"শত্রুর শত্রুই আমার বন্ধু” - এটা পুরোনো একটি প্রবাদ। কিন্তু যখন এই প্রবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপ দেয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা, তখন তার প্রভাব শুধু প্রবাদেই আটকে থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। এটি সেই মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর বহুল চর্চিত কৌশল “স্ট্র্যাটেজিক কনভার্জেন্স” বা "বিপরীত মতাদর্শের সাময়িক ঐক্য" নিয়ে।
এই কৌশলের মূল কথা খুবই সরল—যে কোনো লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় সব শক্তিকে একত্র করা, এমনকি তারা একে অপরের চরম শত্রু হলেও। এই একত্রিকরণ হয় "একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য", "একটি নির্দিষ্ট মিশনের জন্য"। আদর্শ, নৈতিকতা, ইতিহাস—সবকিছুই হিজাব পরে, যেটা ফুটে ওঠে, সেটা হলো মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
সিআইএ যেভাবে "জোট গঠন" বা কোয়ালিশন বিল্ডিং করে, তা প্রায়ই বিস্ময়কর। উদাহরণ হিসেবে আফগানিস্তান, সিরিয়া বা লিবিয়াকে নিলেই বোঝা যায়—একদিকে ইসলামপন্থী চরমপন্থী গোষ্ঠী, অন্যদিকে উদারপন্থী গণতন্ত্রী; একদিকে জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদী, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়া—সবাই একত্র হয়ে কাজ করেছে শুধুমাত্র একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে: "আসাদকে ফেলা", "গাদ্দাফিকে সরানো", "সোভিয়েতকে রুখে দেওয়া"। এইসব গোষ্ঠীর আদর্শ একে অপরের সঙ্গে যেমন বিরোধপূর্ণ, তেমনি তাদের অধিকাংশই পশ্চিমা মূল্যবোধের ঘোরতর শত্রু। এর ফল কি হবে এই প্রশ্নের উত্তরে সিআইএ বলে, “দ্যা’টস টুমোরো’জ প্রবলেম” বা সেটা কালকের সমস্যা। এটা খুশি মনে বলার কারণ হল সেই টুমোরোতে সে এখানে থাকবে না। অন্য কোন দেশে সে একই গোলমাল পাকাবে।
গত প্রায় নয় মাস পাকিস্তানের প্রতি নতজানু পাকিস্তানপন্থী বর্তমানের অবৈধ সরকার হঠাৎ করে একাত্তরের অপরাধের জন্য পাকিস্তানের বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তুলল কেন? এর সাথে পাকিস্তানের কাছে ৪৩২ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণও চেয়েছে বাংলাদেশ। কূটনীতিতে ১৪ বছর শীতল থাকার পর নয় মাস রোমান্টিক ডেটিং এর পর এইসব বিষয় উত্থাপন করা মানে হচ্ছে আপাতত তফাৎ যাও, ইউ আর নট মাই টাইপ।
“দক্ষিন এশিয়ার ভূ রাজনীতি, চীন, মিয়ানমার, ভারত ও জর্জ সরোসের ফাঁদ” লেখাটিতে আমি লিখেছিলাম “বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন ও শেখ হাসিনাকে বিতাড়নের মূল কারণ ভবিষ্যত চীন-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে এগিয়ে থাকতে চীনের জ্বালানি নিরাপত্তায় আঘাত হানা। এখানে আর একটি দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল এবং সেটি হচ্ছে ধর্মীয় দলগুলোকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামী খিলাফত কায়েম করে, তাদের সশস্ত্র করে, তার সাথে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের যুক্ত করে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে অনুপ্রবেশ করিয়ে সেই রাজ্যগুলোকে অস্থিতিশীল করা এবং সেগুলোকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট ও জর্জ সরোস বাহিনীর দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক লক্ষ্য যেটা বাস্তবায়নে কাজ করছিল সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা পরিবর্তন ও ট্রাম্প সরকারের নীতি পরিবর্তনের জন্য এবং তুলসী দিদির কল্যাণে আপাতত দ্বিতীয় লক্ষ্যটি মুলতবি মনে হচ্ছে”।
