ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে যে কোন 'অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা মোকাবিলায় শান্তি রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেন। ভারতের মত একটি আসন্ন সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর খোলা বক্তৃতায় এমন কথা বলা মানে এটা হুমকি যার ব্যাপক কুটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমারিক প্রভাব থাকবে।
রাজনাথ সিং এর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া (সেনাপ্রধান ২০১২ সালের ২৫ জুন থেকে ২০১৫ সালের ২৫ জুন) তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে বলেছেন, ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সশস্ত্রবাহিনীকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধানদের মূল্যায়ন করা উচিত, কখন বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার কাজ শেষে তারা দেশরক্ষার মূল দায়িত্ব সমর প্রস্তুতিতে নিয়োজিত হতে পারবেন। কিন্তু নবনিযুক্ত প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা যতদ্রুত সম্ভব সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ‘লেভি এন মাস’ ধারণাটি বৈপ্লবিক জনপ্রতিরক্ষার জন্য কার্যকরী পন্থা। (বণিক বার্তা/নয়া দিগন্ত)
উল্লেখ্য, ‘লেভি অ্যান ম্যাস’ বাক্যটি ফরাসি (ফ্রান্স) ভাষা থেকে এসেছে। ফ্রান্সে বিপ্লবের সময় (১৭৯২-১৭৯৯) ১৮ থেকে ২৫ বছরের সক্ষম সব যুবককে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। পেশাদার সেনাবাহিনীর সমান্তরালে উল্লিখিত বয়সী যুবকদের নিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এদেরকে শত্রুর সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি সীমান্ত রক্ষা করার জন্য এ ধরনের বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বর্তমানেও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে যুবকদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
এই যে ছবিটা আমরা পাচ্ছি যে একটি দেশের সামরিক প্রস্তুতির কথা আর বিনিময়ে অপর দেশের ১৮ থেকে ২৫ বছরের সক্ষম সব যুবককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা এটাই সেই মিলিশিয়া বাহিনীর ধারণা ইউক্রেন সম্পর্কে যার কথা কাল লিখেছিলাম।
যাই হোক, আমরা ইউক্রেন সঙ্কটের বিশদ কালানুক্রমিক বিশ্লেষণের পরবর্তি অংশটিতে যাই:
৪. ২০১৩-২০১৪: ইউরোমাইদান এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
ইউক্রেনের রাজনীতিতে এর পর থেকেই পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে চরম টানাপোড়েন চলছিল। একদিকে পশ্চিম ইউক্রেনের জনগণ এবং রাজনীতিবিদরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন, অন্যদিকে পূর্ব ইউক্রেনের জনগণের একটি বড় অংশ রাশিয়ার সাথে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন। এই বিভাজন ২০১৩-২০১৪ সালের ইউরোমাইদান আন্দোলনের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৩ সালের নভেম্বরে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি সম্ভাব্য সহযোগিতা চুক্তি বাতিল করেন। এই চুক্তি ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ইয়ানুকোভিচের এর বিপরীতে রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি বাতিলের প্রতিবাদে কিয়েভের স্বাধীনতা স্কয়ারে (Maidan Nezalezhnosti) হাজার হাজার মানুষ সমবেত হতে শুরু করে। এই আন্দোলন দ্রুতই ‘ইউরোমাইদান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আন্দোলনটি প্রথমে শান্তিপূর্ণ হলেও, ডিসেম্বরের শুরুতেই তা সহিংস রূপ নিতে থাকে, যখন সরকার আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য বলপ্রয়োগ করে।
ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত ইউরোমাইদান আন্দোলন ক্রমশ সহিংস হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা সরকার বিরোধী অবস্থানে দৃঢ় হয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের পদত্যাগের দাবি জানায়। সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং সহিংসতা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। এই সময়ে শত শত মানুষ হতাহত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ইউরোমাইদান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। পশ্চিমা দেশগুলি ইয়ানুকোভিচের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে, যার ফলে তার সরকার রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ইয়ানুকোভিচের ক্ষমতাচ্যুতি: ২০২৪ এর জুলাইয়ে শেখ হাসিনার মতই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় চলে যান। ইউক্রেনের পার্লামেন্ট তার পদত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং একটি নতুন সরকার গঠন করে, যা স্পষ্টভাবে পশ্চিমাপন্থী ছিল। এই পরিবর্তন ছিল একটি পশ্চিমা সমর্থিত সিআইএ পরিকল্পিত ও আমেরিকার অর্থ লগ্নির অভ্যুত্থান।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া: ইউরোমাইদান আন্দোলনের পর ইয়ানুকোভিচের পতনকে রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখে। মস্কো মনে করে যে, ইউক্রেনের নতুন সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর হাতে পরিচালিত হচ্ছে এবং এটি ন্যাটোর সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে ব্যবহার করবে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রোপাগান্ডা: ইউরোমাইদান আন্দোলন এবং পরবর্তী সংঘাতের সময় সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউব আন্দোলনকারীদের সংগঠিত করতে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে ব্যবহৃত হয়।
