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। লিবিয়ান বিরোধীরা জাতীয় রূপান্তর পরিষদ (NTC) গঠন করে।
• ১৯ মার্চ ২০১১: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন অনুযায়ী ন্যাটো একটি নো-ফ্লাই জোন এবং বিমান আক্রমণ শুরু করে।
• ২০ অক্টোবর ২০১১: গাদ্দাফি সির্টে বিদ্রোহীদের দ্বারা বন্দী এবং নিহত হন।
• ২০১২: NTC সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি নির্বাচিত সাধারণ জাতীয় কংগ্রেস গঠন করে।
• ২০১৪: দেশ আবারও বিভক্ত হয় এবং লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (LNA) এবং জাতীয় ঐক্য সরকার (GNA) এর মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়।
ফলাফল: লিবিয়া এখনও গভীর অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।
৪. ইয়েমেন
• ১৫ জানুয়ারি ২০১১: প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহের পদত্যাগের দাবিতে সানা’য় প্রতিবাদ শুরু হয়।
• ফেব্রুয়ারি ২০১১: সালেহ পদত্যাগের প্রস্তাব দেন, কিন্তু প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে।
• জুন ২০১১: সালেহ একটি হামলায় আহত হন এবং তার স্থানীয় উপদেষ্টা আবদরাব্বুহ মানসুর হাদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
• নভেম্বর ২০১১: সালেহ একটি গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল (GCC) দ্বারা মধ্যস্থতায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
• ফেব্রুয়ারি ২০১২: হাদি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
• ২০১৪: হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা’ দখল করে এবং হাদিকে নির্বাসিত করে।
• মার্চ ২০১৫: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হাদির সরকারের সমর্থনে হস্তক্ষেপ করে।
ফলাফল: ইয়েমেন একটি গভীর সংঘাত এবং মানবিক সংকটের মধ্যে রয়েছে, একটি বিভক্ত সরকার এবং চলমান সামরিক হস্তক্ষেপের সাথে।
৫. বাহরাইন
• ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১: মানামায় রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ শুরু হয়।
• ১৪ মার্চ ২০১১: সৌদি আরব এবং ইউএই বাহরাইন সরকারের সহায়তার জন্য সৈন্য প্রেরণ করে।
• মার্চ ২০১১: বাহরাইন সরকার সামরিক আইন আরোপ করে এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালায়।
• ২০১২-২০১৪: সরকার বিরোধী প্রতিবাদ এবং সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
ফলাফল: বাহরাইন একটি স্বৈরশাসনের অধীনে রয়েছে, যেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং চলমান অস্থিরতা বিদ্যমান।
৬. সিরিয়া
• ১৫ মার্চ ২০১১: দারায়ে প্রতিবাদ শুরু হয়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি করে।
• এপ্রিল ২০১১: আসাদ সরকার কঠোর দমন-পীড়ন শুরু করে, যা একটি পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
• ২০১২-২০১৩: সংঘাত তীব্র হয় এবং বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠী ও জিহাদী ফ্যাকশনগুলি উঠিয়ে আসে।
• ২০১৩: আসাদ সরকারের দ্বারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের জন্য আংশিক চুক্তি হয়।
• ২০১৫: রাশিয়া আসাদের সরকারকে সামরিকভাবে সহায়তা করতে শুরু করে।
• ২০১৬-২০২১: সংঘাত অব্যাহত থাকে, আসাদ সরকার দেশের অধিকাংশ অংশ পুনরুদ্ধার করে, এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিরোধী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকে।
ফলাফল: সিরিয়া একটি ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে, যা ব্যাপক মানবিক পরিণতি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির জটিল হস্তক্ষেপ নিয়ে।