সরাসরি ভারত বিরোধী খিলাফতি দ্বিতীয় লক্ষ্যটি মুলতবি হবার কারণ মার্কিন প্রশাসনের ইসলামী সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থান এবং ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বোঝাপড়া তার ফল। মার্কিন প্রশাসনের এই কঠোর ইসলামী সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের ৫ই অগস্টের যে সন্ত্রাসী সমন্বয়, সেটা থেকে পাকিস্তানের আইএসআই নিয়ন্ত্রিত কট্টোর জিহাদি দলগুলো, যেমন জামাত, হেফাজত ও জিহাদি ছাত্র দলগুলো মাইনাস হয়ে যাবে। এর সাথে বাংলাদেশের সশস্ত্র স্টেট অ্যাক্টরদের মধ্যে যে জিহাদি মেজরিটি, তারাও নিষ্ক্রীয় হয়ে যেতে বাধ্য।
প্রথম থেকেই বাংলাদেশের রঙিন বিপ্লবে ইসলামী জিহাদি গোষ্ঠি, সেটা রাজনৈতিক দল হোক বা ধর্মীয় সংগঠন বা ছাত্রদের দল, এরা সবাই ছিল সিআইএর "সুবিধাজনক জোট" এর সদস্য। আশ্চর্য হচ্ছে সুবিধাজনক জোটে সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের ব্যক্তি, দল বা সংগঠন একত্রে কাজ করে। যেমন ৫ই অগস্টের ঘটনায় আমরা দেখছি কট্টোর জিহাদি, কট্টোর লিবারেল এলজিবিটি এবং কট্টোর মার্কসবাদী বাম নেতারাও এক সাথে মিলে মিশে গেছে।
যখন সিআইএ কোনো মিশনের জন্য রাজনৈতিক বা আদর্শগতভাবে ভিন্ন বা পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে, যারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা মিশনে একমত, তখন এই প্রথাকে সাধারণত "জোট গঠন" (কোয়ালিশন বিল্ডিং) বা "ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট অপারেশন" (ইউনাইটেড ফ্রন্ট অপারেশন) বলা হয়। সিআইএ-র প্রেক্ষাপটে, এটিকে অনেক সময় "সুবিধাজনক জোট" (এক্সপেডিয়েন্ট অ্যালায়েন্সেস) বা "অস্থায়ী আদর্শগত সমন্বয়" (টেম্পোরারি আইডিওলজিক্যাল অ্যালাইন্টমেন্ট) হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। সিআইএ প্রায়শই এই কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্পদ, নেটওয়ার্ক বা প্রেরণাকে কাজে লাগায়, যদিও তাদের দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডা পরস্পরবিরোধী হতে পারে। এই প্রথা বাস্তববাদের উপর ভিত্তি করে, যেখানে আদর্শগত সামঞ্জস্যের চেয়ে মিশনের সাফল্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সুবিধাজনক জোট তৈরি করতে গিয়ে প্রথমে তারা স্টেকহোল্ডার চিহ্নিতকরণ করে। সিআইএ গোয়েন্দা মূল্যায়ন করে এমন গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত করে যাদের স্বার্থ ওভারল্যাপ করে। এর মধ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, অতি উদারপন্থীরা, ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা, ব্যক্তিগত শত্রুরা, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বা এমনকি রাষ্ট্রের অ্যক্টররাও থাকতে পারে।
এদের সাথে সাধারণত সিআইএ অপারেটিভরা মধ্যবর্তী দালাল হিসেবে কাজ করে, শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করে এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করে। এতে আর্থিক প্রণোদনা, রাজনৈতিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি বা সুরক্ষার আশ্বাস জড়িত থাকতে পারে। এই মধ্যবর্তী দালালদের কারণে অনেক সময় এরা জানেনা যে এই অস্থায়ী আদর্শগত সমন্বয়ে আর কারা কারা আছে বা তাদের সার্বিক রাজনৈতিক বা আদর্শগত অবস্থান কি।
এর সাথে সিআইএ বা তাদের নিয়োগকৃত কোন সংস্থা সুবিধাজনক জোটের সকলকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে, যেমন, তথ্য ও নির্দেশনা, যোগাযোগ চ্যানেল, নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা অস্ত্র সরবরাহ, যাতে যৌথ অপারেশন সম্ভব হয়।
এর সাথে সাথে সিআইএ অপারেটিভরা বা তাদের নিয়োগকৃত সংস্থার লোকজন জোটের মধ্যে উত্তেজনা ব্যবস্থাপনা করা, অর্থাৎ দ্বন্দ্ব পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রশমন করে, কারণ আদর্শগত পার্থক্য অবিশ্বাস বা বিশ্বাসঘাতকতার কারণ হতে পারে। এই কারণে বাংলাদেশের জুলাই অগাস্টের ঘটনা ও বর্তমান সরকারের জন্য ইন্টারনেট এত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যম এখন উত্তেজনা ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