৫. ক্রিমিয়া দখল এবং দোনবাস যুদ্ধ: সিআইএ-এর ভূমিকা
২০১৪ সালের ইউরোমাইদান আন্দোলন এবং ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের ক্ষমতাচ্যুতি ইউক্রেনকে গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া দ্রুততার সাথে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে বিদ্রোহের সূচনা হয়। এই দুটি ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে এবং এতে সিআইএ (CIA) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকলাপ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
ক্রিমিয়া দখল
ক্রিমিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব: ক্রিমিয়া একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপদ্বীপ, যা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে ব্ল্যাক সি (Black Sea) এর সাথে সংযুক্ত। ক্রিমিয়া রাশিয়ার নৌবাহিনীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বন্দর এবং এটি রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের প্রধান ঘাঁটি। ঐতিহাসিকভাবে, ক্রিমিয়া রাশিয়ার একটি অংশ ছিল, কিন্তু ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভ এটি ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে দেয়।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে, ইউক্রেনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়ার পর, রাশিয়ান সেনাবাহিনী দ্রুত ক্রিমিয়া দখল করে। রাশিয়া এই দখলকে 'পুনর্মিলন' হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ক্রিমিয়ায় একটি গণভোট আয়োজন করে। এই গণভোটে ক্রিমিয়ার জনগণ রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। রাশিয়া এরপর দ্রুত ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেখানে সামরিক উপস্থিতি শক্তিশালী করে।
দোনবাস যুদ্ধ
ক্রিমিয়া দখলের পর, পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক (Donetsk and Luhansk) অঞ্চলে বিদ্রোহীরা রাশিয়ার সমর্থনে স্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি করে। ইউক্রেন সরকার এই বিদ্রোহকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে দোনবাস অঞ্চলে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়।
সিআইএ-এর ভূমিকা
ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী মোড়ে সিআইএ-এর ভূমিকা: ইউরোমাইদান আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীতে, সিআইএ-র সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিআইএ এবং অন্যান্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইউক্রেনে পশ্চিমাপন্থী সরকারের উত্থানে সহায়তা করেছিল। এটি রাশিয়ার দৃষ্টিতে একটি স্পষ্ট হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়, কারণ তারা মনে করেছিল যে, ইউক্রেনকে ন্যাটো (NATO) এবং পশ্চিমা সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত করার একটি পরিকল্পনা ছিল।
ক্রিমিয়া দখলের প্রতিক্রিয়া: রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলকে পশ্চিমা প্রভাব এবং সিআইএ-এর কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে। রাশিয়ার মতে, সিআইএ এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা করছিল। ক্রিমিয়া দখল ছিল রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই হুমকির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ।
দোনবাসে বিদ্রোহ এবং সিআইএ-এর সম্ভাব্য কার্যকলাপ: দোনবাস যুদ্ধের সময়, রাশিয়া অভিযোগ করে যে, সিআইএ এবং অন্যান্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিদ্রোহ দমনে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সহায়তা করছিল। বিশেষ করে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহে সিআইএ-র ভূমিকা উল্লেখ করা হয়। যদিও এই অভিযোগের প্রমাণ প্রকাশ্যে আসেনি, তবে এটি রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে অবিশ্বাসের একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৬. সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিগ্রাম, এবং পশ্চিমা প্রভাব
ইউক্রেন সংকটে সোশ্যাল মিডিয়া এবং টেলিগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। টেলিগ্রাম বিশেষ করে রাশিয়া এবং পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের জন্য একটি নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিমা দেশের ডিজিটাল রেভল্যুশন মেশিন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউব প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে, ফেসবুক এবং টুইটার ইউরোমাইদান আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের সংগঠিত করতে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি, ইউক্রেনের ফর-রাইট এবং অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীগুলোকেও সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।
অন্য পর্বগুলো: