১৯৭১ কে শুধু একটি যুদ্ধ নয়, একটি জাতিগত, ধর্মীয় ও আদর্শগত বিলুপ্তি প্রচেষ্টা ও গণহত্যার চক্রান্ত হিসাবে দেখতে হবে। কেন পাকিস্তান ২৫ মার্চ রাতে ঘুমিয়ে থাকা নিরস্ত্র মানুষদের আক্রমণ করেছিল? কেন বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিল? তার আগে কেন বিহারিরা গণরোষে নিহত হয়েছিল? এই বিহারিরাই ছিল ৭১ এর আত্মঘাতী লাল শহীদ যারা একটি বড় অপারেশন মুরু করার অযুহাত বা ফলস ফ্ল্যাগ ভিক্টিম। পাক লে: কর্নেল আজিজ আহমেদ খান লিখেছেন "জেনারেল নিয়াজী ঠাকুরগাঁও ও বগুড়াতে আমার ইউনিট পরদর্শনে এসেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আমরা কতজন হিন্দু হত্যা করেছি। মে মাসে লিখিত নির্দেশ এসেছিল হিন্দু হত্যার"। আসলে ১৯৭১ ছিল একটি জাকার্তা মেথড, যেটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ উদ্ভাবিত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ডিপ স্টেট পরিচালিত একটি জাতীগত ও রাজনৈতিক বিলুপ্তিকরণ বা পলিটিক্যাল এন্ড এথনিক ক্লিনজিং যেটার চেষ্টা ২০০৯ সালে হয়েছে বিডিআর হত্যার মাধ্যমে, যেটার চেষ্টা এই ২০২৪ সালেও করা হয়েছে সংস্কারের নামে।
কারো যদি প্রখর চিন্তা শক্তি না থাকে, রাজনৈতিক মেধা না থাকে, এবং রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনার অভ্যাস না থাকে তাহলে এই গভীর রাজনৈতিক বিষয়গুলো বোঝা সম্ভব নয়। পত্রিকার হেডিং পড়ে বা নিজেরা চায়ের কাপে বিতর্ক করে কি কোন দেশের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতির জটিলতা বোঝা সম্ভব? সামাজিক মাধ্যম আসার আগেও এদেশে কিন্তু চায়ের কাপেই রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। হলিডে, বিচিত্রা, বিচিন্তা থেকে ডেইলি স্টার, নিউ এজ, প্রথম আলো, এগুলো সবই নিজেদের খুব স্মার্ট ভাবা এনার্কিক, আত্মঘাতী জাতী বিদ্বেষীদের আড্ডাখানা যারা এদেশের আত্মঘাতী রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করেছে এবং সেগুলোর তৈরী লেন্সেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ এবং সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে দেখেছে।
এই সব আত্মঘাতী ন্যারেটিভের ফলই কিন্তু আজবের বাংলাদেশ যেটা একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই ৭৫ থেকে যেটা লাগাবার চেষ্টা করছে আমেরিকা যাতে এদেশ থেকে জাতীয়তাবাদ ও স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ বিলোপ করে দেওয়া যায়। একাধিক বার এদেশে 'জাকার্তা মেথড' প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছে যার মাধ্যমে ১৯৬৫-৬৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ১০ লক্ষ মানুষ হত্যা করে জাতীয়তাবাদ ও বামপস্থাকে নির্মূল করা হয়েছে। এর পর আরো নানা দেশে 'জাকার্তা মেথড' প্রয়োগে জাতীয়তাবাদ ও বামপস্থাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে।
'জাকার্তা মেথড' প্রয়োগের প্রথম ধাপ হল জাতীয়তাবাদ ও স্থানীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণা ও কুৎসা রটানো। ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণা ও কুৎসা রটালে সাধারণ মানুষের মনে একটি সন্দেহ তৈরি হয়। এরপর একটি নৃশংস বা শকিং ঘটনা ঘটানো হয় তাদের দ্বারা বা তাদের নাম দিয়ে স্যাবোট্যাজ করে। তখন মানুষ মনে করে এতদিন যা বলা হচ্ছিল সব সত্য। এটা করতে নিয়মিত জাতীয়তাবাদ ও স্থানীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক শক্তিকে নানা রকম ফাঁদে ফেলা হয়, যার ফলে তাদের ইমেজ নষ্ট হয়।
আওয়ামী লীগকে দোষী করা ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমনই একটি আমেরিকান ফাঁদ ছিল। “দি বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এন্ড দি সিআইএ লিংক” এর লেখক বি জেড খসরু একটি নতুন বই লিখছেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব নিয়ে। সেই বিষয়ে ১৯৮৬ এর নির্বাচন নিয়ে বি জেড খসরু লিখছেন:
“শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ করতে বাধ্য করার আরেকটি ঘটনা ঘটে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, দুটি প্রধান বিরোধী দলই কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বা এমন কিছু করতে চায়নি যা ১৯৮২ সালে ক্ষমতাগ্রহণকারী সামরিক শাসক জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের সরকারকে বৈধতা দিতে পারে। এরশাদ তখন সংবিধানসম্মত সরকারের অধীনে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র সংবিধানসম্মত সরকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল। তাই ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সব রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে উৎসাহিত করে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রদূত হাওয়ার্ড শ্যাফার দূতাবাস ও সরকারের মধ্যে এবং দূতাবাস ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তবে উভয় প্রধান বিরোধী দলই মনে করত যে মার্কিনিরা এরশাদের পক্ষে রয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদুত শ্যাফার, যিনি ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন, তিনি মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে “আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা মনে করতেন যে মার্কিন সরকার বিশেষভাবে তার দলের বিরোধী। আসলে, তার জীবনের হতাশাজনক অধ্যায়ে, শেখ হাসিনা অনুভব করতেন যে তার পিতা ১৯৭৫ সালে নিহত হওয়ার পেছনে আংশিকভাবে আমাদের হাত ছিল”।
তবুও তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের নেতা হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এটি তাকে আশ্বস্ত করতে সাহায্য করেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এরশাদকে সমর্থন করছে না, যদিও তার সঙ্গে মার্কিন সরকার সঠিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ফেরার সমর্থনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল আওয়ামী লীগকে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজি করানো। শ্যাফার খুব গোপনে এই কাজটি করেছিলেন, যদিও তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে রাষ্ট্রদূত খুব ব্যক্তিগতভাবে বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। তিনি তার উদ্দেশ্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে পরিষ্কার করেননি; তিনি অনুভব করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ তার প্রতি যে বিশ্বাস রেখেছিল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি নীরবে দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে পারবেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, যদিও বিএনপি অংশ নেয়নি।
১৯৮৬ সালের নির্বাচন ব্যাপক কারচুপির কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, যার ফলে ভোটের দিনে একটি খুব অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। যখন জেলা থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে ভোটের ফলাফল আসতে শুরু করে, তখন প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছিল যে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ খুব ভালো করছে। এরপর হঠাৎ নির্বাচন কমিশন ২৪ ঘণ্টার জন্য গণনা স্থগিত করে। যখন গণনা পুনরায় শুরু হয়, তখন শাসক দলের পক্ষে ফলাফল পরিবর্তিত হয়ে যায়। হাসিনা তখন প্রকাশ্যে তার দলের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
হাসিনা শ্যাফারের প্রতি খোলামেলা তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তাকে এই বিষয়ে কিছু করতে বলেন। শ্যাফার ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করতে কিছুই করতে পারেননি। তিনি হাসিনাকে পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার এবং সংসদে অংশগ্রহণের পরামর্শ দেন। শ্যাফারের চলে যাওয়ার পর, আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে সরে দাঁড়ায়। হাসিনা অনুভব করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”। এখানে এরশাদের ভোটের ফল পরিবর্তন এবং আমেরিকানদের এরশাদকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা নিয়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের দরকার ছিল। অথচ দেখায় যায় এর পরের ৪০ বছর ধরে এই বিষয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা হয়েছে। এই পুরো চক্রটাই একটি নেতিবাচক প্রচারণা ও কুৎসা বা হেট স্পিচ চক্র যেটা সিআইএ উদ্ভাবিত 'জাকার্তা মেথড' এর অংশ।
ছোট বেলা থেকে পরিবারের সাথে অনেকবার ভারতে বেড়াতে গেলেও সেটা কলকাতা ও বাংলার কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯২ সালে প্রথম যখন একা দিল্লি ও মুম্বাই যাই তখন চোখে পড়ে যে দিল্লির যে অটো চালক, ট্যাক্সি চালক, দোকানদার, কুলি বা রাস্তার ছেলে ছোকরা বা ভবঘুরে তারা আমাদের দেশের মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি চালাক ও ধুরন্ধর যাদের তুলনায় বাংলাদেশের একই কাজ করা মানুষেরা একান্তই সরল সোজা। আমাদের রাজনীতিও তেমনই সরল সোজা ছিল কিন্তু দেশের সমালোচক মহলের সেই নিজেদের খুব স্মার্ট ভাবা এনার্কিক, আত্মঘাতী জাতী বিদ্বেষীদের আত্মঘাতী ন্যারেটিভ সেটাকে সহায়তা না করে সেটাকে এখন গভীর গর্তে ফেলে দিয়েছে।