EN
আরও পড়ুন
ধর্ম ও দর্শন
গ্লোবালিস্টদের উদ্যোগ ও সহায়তায়
গবেষণা
বহুকাল দারিদ্র ও অপুষ্টিতে ভোগা সমাজের হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া
রাজনীতি
মিয়ানমার নিয়ে বিপজ্জনক খেলা
রাজনীতি
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর হুমকি
রাজনীতি
JadeWits Technologies Limited
রাজনীতি

আমেরিকার আরোপ করা প্রথম স্যাংশন ও

৭৪ এর দুর্ভিক্ষ

১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে নাকি কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন পর্ব চলছে। ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কারন কি ছিল, একটু জেনে নেয়া যাক।

১৯৭৩ সালে এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ভেতর ২৯৩ আসনে জিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যেখানে ৫৪.৯% ভোটার ভোট প্রদান করে। ১৯৭৪ সালে সেই জনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক রোমান্টিকতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিল যার ফলে সূচনা হয় ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের। এই দুর্ভিক্ষের একটি ট্রিগার ছিল বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার আরোপ করা প্রথম নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন।  

স্বাধীনতার পর পর সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে খাদ্য প্রয়োজন সেটা উৎপাদনের ক্ষমতা দেশের ছিল না। দেশে ১৯৭২ সালে ধানের উৎপাদন হয় সর্বনিম্ন। স্টেপল ফুড বা মুখ্য আহারের জন্য জাতি নির্ভর করে ছিল বিদেশী খাদ্য সাহায্য বা যৎসামান্য যে বৈদেশিক মুদ্রা যোগাড় হয় সেটা দিয়ে খাদ্য ক্রয় যার উৎসও তখন ছিল সীমিত। উল্লেখ্য যে ১৯৭২ থেকে ধান উৎপাদন বাড়তে থাকে এবং দুর্ভিক্ষের বছর সেটা রেকর্ড পরিমাণে বাড়ে।

১৯৭২ এর উৎপাদন থেকে ১৯৭৪ সালে ধান উৎপাদন চারগুন বাড়ে। তবুও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এর একটা বড় কারণ তখনকার কুটনীতি ও বিদেশনীতি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আইনগত নির্বুদ্ধিতা অথবা অবহেলা। সত্তুরের দশকের প্রথম দিকে ঠান্ডা যুদ্ধের চুড়ান্ত সময়ে যখন ভিয়েতনামে আমেরিকার পরাজয়ের সংকেতগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে সেই সময়ে আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পশ্চিমা ধনতন্ত্রের জন্য সমাজতন্ত্রের কাছে পরাজয়েরই অশনিসংকেত ছিল। 

১৯৭১ এর যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বের চোখে কমিউনিস্ট ভাবধারার সোভিয়েতপন্থি আদর্শের সমাজতান্ত্রিক অবকাঠামোর বাংলাদেশ ধারণাটা ছিল অনাকাঙ্খিত। মুক্তির আন্দোলনের নেতাদের মনে করা হত তারা বামপন্থি রেবেল বা বিদ্রোহী গোষ্ঠি। কিন্তু ১৯৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের চরম বর্বরতা এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ইতিহাস, সেটা দেরিতে হলেও পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক মিডিয়াই সারা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরে। এর ফলে ১৯৭১ এর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বাগতম জানায় আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ। স্বাধীনতার মাত্র চার মাসের মধ্যেই আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় কারণ শেখ মুজিব নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ কখনও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হবে না। 

বহু পশ্চিমা দেশ বছর না যেতেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। অথচ সমাজতান্ত্রীক চীন এবং মুসলিম সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব নিহত হবার পর। ১৯৭৫ এর মুজিব হত্যার ঘটনা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মতই বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিপরীত মেরূর ঘটনা। এই ঘটনা আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তান মানসিকতার এক বাংলাদেশের পথে। সমাজ ও রাজনীতিতে এইসব বিশাল বিপর্যয়কর ঘটনা যাকে ইংরেজিতে বলে ক্যাটাস্ট্রোফিক ইভেন্ট, সেগুলো ঘটে অনেকগুলো নাজুক এবং পরিবর্তনশিল বিষয়ের খাদগুলো যখন কোন এক সময়ে পরস্পর মিলে যায়।

১৯৭৪ সালে এমনই অনেকগুলো নাজুক এবং পরিবর্তনশিল বিষয়ের খাদগুলো মিলে গিয়েছিল এবং তার মধ্যে আকস্মিক ও ট্রিগারিং বিষয় ছিল পিএল-৪৮০ এর অধীনে আমেরিকার খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করা যেটা বাংলাদেশের মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তার রক্ষাকবজ ছিল। এর পেছনের কারণ ছিল আমেরিকার স্যাংশন বা অবরোধ যার কারণ ছিল আমাদের নির্বুদ্ধিতা ও আমেরিকার আইন। সেই সময় বিভিন্ন নাজুক এবং পরিবর্তনশীল বিষয়গুলো ছিল:

১। দেশের প্রধান খাদ্যের জন্য বিদেশী সাহায্য নির্ভরতা: সারা দুনিয়ায় ঐ সময় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশ খাদ্য সাহায্য কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। ১৯৭২ থেকে খাদ্য আমদানীর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সংকট তৈরি হয়েছিল। খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশের চাল রপ্তানিতে তখন অপারগতা প্রকাশ করে। 

