২০১১ সালের ১১ই মার্চ ২টা ৪৬ মিনিটে যেন প্রলয় শুরু হয়েছিল জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। যাার শুরুটা ছিল প্রচণ্ড ভূমিকম্প যা রিখটার স্কেলে ছিল ৯ মাত্রার। সেই ভূমিকম্পের কারণে শুরু হলো সুনামি এবং সুনামির পানিতে তলিয়ে গেল ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্রটির বৈদ্যুতিক জেনারেটর। বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে পারমাণবিক চুল্লির শীতলীকরণ ব্যবস্থা গেল নষ্ট হয়ে। তামপাত্রা বেড়ে গলে গেল চুল্লির কোর এবং চারপাশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ল যাকে বলা হয় পারমিণবিক চুল্লির মেল্টডাউন।
ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্রটির পারমাণবিক চুল্লি ছিদ্র হয়ে চারপাশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে সারা দুনিয়াতে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে নেতিবাজক আলোচনা শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে জার্মানী সহ নানা ইউরোপীয় দেশে পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করে দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয় যেগুলো ইউরোপের ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যত জ্বালানী চাহিদা, জালানীর সঙ্কট, এবং ইউরোপের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার চিন্তা না করেই নেওয়া হতে থাকে।
পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং রাজনীতি সচেতন হবার ফলে এইসব সিদ্ধান্তকে আধুনিক দুনিয়ার জন্য আত্মঘাতী বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। সেই সময় আমার অনেক ইউরোপীয় ও আমেরিকান বন্ধুদের সাথে এসব নিয়ে তর্ক বিতর্ক শুরু হয় এবং অনেকে আমার সাথে অসৌজন্যমূলক ব্যবহারও করেন।
আমার সবসময় মনে হত বর্তমানের উন্নত দেশগুলো পারমাণবিক প্রযুক্তি থেকে বের হয়ে গেলে এর উন্নয়ন থেমে যাবে। এটি মোটেই ভাল খবর নয়। আমি পারমাণবিক চুল্লি বিশেষজ্ঞ নই তবুও আমার মনে হত ছোট ছোট মাইক্রো চুল্লি যদি বানানো যায় যেগুলো কম ক্ষমতায় তাহলে চুল্লির বিগলণ বা মেল্টডাউন নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে। তখন পারমাণবিক চুল্লি হবে নিরাপদ।
সম্প্রতি চীন একপ্রকার নতুন পারমাণবিক চুল্লি উদ্বোধন করেছে যেটা উচ্চ তাপ সহনীয় ছোট ছোট মাইক্রো সেল বা পেবলে তৈরি যেটার কখনও মেল্টডাউন হবে না। একে বলা হচ্ছে এইচটিআর-পিএম রিঅ্যাক্টর।
এইচটিআর-পিএম (হাই টেম্পারেচার গ্যাস-কুলড রিঅ্যাক্টর পেবল-বেড মডিউল) হলো চীনের উন্নত প্রযুক্তির একটি ছোট মডুলার পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর। এটি একটি চতুর্থ প্রজন্মের (জেনারেশন IV) রিঅ্যাক্টর, যা শিদাওওয়ানে অবস্থিত, শানডং প্রদেশে। এই রিঅ্যাক্টরটি হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে ঠান্ডা করা হয় এবং গ্রাফাইট মডারেটর হিসেবে ব্যবহার করে। এটি প্রায় ৪,০০,০০০টি ছোট গোলাকার জ্বালানি পেবল (প্রতিটি ৬০ মিমি ব্যাসের) দিয়ে চালিত হয়, যেগুলোতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ জ্বালানি থাকে। প্রতিটি রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা ২৫০ মেগাওয়াট তাপীয় (MWt), এবং দুটি রিঅ্যাক্টর একটি ২১০ মেগাওয়াট বৈদ্যুতিক (MWe) টারবাইন চালায়।
এইচটিআর-পিএম রিঅ্যাক্টর প্রচলিত হালকা পানির রিঅ্যাক্টরের (LWR) তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ কারণ এর আছে স্বাভাবিক নিরাপত্তা বা ইনহেরেন্ট সেফটি। পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ব্যপক তেজষ্ক্রীয়তা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে যে কোন যান্ত্রিক, মানবিক বা প্রাকৃতিক কারনে যদি নিউক্লিয়ার চুল্লির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। যেমন চেরনোবিলের মত পরিচালনার ত্রুটি, বা ফুকুশিমার মত সুনামি তাহলে চুল্লি ঠান্ডা করার যে কারিগরি পদ্ধতি সেটি অকার্যকর হয়ে যায়। যার ফলে চুল্লি কোরের তাপমাত্রা