ধরুন আপনি ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি পাখি আর একটি পাখির উপরে উঠে প্রেম ভালবাসা করছে। বিষয়টি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই এটি আপনার মনে কোন ছাপ ফেলল না। আপনি আপন মনে হেঁটে প্রকৃতি দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলেন। কিছু দুর পর দেখলেন ঝোপের আড়ালে এক জোড়া তরুণ তরুণী দৈহিক প্রেম ভালবাসায় মত্ত। এটা দেখে আপনি বিরক্ত হলেন। আপনি রেগেও গেলেন। যতক্ষণ না ঐ জুটিকে শায়েস্তা করা যায় বা গার্ডেন থেকে বের করে দেওয়া না যায় আপনার মনে স্বস্তি নেই। পাখি ও মানুষ উভয়ের ঘটনাই প্রাকৃতিক। প্রথমটা এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে পারছেন না কেন? আপনার মনে এত ক্ষোভ আর রাগ কেন? আপনি যদি মনে করেন যে নৈতিকতার স্খলনের জন্য বা আইন ভাঙ্গার জন্য আপনার রাগ হচ্ছে, সেটিও ঠিক নয় কারণ আপনি দেখেছেন গেটে টিকেট না দিয়ে ঘুষ নিয়ে গার্ডেনে লোক ঢুকানো হচ্ছে, সেটাতে আপনার রাগ হয়নি।
এই রাগের কারণ হল মাটি বা জমির প্রতি আপনার মস্তিস্কের গভীরে সংযুক্তি বা এটাচমেন্ট। প্রেম ভালবাসায় মত্ত উক্ত তরুণীর যদি সন্তান হয় সেই সন্তান উক্ত তরুণীর স্বামীর মৃত্যুর পর তার জমির অংশ পেয়ে যেতে পারে। এই সংস্কৃতি সমাজে চালু হয়ে গেলে আপনার নিজের ঔরসজাত সন্তানরা আপনার মৃত্যুর পর বঞ্চিত হতে পারে এটাই আপনার ভয় এবং এই ভয় থেকেই আপনি রাগান্বিত হচ্ছেন। এখানে নৈতিকতা, সভ্যতা, আইনসিদ্ধতা বা ধর্মীয় যুক্তি দেখানো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত। কারণ আরো নানা অনৈতিক ও আইনবিরোধী বিষয় আপনাকে রাগান্বিত করে না।
আধুনিক ধর্মগুলোর উদ্ভব হয়েছে বা প্রাচীন ধর্মগুলো আধুনিকতায় বিবর্তিত হয়েছে কৃষি সভ্যতার শুরুর দিকে। বেহেশতে ব্যক্তিগত জমি নেই তাই সেখানে নারী পুরুষের পোশাক পরার কোন প্রয়োজন হয় না। যখনই আদম হাওয়া বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়ে দুনিয়াতে এল, তখনই যৌনতা ট্যাব্যু বা গুরুত্বপূর্ণ লজ্জা হয়ে গেল, পোশাক বাধ্যতামূলক হল। যার কারণ হল তখন থেকে নিজস্ব জমি চাষ করে ফলানো ফসল বেঁচে থাকা বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় হয়ে গেল। জমি আমাদের হাত পা বা দেহের অংশ বা সন্তানের মত হয়ে গেল। সেটার নিরাপত্তাহানী হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আমাদের রাগিয়ে তোলে। বর্তমানের কারখানাভিত্তিক শিল্প সভ্যতায় জমি গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রম দিলে বা কাজ জানলে আপনি বেঁচে থাকবেন জমি থাক বা না থাক। সেই কারণে কৃষি সভ্যতা থেকে কারখানাভিত্তিক শিল্প সভ্যতায় পরিবর্তনের সাথে সাথে যৌন ট্যাব্যু উঠে যাচ্ছে এবং সেটা পুরোপুরি শিল্পায়ন হলে একেবারেই উঠে যাবে। অর্থনীতি নির্ণয় করে মানুষ কি পরবে বা সমাজ কেমন হবে। অর্থনীতি এবং মনোবিদ্যা বা আচরণ বিজ্ঞানের সংযোগকারী এক পন্ডিত ড্যানিয়েল কাহনেম্যান চলে গেলেন আজকের দিনে এক বছর আগে।
ড্যানিয়েল কাহনেম্যান ছিলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত মনোবিদ এবং অর্থনীতিবিদ, যিনি আচরণগত অর্থনীতির (Behavioral Economics) বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৩৪ সালের ৫ মার্চ ইসরায়েলের তেল আবিবে জন্মগ্রহণ করেন। কাহনেম্যানের কাজ মূলত মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে গবেষণার উপর কেন্দ্রীভূত ছিল। তিনি প্রথাগত অর্থনীতির ধারণা, যেখানে মানুষকে সম্পূর্ণ যুক্তি থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেন। তার অবদানের জন্য ২০০২ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন।
কাহনেম্যান তার সহযোগী আমোস ভারস্কির সঙ্গে মিলে আচরণগত অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। তাদের গবেষণা প্রমাণ করে যে, বাইরে থেকে মনে হলেও মানুষ সবসময় যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় না; বরং তাদের সিদ্ধান্ত প্রায়ই পক্ষপাতিত্ব (bias), আবেগ এবং অযৌক্তিক প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। কাহনেম্যান-ভারস্কির কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানগুলো হলো:
১। প্রসপেক্ট থিওরি:
কাহনেম্যান এবং ভারস্কি ১৯৭৯ সালে "প্রসপেক্ট থিওরি" প্রকাশ করেন, যা ঝুঁকির মধ্যে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার একটি যুগান্তকারী ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই তত্ত্ব অনুসারে:
ক। মানুষ লাভের তুলনায় ক্ষতির প্রতি বেশি সংবেদনশীল (Loss Aversion)। অর্থাৎ, ১০০ টাকা হারানোর কষ্ট ১০০ টাকা পাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি তীব্র।
খ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষ প্রায়ই সম্ভাবনার (probability) পরিবর্তে ফলাফলের প্রতি গুরুত্ব দেয় এবং ঝুঁকি নিয়ে অযৌক্তিক আচরণ করে। এই তত্ত্ব প্রথাগত "ইউটিলিটি থিওরি" (Utility Theory)-কে প্রতিস্থাপন করে, যেখানে ধরা হতো মানুষ সবসময় তাদের স্বার্থ সর্বাধিক করার জন্য যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়।
২। হিউরিস্টিকস এবং বায়াস (Heuristics and Biases)
কাহনেম্যান দেখান যে, মানুষ জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সহজে বোধগম্য নিয়ম বা "হিউরিস্টিকস" ব্যবহার করে। যেমন:
ক। অ্যাঙ্করিং (Anchoring): আগে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া।
খ। অ্যাভেলেবিলিটি হিউরিস্টিক (Availability Heuristic): সাম্প্রতিক বা সহজে মনে পড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাবনা বিচার করা। এই প্রক্রিয়াগুলো মানুষের বিচারে পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি করে, যা ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে।
৩। দুই সিস্টেমের চিন্তা (Dual-System Thinking)
কাহনেম্যান তার বই Thinking, Fast and Slow (২০১১)-এ মানুষের চিন্তার দুটি পদ্ধতির কথা বলেন:
ক। সিস্টেম ১: দ্রুত, স্বজ্ঞাত এবং আবেগভিত্তিক চিন্তা।
খ। সিস্টেম ২: ধীর, বিশ্লেষণাত্মক এবং যৌক্তিক চিন্তা। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, আমরা প্রায়ই সিস্টেম ১-এর ওপর নির্ভর করি, যা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, কিন্তু ভুলের সম্ভাবনাও বাড়ায়।
কাহনেম্যান হিব্রু ইউনিভার্সিটি থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। আমোস ভারস্কির সঙ্গে তার সংযুক্তি অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল, যদিও ভারস্কি ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করায় নোবেল পুরস্কারে তিনি অংশীদার হতে পারেননি।
কাহনেম্যান ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ড্যানিয়েল কাহনেম্যান এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি মানুষের মনের গভীরতা এবং অর্থনীতির বাস্তবতাকে একসঙ্গে যুক্ত করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তার কাজ আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
বর্তমানের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক মাধ্যমের বায়াস এবং মানুষের সরল চিন্তা থেকে জনপ্রিয় বা পপুলিস্টিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সমর্পণ বুঝতে গেলে কাহনেম্যান-ভারস্কির কাজগুলো অনেক সহায়ক হতে পারে।