২। সরবরাহ চেইনে সমস্যা: ১৯৭২ থেকে রেশন ভিত্তিক সরকারি সরবরাহ চেইন সৃষ্টির ফলে স্বাভাবিক বা অরগ্যানিক সরবরাহ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি, লুটপাট ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি সরবরাহ চেইনে ভর্তুকি অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল ক্রমেই দেশে আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়া। 

১৯৭২ সালে অনেকটা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরী হয় কিন্তু ভারতের চাল সরবরাহ, আমেরিকার খাদ্য সাহায্য (পিএল-৪৮০) ও পশ্চিমা বিশ্বের নানা দেশের সহায়তার সাহায্যে সেটা কাটিয়ে ওঠা যায়। 

১৯৭৪ সালের শুরুর দিকেই আবার দুর্ভিক্ষের নিদর্শন দেখা গেলেও সরকার ও প্রশাসন খুব একটা পাত্তা দেয় না। তারা আশা করে থাকে আমেরিকার খাদ্য সাহায্য তো আছেই। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিই ১৯৭৪ সালের জন্য পিএল-৪৮০ এর অধীনে খাদ্য সাহায্যের আবেদন করা হয় ইউএসএআইডির কাছে।

ঐ সময় কমিউনিস্ট কিউবার সাথে আমেরিকার অত্যন্ত মন্দ সম্পর্ক ছিল এবং কিউবা শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত ছিল। ঐ সময় কিউবার সাথে বাংলাদেশ নির্বোধের মত কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এতে আমেরিকা নাখোশ হয়। তারা বাংলাদেশকে সতর্ক করে যে এর ফলে পিএল-৪৮০ দ্বারা সাহায্য ব্যাহত হতে পারে শত্রু রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের বিশেষ আইন থাকার কারণে। 

কিউবার সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে আমেরিকার কাছে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি করা ১৯৭৪ সালের জন্য খাদ্য সাহায্য আটকে যায়। ১৯৭৪ সালে যখন দুর্ভিক্ষের লক্ষণ দেখা দেয় তখন আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম বাড়তে থাকলে ভারতও চাল রপ্তানী বন্ধ করে দেয়। 

তখন বাংলাদেশ আবার আমেরিকার দ্বারে সাহায্যের জন্য ছোটে। আমেরিকা তখন বলে কিউবার সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কের কারণে পিএল-৪৮০ এর সাহায্য বন্ধ হলেও তোমরা শস্য কিনে নিতে পার এবং সেটাতে আইনগত সমস্যা নেই।

বাংলাদেশ তখন আমেরিকার কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে খাদ্য শস্য কেনার জন্য অর্ডার দেয়। কিন্তু অপর দিকে ঐ সময়ই আবার নির্বোধের মত বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাট রপ্তানির একটি চুক্তি করে বসে এবং সেটার প্রথম চালান রপ্তানিও করে ফেলে। এই রপ্তানি মার্কিন খাদ্য রপ্তানি আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সেই আইনে আছে শত্রু রাষ্ট্রে কোন কিছু রপ্তানি করলে সেই দেশে আমেরিকার খাদ্য বিক্রি বা রপ্তানিও নিষিদ্ধ। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ক্রয় করা শস্য দিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার সম্ভাবনা।

ঐ সময় প্রকৃতি দেয় শেষ চালটা। ঐ বছর বৃষ্টি হয় রেকর্ড পরিমাণ। তার ফলে ধানও জন্মে রেকর্ড পরিমাণ কিন্তু এর সাথে হয় মারাত্মক বন্যা। ভারতের রপ্তানি বন্ধ ও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার খবরে কৃষকেরা ভীত হয়ে ধান বিক্রয় না করে মজুদ করতে থাকে।

অসাধু ব্যবসায়ীরাও শুরু করে ধান কিনে মজুদ করা। এর ফলে চালের দাম বেড়ে যায় ৫ গুনেরও বেশী। যাদের ধানি জমি নাই, যারা দিনমজুর এবং যারা হতদরিদ্র তারা মারা যায় রাস্তাঘাটে বিশেষ করে বন্যাকবলিত উত্তর বাংলায়। অল্প সময়ে ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত সংক্রমণে মারা যায় লক্ষ মানুষ যদিও সরকারী হিসাবে সেটা মাত্র ২৭ হাজার। এই বিপর্যয়ে তখনকার বিশ্ব মহাশক্তি বাংলাদেশের নিকট বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছুই করে না। কিছুই করে না এত প্রেমের ইসলামি বিশ্বও। বহু মানুষ তখন খাদ্যের খোঁজে রাজধানী ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা শহরের রাস্তায় অনাহারে মৃত্যু হয় বহু মানুষের। 

তখন বাংলাদেশকে আমেরিকার আইন অনুযায়ী কিউবার কাছে রপ্তানী বন্ধ করে শুধু নয়, কিউবার সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন করতে হয় খাদ্য সাহায্য পেয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। পরে কিউবার সাথে আমেরিকার সম্পর্ক কিছুটা নরম হলে বাংলাদেশ কুটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।