বেড়ে মেল্টডাউন বা চুল্লির গলন হয়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু নতুন এই রিঅ্যাক্টরটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, যান্ত্রিক গোলযোগ বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেও এটি স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হয়ে যায়। এর জ্বালানি পেবলগুলো কোন যন্ত্রপাতি ছাড়া তাপকে ছড়িয়ে দেয় এবং প্রাকৃতিক সঞ্চালনের মাধ্যমে তাপ নির্গমন করে, যার ফলে কোনো সক্রিয় শীতলীকরণ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না যা মেল্টডাউনের ঝুঁকি দূর করে।
এর জ্বালানি পেবলগুলো ১৬২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে, যা প্রচলিত রিঅ্যাক্টরের তুলনায় অনেক বেশি। এই রিঅ্যাক্টর আকারে ছোট। এর শক্তির ঘনত্ব প্রায় ৩.২ মেগাওয়াট/ঘন মিটার, যা প্রচলিত চাপযুক্ত পানির রিঅ্যাক্টরের (PWR) তুলনায় প্রায় ৩০ গুণ কম। এর ফলে তাপ অপসারণ সহজ হয় এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে যায়।
এতে আছে হিলিয়াম শীতলকরণ ব্যবস্থা। শীতলকরণ প্রবাহী হিসাবে এখানে পানির পরিবর্তে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যা উচ্চ তাপমাত্রায়ও স্থিতিশীল। এটি রাসায়নিক বিক্রিয়া বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি কমায়, যা পানি-ভিত্তিক রিঅ্যাক্টরে একটি বড় সমস্যা।
এর ছোট আকার এবং মডুলার গঠন এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ করে। প্রচলিত বড় রিঅ্যাক্টরের তুলনায় এটি দ্রুত নির্মাণ ও পরিবহনযোগ্য।
২০২৩ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে চীনের শিদাওওয়ানে দুটি নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হয়। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেখা যায় যে, কোনো মানুষের হস্তক্ষেপ বা জরুরি শীতলীকরণ ব্যবস্থা ছাড়াই রিঅ্যাক্টর নিজে থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়। এটি বাণিজ্যিক স্কেলে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রমাণ করে।
চীনের এইচটিআর-পিএম রিঅ্যাক্টর সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর চীনের জাতীয় শক্তি প্রশাসন ঘোষণা করে যে, শিদাওওয়ানে অবস্থিত এইচটিআর-পিএম ডেমো প্ল্যান্ট বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে। ১৬৮ ঘণ্টার সফল ট্রায়াল রানের পর এটি গ্রিডে যুক্ত হয়। এটি বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক মডুলার উচ্চ-তাপমাত্রার গ্যাস-কুলড রিঅ্যাক্টর হিসেবে স্বীকৃত।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে Joule জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে দুটি পরীক্ষায় এই রিঅ্যাক্টর তার স্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রমাণ করেছে। এটি প্রথম বাণিজ্যিক-স্কেল রিঅ্যাক্টর যিনি এমন ক্ষমতা দেখিয়েছে, যা পারমাণবিক শক্তির ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪ সালের এপ্রিলে শিদাওওয়ানে এইচটিআর-পিএম থেকে তাপ সরবরাহ প্রকল্প চালু হয়। এটি পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে উচ্চ-তাপমাত্রার বাষ্প (৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, যা কয়লা-ভিত্তিক শক্তির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। এটি চীনের কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্যে (২০৬০) একটি বড় পদক্ষেপ।
চীন এইচটিআর-পিএম৬০০ নামে একটি বৃহত্তর সংস্করণ পরিকল্পনা করছে, যেখানে ছয়টি রিঅ্যাক্টর মডিউল একটি ৬৫০ মেগাওয়াট টারবাইন চালাবে। এটি শিল্পায়ন ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
সম্প্রতি তারা পারমাণবিক কার্গো জাহাজ তৈরির পরকল্পনা চুড়ান্ত করেছে।
কিভাবে ওয়োক কালচার এবং পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের জনতুষ্টির রাজনীতি ইউরোপের মত মহাদেশের প্রযুক্তি ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে এটি তার একটি উদাহরণ।