শহুরে খিস্তি বা আরবান স্ল্যাং হিসাবে আমেরিকায় একটা উপদেশ প্রচলিত আছে “ডোন্ট স্টিক ইয়োর ডিক ইন ক্রেইজি”, যার ভদ্র অর্থ হলো মাথায় সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে বিছানায় নিও না। আমরা তো আবার ওদের মত ভাল লাগলেই মেয়েদের বিছানায় নেই না, দলিল পত্র করে তারপর বিছানায় নেই।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় রাস্তায় যখন হাজার হাজার শিশু কয়েক দিন ধরে দাঁড়িয়ে, বসে রাস্তা দখল করে রেখেছিল। সকল দাবী মেনে নেবার প্রতিশ্রুতির পরও যখন তাদের বড় অংশ ক্লাসে ফিরছিল না। ওদিকে সরকার পুলিশকে যখন কোন অ্যাকশনে না যাবার নির্দেশ দিয়েছিল। যখন খবর আসছিল এখান সেখানে সংঘাতের, প্রতিটি বিবেচনাশীল ব্যক্তি তখন অনুভব করেছিলেন বিষয়টা ভালো কিছুর দিকে যাচ্ছে না। যে কোন মুহূর্তে কোন পক্ষের অবিবেচনাশীল কর্মকান্ডে বা উসকানি-প্ররোচনায় শিশুদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক কিছু ঘটে যেতে পারে।
এটা কল্পনা করা কষ্ট নয় যে একটি মহল সেটিই চায় এদেশ। শুধু যে অপরাজনীতি যারা করে, ইসলামি মৌলবাদী বা সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি যারা করে তারাই শুধু নয়, যারা পত্রিকা চালায়, মারাত্মক কিছু ঘটলে যাদের সাইটে হিট বাড়ে বিক্রি বাড়ে, আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব বাড়ে, ডাক পড়ে – তারাও চায়। আর চায় ব্যাপক তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত শান্তিপ্রিয় ভাল খাওয়া ভাল পরা কিন্তু মানসিকভাবে অপরিণত যারা তারা। যাদের মন হিংসা আর নেতিবাচক আবেগে পরিপূর্ণ, তারা চায় যে কিছু একটা ঘটুক। যাতে সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারি কত খারাপ আমাদের দেশ, রাষ্ট্র সরকার। এটা আসে সম্পূর্ণরূপে এক প্রজন্মে এই ভাল খাওয়া ভাল থাকার অপরাধবোধ আর নেতিবাচকতা থেকে যাদের চৌদ্দ পুরুষও কোনদিন ভাবে নাই যে তারা এত ভাল থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ এমন অবস্থায় একজন আকর্ষণীয়া অভিনেত্রী যখন চার জনকে হত্যার আর তার কোন ছোট ভাইয়ের চোখ তুলে নেবার গুজব ছড়ালো শুধু না, সেই মিথ্যা অভিনয় করে তাতে পেশাগত আবেগ ঢেলে যে মারাত্মক অপকর্মটি করলেন, সেটি নিয়ে তার অনুসারীরা যেমন ক্রমাগত নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিল যে তিনি সেটি নাকি সে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করেননি। যদি তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেটি না করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ক্রেইজি, মানে মানসিক বিকারগ্রস্ত। কোন সুস্থ মস্তিস্কের ব্যক্তি রাজনৈতিক বা আর্থিক উদ্দেশ্য ছাড়া শিশুদের নিয়ে এমন বিপজ্জনক কর্ম কখনই করতে পারে না। তার আগে সে ভাববে যে, সে যা করছে তার ফল কি হতে পারে। সে তো বিদ্যালয়ের শিশু নয়, এমন কি কিশোরী বা অবলা নারীও নয় যে না বুঝে আবেগতাড়িত হয়ে এমন করেছে।
এমন অপকর্মের পর যখন সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নেয় এবং তাঁকে বারবার বলে যে তারা ঘটনাস্থল দেখেছে, সেখানে কোন লাশ নেই, তেমন কোন ঘটনা ঘটে নি, তখনও উক্ত অভিনেত্রী কোনরূপ ভুল ভাঙ্গার, লজ্জিত হবার বা অপরাধবোধের কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি –বরং তাঁর বক্তব্যে ছিল ঔদ্ধত্য এবং তিনি যেন ঠিকই করেছেন এটা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস যাকে মনোবিদ্যার ভাষায় বলে অস্বীকৃতি বা ডিনায়াল। যে কোন মানুষ ভুল করতে পারে। যে কোন সুস্থ মানসিকতার মানুষ ভুল করলে তারপর ভুলটি ভুল হিসাবে প্রতিমা হলে যেটা অবশ্যই তার মধ্যে দেখা দেবে সেটা হল রিমোর্স বা অপরাধবোধ। যার মধ্যে রিমোর্স নেই সে মানসিকভাবে সুস্থ নয়, সে ক্রেইজি।
