EN
আরও পড়ুন
ধর্ম ও দর্শন
রাজনীতি
মনে শুধু ঘৃণা আর আত্ম ঘৃণার প্রতিফলনে:
মানসিক সমৃদ্ধি ও সম্পর্ক
রাজনীতি
পলিটিক্যাল সিস্টেমস থিংকিং এর শিক্ষা
JadeWits Technologies Limited
রাজনীতি

পিতৃহন্তা মাতৃকামী

ইডিপাস রেক্সদের বাংলাদেশ

অভিশাপটা কিসের থেকে লাগল এই জাতীর, এই দেশের? বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে ছিল কৃষক, ছিল মাঝি, ছিল জেলে। প্রকৃতির সম্পদ আহরণই ছিল তাদের কাজ। প্রকৃতির আছে অফুরন্ত সম্ভার তাই বুদ্ধিতে কমা হলেও মানসিকতায় ছিল তারা উদার কিন্তু নীতিতে অটল। আচরণে তারা ছিল অতিথিপরায়ণ। আত্মীয়, অনাত্মীয় মেহমান আসলে, এমনকি মেহমান অচেনা পথিক হলেও পুকুরের বড় একটা মাছ ধরে, ঘরের পালা সবচেয়ে বড় মোরগটি দিয়ে তার আপ্যায়ন করে আন্তরিকভাবে খুশি হত কারণ বিশ্বাস ছিল অতিথি লক্ষী। অতিথিও করত প্রাণ ভরে আশীর্বাদ। হত কৃতজ্ঞ। 

সেই কৃষক, মাঝি, জেলে বাঙালী বই মুখস্ত করা শিখল, ব্যবসা শিখল। ব্যবসায়ী হল, বই মুখস্ত করা শিক্ষিতরা ব্যবসায়ীদের ম্যানেজার হল। ব্যবসার ভিত্তি হল অবিশ্বাস, কৃপণতা আর স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্র মন ছাড়া ব্যবসায় উন্নতি করা অসম্ভব। এতদিন ব্যবসায়ীরা ছিল নীচ জাত। জাতে ওঠার জন্য তারা টাকা বিলাত। দান খয়রাত, জনসেবা সবই করত। তবুও নীতি, আদর্শ মুল্যবোধ রচনায় বা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের থোড়াই পাত্তা দেওয়া হত। জাতে ওঠার জন্য রবার্ট ক্লাইভ ভারতবর্ষকে নিঃস্ব করে ইংল্যান্ডে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তবুও তাকে বৃটেনের শাসক গোষ্ঠীর জাতে স্থান দেওয়া হয়নি। 

তার পর এই বঙ্গরাজ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী তৈরি হল। নিজেরা নিজেদের কর্পোরেট রাজত্বের এক একজন রাজা মহারাজা হয়ে উঠলন। তাদের হাতে জমল অফুরন্ত টাকা। রাষ্ট্র চালান যারা তারাও তাদের কৃপা পদধুলি গ্রহণে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। সমাজকর্মী, ধর্মীয় গুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যগণও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কৃপা প্রার্থী। পত্রিকা, মিডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়ে উঠলেন তারা। অবিশ্বাস, কৃপণতা স্বার্থপরতা আর ক্ষুদ্র মনের অধিকারিরা হয়ে উঠলেন সবার পূজনীয়। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারক। তৈরী হল অর্থ ইশ্বর – ন্যায় বিচার আর সততা নির্বাসিত। 

ব্যবসায়ীরা যে অতিথেয়তা করে না তা নয়, মহা ধুমধাম ও আড়ম্বরের সাথে করে পাঁতারা হোটেলেও বা নিজগৃহে, তবে সেগুলো শুধুই নিজ স্বার্থে – নিজেদের বর্তমান অথবা আসন্ন উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে। এই বেনিয়া সমাজ এত কর্মঠ, মেধাবী, মহান – তারা সব পারে, কিন্তু নিঃস্বার্থে একজন অতিথিকে এক বেলা খাওয়াতে পারে না। আর পারে না নিঃস্বার্থে তার জন্য কিছু করলে তাকে সরলভাবে গ্রহণ করতে। উল্টো সে সুযোগ গ্রহণ করে, যে তাকে উদারতা দেখাচ্ছে তাকে সপরিবারে বলৎকার করাই এদের ধর্ম।