মিশন সম্পন্ন হয়ে গেলে সিআইএর একটি প্রস্থান কৌশল থাকে। সিআইএ প্রায়শই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং হাওয়া হয়ে যায়। তাদের আগে যে নাম ঠিকানা, ফোন নম্বর ছিল, ইমেইল অ্যাকাউন্ট বা অন্য কোন যোগাযোগের তথ্য ছিল, দেখা যায় সেই নামে বা সেই নম্বরগুলো কেউ কখনও ব্যবহার করেনি। গোষ্ঠীগুলোকে তখন তাদের পৃথক এজেন্ডা অনুসরণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়।
এই কারণে মিশন সম্পন্ন হয়ে গেলে সকল সিআইএ মিশনের বা রঙিন বিপ্লবের পরে ক্যায়স বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়া অবধারিত। সন্দেহজনক উদ্দেশ্য বা মানবাধিকার রেকর্ড সহ গোষ্ঠীগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হওয়া অনেক গোষ্ঠির দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক পরিণতির কারণ হতে পারে। আদর্শগত পার্থক্যের কারণে প্রাথমিক সফলতার “অস্থায়ী আদর্শগত সমন্বয়” এর জোটগুলো ভেঙে যায় যেহেতু আদর্শগত সমন্বয় ছিল লক্ষ্য ভিত্তিক, যেমন শুধুই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধের গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা পরবর্তী জটিলতা তৈরি করে যেমন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্য যারা সবাই একত্রিত হয়েছিল তারা সবাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিলোপ চায় না বা সবাই ইসলামী খিলাফতের শাসন চায় না।
এই “অস্থায়ী আদর্শগত সমন্বয়” এর কারণে সকল সিআইএ রাজনৈতিক প্রকল্পে ‘বুমেরাং’ বা ‘ব্যাকফায়ার’ ইফেক্ট ঘটে। যেটা হল ‘অপ্রত্যাশিত ফলাফল’ বা বিপরীত ফলাফল। অস্থায়ী জোটগুলি এমন গোষ্ঠীগুলিকে শক্তিশালী করতে পারে যারা পরে মার্কিন স্বার্থের বিরোধিতা করে বা যে কারণে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে তার বিপরীত ঘটনা ঘটে। যেমন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে বিতাড়নের আগে মূল অভিযোগ ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা, দুর্নীতি ও বাকস্বাধীনতা। এখন হাসিনা সরকারের পতনের পর বাকস্বাধীনতার হরণ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দুর্নীতি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ১০ গুন বেশী হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়াটির ফল শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামরিক স্তরেই থেমে থাকে না। কারণ এটি মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। যখন এটা শুরু করা হয় তখন থেকেই এর পরিকল্পনাকারী লোকজন জানে, ভয়ই সবচেয়ে বড় একত্রিতকারী শক্তি। যখন ভিন্ন গোষ্ঠীগুলো মনে করে (হয়ত ভ্রান্তভাবে, যেটির জন্যও আর একটি দল দীর্ঘদিন কাজ করেছে), একটি বিশাল শক্তি (যেমন হাসিনা, আসাদ বা গাদ্দাফি) তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি, তখন নিজেদের আদর্শ ভুলে গিয়েও তারা একে অপরের হাতে হাত রাখে। এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের ভেতর যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব আছে, সেটিকে হালকা করতে মনস্তাত্ত্বিক কৌশল নেয়—“এটা সাময়িক”, “আমরা বিক্রি হইনি”, “এই সাহায্য আমাদের অধিকার”।
এটাকেই মনোবিজ্ঞানে বলা হয় কগনিটিভ ডিজনেন্স রিডাকশন, অস্বস্তিকর সত্যকে নিজের মতো করে মানানসই করে নেওয়া। অস্বস্তিকর সত্যকে নিজের মতো করে মানানসই করে নেওয়া কিন্তু শুধুই আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে যায়। যার ফল হল ধর্ম, সংস্কৃতি ও পরিবারের মূল্যবোধ নিয়ে নিজের অবস্থানে শক্ত থাকার মানসিকতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ধর্ম, সংস্কৃতি ও পরিবারের মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা। এর ফল হল একটি ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বর্ণীল প্রাণবন্ত আদর্শে বলীয়ান সমাজের ঢিলা, অতি উদারপন্থী এলজিবিটি সমাজে পরিণত হওয়া।