কিন্তু মাথায় সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে বিছানায় নিলে কি হয়? সেটারও ফল শহুরে খিস্তি বা আরবান স্ল্যাং হিসাবে বলা হয়ে থাকে “ইউ গট ব্রেইনফাকড”। যার অর্থ তারা তোমার মস্তিস্কের মগজকে বলৎকার করা শুরু করবে। বাংলায় অসংখ্য প্রবাদ আছে কিন্তু এই দুটো প্রবাদ নেই। তাই হয়ত এদেশে ক্রেইজি আর ব্রেইনফাকড এর সংখ্যা আজকাল এত বেশী। বৃদ্ধ ভীমরতি হওয়া লেখক সম্পাদকদের মধ্যে এই সংখ্যা আরও বেশী।
জীবন সমাজ রাজনীতি – এগুলো বুঝতে গেলে সিস্টেমস বুঝতে হয়। কিন্তু একজন আবেগে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি সিস্টেমস বোঝে না। সে শুধু বোঝে সে কি অনুভব করছে। এদের বলা হয় সিস্টেমস ব্লাইন্ড। এদের সাথে দীর্ঘদিন যারা তাল মিলিয়ে চলতে যাবে, তারা ক্রমেই সিস্টেমসের বোধ হারিয়ে ফেলবে। মনোবিদ্যা তাই বলে, দীর্ঘদিন যারা আবেগ সংক্রান্ত ব্যাধিগ্রস্তদের নিপীড়ন বা অ্যাবিউজের শিকার, তারাও মানসিক সমস্যায় ভোগা শুরু করে। যেমন একজন নার্সিসিস্টের ভিক্টিম একজন নার্সিসিস্টে পরিণত হয় যদি না সে এর বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধ করে থাকে ও নিজেকে আবেগগতভাবে মুক্ত রাখতে পারে। জীবন, সমাজ, রাজনীতি এগুলো থেকে দুরে থাকার ফলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সিস্টেমসের বোধ হারিয়ে ফেলে। সিস্টেমস ব্লাইন্ড হয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা শিশুদের মত সরল সাদা-কালো হয়ে যায়। জটিল সমস্যার সরল সমাধান তারা বেছে নেয়। তাদের রাজনীতি তাই পরিণত হয় খুন আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে।
কিন্তু এই ক্রেইজি ও ডিকেরা যখন একত্রিত হয়। তখন তাদের সম্মিলিত পদ্ধতিটা খুব চমৎকার। ক্রেইজিরা “ভুল” করে গুজব ছড়াবে আর ব্রেইনফাকডরা ইংরেজিতে তরজমা করে সারা পৃথিবীতে সেটা ছড়াবে। ব্রেইনফাকডরা জানে না মানবাধিকার, মুক্ত চিন্তা, বাকস্বাধীনতা কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এগুলো সিস্টেমেরই অংশ বা পার্ট অব দ্য সিস্টেমস। পুরো সিস্টেম ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল না হলে মানবাধিকার বা সড়ক নিরাপত্তা কোনটাই রক্ষা করা যায় না। সিস্টেমস ব্লাইন্ডরা জানে না মিথ্যাবাদীরা বাকস্বাধীনতা ও সত্যের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে। আমাদের চোখের সামনে গত দুই যুগে ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের প্রাপ্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা আর স্বাধীনতা এর মধ্যেই সারা দুনিয়ার বাকী শান্তিপ্রিয় মানুষের অনেক প্রকার স্বাধীনতা হরণ করে ফেলেছে।
কিন্তু এ ঘটনা বাংলাদেশে কি নতুন? ৭১ এর পর ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত এরকম অনেক ক্রেইজি ফাকেরা মিথ্যা রটিয়েছে। মিথ্যা রটিয়েছে মুজিবের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে, বেগম মুজিবকে নিয়ে নোংরা গল্প ফেঁদেছে। মুজিব পুত্রের অন্যের বৌ অপহরণ, শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি। রক্ষীবাহিনীর গণকবর। বাকশালের নানা কেচ্ছা কাহিনী। অথচ র্যাব প্রতিষ্ঠিত হবার পর তারা যে বিচারবহির্ভূত কাজ কর্ম করেছে অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে, রক্ষীবাহিনী তাই করেছে যুদ্ধবিধস্ত দেশে অস্ত্র উদ্ধার এবং বামপন্থী সন্ত্রাসবাদ দমনে। অথচ এইসব ব্রেইনফাকডরা ছড়িয়েছে রক্ষীবাহিনী নাকি হিটলারের নাৎসি পুলিশের মত ছিল (রক্ষীবাহিনী, মাসকারেনহাস, উইকিপিডিয়া)। এই সব নিরন্তর মিথ্যা এখনও অনেক শুদ্ধ ইংরেজি বলা দালালেরা ছড়িয়ে চলেছে ঠিক সেই তখনকার এনায়েতুল্লাহ খানদের মত। সেই ইংরেজি বলা ব্রেইনফাকডরা যারা নিয়মিত সারা বিশ্বে গুজব ছড়িয়েছে মুজিবকে, বাংলাদেশকে ছোট করা হেয় করার জন্য। যার পরিণতিতেই খুন হন সপরিবারে মুজিব, তারপর ২০ বছরের জন্য পাকিস্তান আর ইসলামী সন্ত্রাসবাদের রাহু গ্রাসে পড়ে বাংলাদেশ।