তবুও এই নয়া কর্পোরেট বেনিয়া সমাজে ব্যবসায়ীরা যেন জাতে উঠতে পারল না। এর প্রধান কারণ হল একে অপরের পশ্চাৎদেশে সর্বক্ষণ অঙ্গুলি স্থাপন। নিজেরা জাতে উঠতে না পেরে এই অঙ্গুলি স্থাপন প্রতিযোগিতায় তারা পরবর্তী সম্মিলিত নিশানা করে রাজনীতিবীদদের। পত্রিকা বা মিডিয়ার নামে তারা বিকারগ্রস্থ নিকৃষ্টতম মানুষদের নিয়োগ করে পশ্চাৎদেশে সর্বক্ষণ অঙ্গুলি স্থাপন চর্চা করার জন্য। তাদের এই পশ্চাৎদেশে অঙ্গুলি স্থাপন চর্চা কেন্দ্রে তারা একটি দলকে তোয়াজ করে চলে যাদের সম্পর্কে তারা প্রশংসা ছাড়া কিছুর চর্চা করে না। যে দলটি এই দেশের শুরু থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে। শয়তানের উপাসকদের এই দলটি হচ্ছে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বেতনভুক কর্মচারীদের দল। পশ্চাৎদেশে অঙ্গুলি স্থাপন চর্চা কেন্দ্র মনে করে এরাই জাতিকে রক্ষা করবে। অথচ এরাই এদেশের পিতৃহন্তা মাতৃকামী।   

এলিস নগরীর রাজা পেলপস থিবস নগরীর রাজা লাইয়াসকে তার তারুণ্যের কালে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার প্রাসাদে। একটি চ্যারিয়ট (ঘোড়া টানা গাড়ি) রেসে একা পেয়ে পেলপসের শিশুপুত্রকে ধর্ষণ করে পিতার অতিথি হিসাবে আসা লাইয়াস। আতিথেয়তার এই অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ রাজা পেলপস অভিশাপ দিলেন রাজা লাইয়াসকে – অভিশাপটি হল তার থিবস নগরী ধ্বংস হবে। 

অনেক পরে রাজা লাইয়াসের যখন একটি শিশুপুত্র জন্ম নিল তখন রাজা রাজ পুরোহিতকে ডেকে ভয়ের সাথে জানতে চাইলেন তার ভবিষ্যত। পুরোহিত ভবিষ্যত বলল “তার পুত্রই তাকে হত্যা করবে”। লাইয়াস তার শিশুপুত্রের দুটি পা একসাথে বেঁধে তার স্ত্রী জোকাস্তাকে বললেন শিশুটিকে হত্যা করতে। জোকাস্তা নিজের সন্তানকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে তার ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেন শিশুটিকে হত্যা করতে। ভৃত্যও সেটা করতে ব্যর্থ হয়ে এক পাহাড়ের চুড়ায় শিশুটাকে রেখে এল। 

নিকটস্থ করিন্থ রাজ্যের এক মেষপালক মেষ চরাতে গিয়ে শিশুটিকে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে এল এবং তার নাম দিল ইডিপাস, যার অর্থ ফোলা পা – যেহেতু বাঁধা থাকার ফলে পা দুটো ফুলে গিয়েছিল। করিন্থ রাজ্যের দরিদ্র মেষপালক শিশুটির ভার না নিতে পেরে করিন্থের নিঃসন্তান রাজা পলিবাসের কাছে শিশুটিকে উপহার হিসাবে দিয়ে দিল।

রাজা পলিবাসের প্রাসাদে বড় হয়ে যখন ইডিপাস পরিপূর্ণ যুবক, তখন সে নগরবাসীর কানাঘুষা শুনতে পেল যে সে পলিবাস ও তার স্ত্রী মেরপসের জন্ম দেওয়া পুত্র নয়। তখন সে নগরীর উচ্চ পুরোহিতের কাছে গিয়ে জানতে চাইল তার প্রকৃত পিতামাতা কারা। পুরোহিত তার জবাব না দিয়ে বলল তার নিয়তি হল “সে তার পিতাকে হত্যা করবে ও করবে তার মাতার সাথে সঙ্গম”। 

এই ভয়ংকর ভবিষ্যতবাণী শুনে সে করিন্থ রাজ্য ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল কারন তখনও সে বিশ্বাস করে পলিবাস ও তার স্ত্রী মেরপসই তার বাবা মা।

করিন্থ ত্যাগ করে ইডিপাস যখন নিকটবর্তী থিবস রাজ্যের পথে অগ্রসরসান, তখন সে দেখল দুটি চ্যারিয়ট একটিতে এক সম্ভ্রান্ত বয়ষ্ক ব্যক্তি আর একটিতে এক তরুণ ভৃত্য স্থানীয় দুজনেই উত্তেজিত হয়ে একে অপরকে পথ ছেড়ে দিতে বলছে। তরুণটি উদ্ধত আচরণ করলে বয়ষ্ক ব্যক্তিটি তার রাজদন্ড দিয়ে তরুণটিকে প্রহারে উদ্যত হলে ইডিপাস বয়ষ্ক ব্যক্তিটিকে চ্যারিয়ট থেকে ফেলে দেয় ও তাকে হত্যা করে। এই বয়ষ্ক ব্যক্তিই ছিল থিবসের রাজা লাইয়াস – ইডিপাসের জন্মদাতা পিতা।

