EN
আরও পড়ুন
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -২
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -১
ধর্ম ও দর্শন
শহুরে শিক্ষিত দালালদের শক্তিশালী করার কৌশল
ধর্ম ও দর্শন
JadeWits Technologies Limited
তারুণ্য ও উন্নয়ন

বোজো বিস্ফোরণ - ২

বোজো কারা?

ভারতের জি-টিভির সা রে গা মা পা-২০২৩-এ মঞ্চ। জি-টিভির সা রে গা মা পা একটি সঙ্গীত ট্যালেন্ট সার্চ প্রতিযোগীতা। যেখানে নতুন ও প্রথা বহির্ভূত ট্যালেন্টরা অডিশন রাউন্ডে তাদের সঙ্গীত পরিবেশন করে। এর পর নানা ধাপে তারা বাছাইকৃত হয় সেরা মেধার সারীতে। গত ২৭শে অগাস্টের সা রে গা মা পা-২০২৩ এর অডিশন রাউন্ডের প্রতিযোগিতার মঞ্চে বিচারকের আসনে ছিলেন ভারতের সঙ্গীত জগতের বিখ্যাত গায়িকা নীতি মোহন, সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক হিমেশ রেশমিয়া ও অনু মালিক।

২৭শে অগাস্টের অডিশন রাউন্ডে এসেছিলেন চেন্নাইয়ের কার্তিক কুমার কৃষ্ণমূর্তি। ২৬ বছর বয়ষ্ক কার্তিক মঞ্চে এসেছিলেন তার বাবা মা এর সাথে। সুন্দরী গায়িকা নীতি মোহন কার্তিককে প্রশ্ন করলেন “কাঁহাসে আপ (আপনি কোথা থেকে এসেছেন)?” জবাবে কার্তিক বলল “কাঁহাসে আপ?”। বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে পুনরাবৃত্ত প্রশ্ন শুনে সুন্দরভাবে একটা হাসি দিলেন গায়িকা নীতি মোহন। তখন পাশে থাকা কার্তিকের মা কার্তিকের হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে বললেন “আমরা চেন্নাই থেকে এসেছি”। কার্তিকের মা রাজি কৃষ্ণমূর্তি আরো বললেন “যখন ও বুঝতে পারে না অন্যরা কি বলছে তখন সে যা শুনে সেটা রিপিট করে”। তিনি আরো যোগ করেন “ওর অটিজম আছে তাই সে ঠিকমত কথা বলতে পারে না”।

এর পর একটা ভিডিও ক্লিপে দেখানো হয় কার্তিকের বাসার দৃশ্য যেখানে তার মা কার্তিকের অবস্থা সম্পর্কে একটি বর্ণনা দেয়। যেখানে কার্তিকের মা বলে “কার্তিকের অটিজম এতই প্রকট ছিল যে তার পুরো ভার্বাল কমিউনিকেশন অকার্যকর। ও কারো সাথে কথা বলতে পারে না। অল্প অল্প ও ছোট ছোট বাক্যে তাকে কিছু বলতে হয়। যেমন কার্তিক এটা কর, কার্তিক এদিকে আস। এর চেয়ে বেশি বলা হলে সে বুঝতে পারে না। যখন আমরা কার্তিককে নিয়ে বাইরে যাই মানুষের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ও এত হ্যান্ডসাম, এত কিউট, কিন্তু তারপর তাকে দেখে মানুষের মনে হয় তার কোন সমস্যা আছে। এর পর সবাই দুরে থাকে। সামাজিকতাও আমাদের এত কম হয় যে কেউ আমাদের ডাকেও না, জন্মদিনের পার্টি হোক বা যাই হোক, সবাই আমাদের অ্যাভয়েড করে।

কার্তিকের বাবা কৃষ্ণমূর্তি নারায়নাস্বামী বলে কার্তিকের জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু শেখার থাকে। বাইরে শিশুরা আসে, কার্তিককে বলে একটা গান গাইতে, কার্তিক তখনই একটা গান গেয়ে শোনায়। কার্তিকের কোন ধারনাই নেই তারা কারা, তারা গরিব না ধনী, সব লোক তার কাছে একই।

কার্তিকের মা বলে কার্তিক আমাদের সবার চেয়ে আলাদা। কারো চেয়ে কম নয়। ওকে আমরা গান গাইতে উৎসাহীত করি কারণ গাইবার সময় সে খুশি থাকে। এই খুশিটুকু তার সবসময় দরকার। কার্তিকের মা আরো বলে যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদুন আমি তার দেখাশোনা করতে পারব। আমার পরে কি হবে? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে শুধুমাত্র আমিই ওর দেখাশোনা করতে পারব যদিও ধারণাটা একদমই ঠিক নয়। আমার মনে হয় একমাত্র আমিই ওর দেখাশোনা করতে পারি। ও যাতে সবসময় সুখী থাকে এটাই আমি চাই। আমার মনে হয় ওকে ছেড়ে আমি মরেও শান্তি পাব না।