তারই এক ভিকটিম নিহত ব্লগার অভিজিতের বাবা প্রফেসর অজয় রায় লিখছেন "আমি ঠিক জানি না মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তার (এনায়েতুল্লাহ খান) ভুমিকা কি ছিল, কিন্তু সে কখনই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দাবী করে নি। বরঞ্চ ৭১ এর ঐ সময়ে যখন পুরো জাতি ভেতর এবং বাইরে থেকে পাকিস্তানিদের বর্বরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সে ঐ সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে খুবই সমালোচনামুখর ছিল।“
তিনি আরও লিখেছেন “বিজয়ের পরে যখন আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে, তখনও এনায়েতুল্লাহ খান ও তার হলিডে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সমালোচনায় লিপ্ত ছিল”।
এর পর তিনি লিখেন “এরপর শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যার পর এনায়েতুল্লাহ ও তার হলিডে প্রকাশ্যে তাদের উল্লাস প্রদর্শন করে এমনকি খুনি মোশতাক ও তার সূর্যসন্তান ফারুক, রশীদ, পাশাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়”।
তিনি আরও লেখেন “এরপর এনায়েতুল্লাহ খান তৎকালীন সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানেই তার মনের গভীরে ভারত, হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নিয়ে তার প্রকৃত কি মনোভাব কি সেটা প্রকাশিত হয়েছে”।
এরপর এই ভদ্রলোক সামরিক শাসক জিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হন, মন্ত্রী হন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি রবীন্দ্র সংগীতও পছন্দ করতেন।
বাঙালি সংস্কৃতির গুণগান গাইতেন। বোকা বাঙালী এই নকল চরিত্র বা কন আর্টিস্টকে খুব আপন মনে করত। এই এনায়েতুল্লাহর চীনপন্থী বাম ধারা হবার ইতিহাসও মজার। আইয়ুব খান মার্কিন ভূরাজনীতির কৃপায় পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্র আনার পর চীন তাকে সহযোগীতার দুয়ার খুলে দেয় যার ফলে অনেক শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর মনে বাম শিশু জন্মে। এই সামরিক-বাম আঁতাত থেকেই আমাদের দেশের পাকি বামের সূচনা।
অজয় রায় তাই লিখেছেন একটা খুব চাপা ধূর্ত চরিত্র ছিল তার যার অসম্ভব চাতুরী ও ম্যানিপুলেটিভ কেপাবিলিটি ছিল। তার মধ্যে একটা "লুক্কায়িত সাম্প্রদায়িকতার" কথাও তিনি লিখেছেন।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে দেশে গুজব ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যেটা ঘটেছে সেটাকে নিরীহ ভাবা চরম ভুল। গুজব তৈরী, গুজব ছড়ানো এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে চরিত্রহনন সামরিক ট্যাকটিকসের অংশ। আমাদের দেশে এটা এসেছে পাকি-মার্কিন সিআইএ-আইএসআই ট্যাকটিক্যাল সাইঅপস ইনটেলিজেন্স থেকে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত অবিরতভাবে এবং সেই মিলিটারি ট্যাকটিকসের ফলই হলো শেখ মুজিব ও স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও দেশের ভেতরের, বিশেষ করে আত্মবিশ্বাসহীন ও নেতিবাচক শিক্ষিত সমাজের কাছে আস্থার অভাব।
একজন খুনির মনে সবচেয়ে বড় বাধা আর ভয় খুনের পর তার কি হবে, যদি সে ধরা পড়ে। খুন হওয়া ব্যক্তির চরিত্রহনন তাকে সেই অগ্রিম সুবিধা দেয় যে সে মাল্যভুষিত হবে যারা গুজবে বিশ্বাস করেছে তাদের দ্বারা। এই কারণেই গুজব ভবিষ্যত খুনিদের উৎসাহ বা ইন্সপিরেশন এবং একটি রক্ষাকবজ বা ইন্সট্রুমেন্ট অব ডিফেন্স। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন নিয়ে যারা গুজব রটিয়েছেন, যেভাবে আপাতভাবে অরাজনৈতিক প্রেস ব্যক্তিত্বদের মারফত সেটাকে আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমকে ভুল পথে নেওয়া হয়েছে এবং যেভাবে পদ্ধতিগতভাবে সারা পৃথিবীর নানা দেশের সাংবাদিকদের কাছে ভুয়া খবর বিতরণ করা হয়েছে - এগুলো সব কখনই শিশুদের সড়ক আন্দোলনের মোটিভ থেকে করা হয় নি। সামরিক পরিকল্পনা আর প্রেসক্রাইবড সাইঅপস ম্যান্যুয়ালে বর্ণিত প্রসিডিউর অনুযায়ীই করা হয়েছে। যদি আমরা ধরেও নেই সেই গুজব অভিনেত্রীর জন্ম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং তাঁর বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এটা নেহাতই কাকতালীয়।