এর পর থিবস নগরীতে ঢোকার পথেই সে দেখে বিশাল শক্তিশালী স্ফিংস যার শরীরের উপরের অর্ধেক নারীর, নিচের অর্ধেক সিংহের ও পাখা বিশাল ঈগলের সে রাস্তায় চলাচলরত পথিকদের থামিয়ে বিভিন্ন ধাঁধা জিজ্ঞাসা করছে ও উত্তর ভুল হলে তাকে আস্ত গিলে ফেলছে। ইডিপাসকে ধরে সে প্রশ্ন করল “কোন প্রাণী সকালে চতুষ্পদ থাকে, দুপুরে হাটে দুই পায় ও সন্ধ্যায় তিন পেয়ে হয়”? প্রখর বুদ্ধির ইডিপাস জবাব দেয় “মানুষ – যে শিশুকালে হাঁটে চার হাত পায়ে, বড় হলে দু পায়ে ও বৃদ্ধ হলে লাঠি সহ তিন পায়ে”। জবাব সঠিক হওয়াতে স্ফিংস তাকে ছেড়ে দেয় ও সে শাপমুক্ত হয়ে থিবস নগরী ছেড়ে চলে যায়।

আগেই ঘোষিত ছিল স্ফিংসের অত্যাচার থেকে যে থিবস নগরীকে রক্ষা করতে পারবে সেই হবে থিবসের পরবর্তি রাজা। ইডিপাসের প্রচন্ড বুদ্ধিবলে স্ফিংসের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয় বলে থিবসবাসী ইডিপাসকেই নতুন রাজা হবার জন্য দাবী করে। এতে রাজী হয় ইডিপাস ও সদ্য বিধবা রাণী জোকাস্তাকে মনে ধরে তার প্রনয়ী হিসাবে যে আসলে তার জন্মদাত্রী মা।

পাপের উপরে পাপে নিমগ্ন হবার ফলে আরও অভিশাপ নেমে আসে থিবস নগরীর উপরে। মহামারীতে মরতে শুরু করে শত শত মানুষ। উপায়ন্তর না দেখে আবার উচ্চ পুরোহিতের কাছে লোক পাঠিয়ে জানতে চাইল ইডিপাস যে মহামারীর এই অভিশাপ কেন ও এই অভিশাপ থেকে মুক্তি কিসে? পুরোহিত বলল “থিবসের রাজাকে হত্যা করেছে এক মাতৃকামী, সেই এই অভিশাপের কারণ। তাকে বিচারের সন্মুখে আনতে পারলেই এর থেকে মুক্তি”। সিংহাসনে বসে রাজার হত্যাকারীকে খুঁজে আনার নির্দেশ দিয়ে তার চরম সাজা ঘোষণা করল ইডিপাস। সে জানে না নিজেকেই খুঁজছে সে। সে নিজেই সব কিছুর জন্য দায়ী। 

প্রথা, আদর্শ, জ্ঞান আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিগত ভোগ, লোভ, উন্নতি, বুদ্ধি আর চতুরতা নির্ভর জীবনবোধ যাদের তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে কি হয় ২৪৫০ বছর আগে সফোক্লিস সেটা লিখে গেছেন তার নাটক ইডিপাস রেক্সের মধ্যে যা একটি প্রচলিত গ্রীক পুরাকাহিনী। 

অনেক অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। তারপর ক্ষমতায়িত হয়েছে সেই চতুর শিক্ষিত শ্রেণী আর ব্যবসায়ী সমাজ যাদের বেঁচে থাকার ভিত্তি হল অবিশ্বাস, কৃপণতা, স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্র মন। এরা মেজবানের আতিথেয়তাকে সন্দেহ করে তার সর্বনাশের চিন্তা সবসময় করে এসেছে। জনগনই ব্যবসায় লাভের ভিত্তি আর তাদেরই পকেট কেটে এরা বড় হয়। 

বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বেতনভুক কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ক্ষোভে জাতীর পিতাকে হত্যা করেছে আর সেই রাষ্ট্রের সশস্ত্র বেতনভুক কর্মচারী আর ব্যবসায়ীরা মিলেই এখন ধর্ষন করে চলেছে দেশমাতৃকাকে। এ যেন থিবসের সেই পুরাকাহিনীর পুনরাবৃত্তি এই বাংলায় যার পরিণাম সামগ্রিক বিপর্যয় ও ধ্বংস।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।