এর পর অডিশন শুরু হয়। নীতি মোহন প্রশ্ন করে “তাহলে কার্তিকের সঙ্গীতে অনেক উৎসাহ আছে”? জবাবে কার্তিক প্রশ্নটা আবার রিপিট করে। কার্তিকের মা বাবা উভয়েই বলে সঙ্গীত তার জীবন, সঙ্গীত তার ভাষা তার প্যাশন। অনুষ্ঠানের রীতি মেনে অডিশন রাউন্ডের গান শুরু করেন কার্তিক জয়দীপ সাহনির কথা, সেলিম-সুলাইমানের সঙ্গীত ও রাহাত ফতেহ আলী খানের গাওয়া ‘ও রে পিয়া’ গানটি গেয়ে। সুর কথা ও ভাবপ্রকাশের জটিল ও সুক্ষ্ম এই গানটির একটি শ্বাসরুদ্ধকর পারফরম্যান্স প্রদান করে কার্তিক। বিচারক আনু মালিক কার্তিকের পার্ফমেন্সকে "মাস্টারপিস" হিসাবে প্রশংসা করেন। বিচারক হিমেশ রেশমিয়া তার পারফরম্যান্স "অলৌকিক" হিসাবে উল্লেখ করেন। বিচারক নীতি মোহন কার্তিকের পারফরম্যান্সকে "জাদুকরী" বলে বর্ণনা করেন। কার্তিক কৃষ্ণমূর্তি সম্পর্কে আরো জানা যায় যে কার্তিক কৃষ্ণমূর্তি কিবোর্ড ও গিটার বাজাতে পারে। এবং তার আছে ফটোগ্রাফিক মেমোরী। পলক মাত্র দেখে সে ছবি, লোগো বা কোন আর্টওয়ার্ক মনে রাখতে পারে।

অটিস্টিক আমরা তাদেরই বলি যাদের শিশু বয়সের বিকাশজনিত সমস্যা থাকে যা তিন বছর বয়সে দেখা যায়। যেটা বিশেষত সামাজিক সম্পর্ক গঠন এবং বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরী করে। যেটা ভার্বাল বা নন ভার্বাল যোগাযোগের অক্ষমতা, পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণের ধরণ এবং সীমাবদ্ধ বিষয়ে আগ্রহ ও কার্যকলাপ দেখে চিহ্নিত করা হয়।

জি-টিভির সা রে গা মা পা-২০২৩ এর কার্তিক কৃষ্ণমূর্তি কারো সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারে না। অল্প অল্প ও ছোট ছোট বাক্যে তাকে কিছু বলতে হয়। যেমন কার্তিক এটা কর, কার্তিক এদিকে আস। কার্তিকের সমস্যাটা সামাজিক আচরণের খুবই ভিত্তিমূলের যেটা তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে অস্বাভাবিক, সীমিত ও পরনির্ভর করে তুলেছে।

কার্তিকের উচ্ছসিত পার্ফমেন্স প্রদর্শনের পর ক্যামেরা যখন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের খ্যাতনামা ও সফল ব্যক্তিত্ব বিচারকদের দিকে প্যান করে স্থির হয়, তখন আমার মনে হতে থাকে কার্তিকের সাথে এই স্টারদের তফাৎটা কোথায়? কার্তিকের মত সঙ্গীতে জাদুকরী দক্ষতা থাকার সাথে সাথে দৈনন্দিন ও সামাজিক আচরণেও তারা সাধারণ মানুষদের চেয়ে অনেক দক্ষ। তাই তারা দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক দক্ষতা, পেশাগত প্রতিযোগীতা পেরিয়ে আজ এখানে বিচারকের আসনে আসীন। এই বিচারকদের যদি আমার একটি সামাজিক মনোবৈজ্ঞানিক লেখা পড়তে দেওয়া যায় তারা কি সেটা পড়ে বুঝতে পারবে? পরবে না। কার্তিকের মত অল্প অল্প ও ছোট ছোট বাক্যে তাদের সেটা ভেঙ্গে বলতে হবে।

অটিজম হল সামাজিক যোগাযোগ, সম্পর্ক গঠন এবং বজায় রাখতে পারার অক্ষমতা থেকে সৃষ্ট স্বনির্ভর জীবনযাপনের অক্ষমতা। অটিস্টিক কার্তিকের কিন্তু আছে ফটোগ্রাফিক মেমোরী এবং জটিল সূর ও সঙ্গীতের অসাধারণ পুনরুৎপাদনের বা প্রতিরূপ তৈরীর ক্ষমতা। কিন্তু সেই সঙ্গীতের অর্থ, সেই সঙ্গীতের সাথে যুক্ত মানব মানবীর প্রেমের আবেগ ও সূরের আধ্যাত্মিকতার যে যোগ সেটা তার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

সামাজিক যোগাযোগ, সম্পর্ক গঠন এবং বজায় রাখতে পারার অক্ষমতার মতই মানুষের থাকতে পারে ব্যক্তি, সমাজ, প্রকৃতি, ভৌত বাস্তবতা, বিমূর্ত যৌক্তিকতা ও জীবনকে বোঝার অক্ষমতা। এসকল ব্যক্তিদেরও থাকতে পারে অসাধারণ পুনরুৎপাদনের বা প্রতিরূপ তৈরীর ক্ষমতা। কার্তিকের চেয়েও তাদের থাকতে পারে অনেক শক্তিশালী ফটোগ্রাফিক মেমোরী। যারা পার্ফমেন্সে অতি দক্ষ কিন্তু কনটেক্সট বোঝে না। উপরের নির্দেশ মানা ও নিজের উদর পুর্তি ছাড়া তাদের কোন চালিকা শক্তি নাই, নিজস্ব কোন ভিশন নেই। কার্তিক সঙ্গীতে যেমন তারা শিক্ষায় বা জ্ঞান বিজ্ঞানে তেমন। তারা পারফর্ম করতে পারে কিন্তু সৃষ্টি করতে পারে না। এরাই বোজো।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।