বিখ্যাত বা লিজেন্ডারি কোন অভিনেতা বা ফুটবলার মারা গেলে সারা পৃথিবী শোকগ্রস্থ হয়ে ওঠে যেন এক বীর নায়ককে হারিয়েছে। যে কোন মানুষের মৃত্যুই বেদনার। বিশেষ করে তার নিকটজন এবং পরিবারের জন্য। কিন্তু একজন অভিনেতা বা ফুটবলার কি আমাদের কাছে তেমন? বীর তো তারাই যারা নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমগ্রর জীবনের সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখায়। অন্যের জন্য যারা জীবন দান করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন করছেন নিভৃতে অনেকেই, তাঁরাই প্রকৃত বীর, তারাই নায়ক। তাঁদের মৃত্যুর খবরটুকুও কি আমরা রাখি? কেন রাখি না? কারণ দূর দুনিয়ার চকচকে ঝকঝকে ছায়া নায়কেরা আমাদের সেই আবেগের স্থানটুকু দখল করে রেখেছে।
পেশা মানুষের মস্তিষ্কের ভৌত গঠন পরিবর্তন করে ফেলে। মস্তিষ্কের নিউরোনগুলোর সংখ্যা এবং সেগুলোর আন্তঃসংযোগ কেমন হবে, মস্তিষ্কের কোন অংশগুলোর সাথে সংযোগগুলো হবে এবং কত দৃঢ় হয়ে সেগুলো নিউরাল পাথওয়েজ তৈরী করবে যার ফলে মানুষের চিন্তা একটি নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হবে সেটা যতটা পেশার উপর নির্ভর করে, ততটা অন্য কিছুর উপর নয়। সবসময়ই পেশাদার গাড়িচালকদের দেখেছি যে তাদের অনেক চিন্তা ভাবনা একটা ছাঁচে ফেলা যেন, টিপিক্যাল। যে সকল পেশায় দীর্ঘ মানসিক চাপ নিতে হয়, সেসকল পেশায় মস্তিষ্কের ভৌত গঠনের এই পরিবর্তন বেশী। সম্প্রতি চীন দেশে এফএমআরআই (ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং – যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের অংশবিশেষের প্রতিক্রিয়ার স্পেশিয়াল তথ্য পাওয়া যায়) ব্যবহার করে বিমানচালকদের উপর একটি গবেষণায় এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে পেশাগত চাপের ফলে তাদের মস্তিষ্কে ভৌত পরিবর্তন ঘটে। সার্জনদের খুবই মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের নিয়ে গবেষণাও তাই বলে।
কোন বিশেষ কারণে আমার সাংবাদিক বন্ধুর সংখ্যা অনেক। হয়ত নানা বিষয় নিয়ে আমি চিন্তা ভাবনা, লেখালেখি করি, সেটা তাঁদের আগ্রহী করে। একদিকে যেমন বন্ধুত্ব, অপর দিকে তাদের সাথে বিরোধও সবসময় লেগে থাকে। আমি যেমন অনেক বিষয়কে দীর্ঘ কালের, বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে বিচার করতে চাই, কিছু সাংবাদিক সেটা অনেক সময় মনে ধারণ করতে ব্যর্থ হন। সেই কারণে সাংবাদিকদের সাথে ঝগড়াও অনেক। সাম্প্রতিকতার অতি মূল্যায়নের কারণে তাদের সাথে গভীর দার্শনিক সংযোগ খুবই দুরুহ।
পেশাদার সাংবাদিকেরা সাম্প্রতিক চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে যান। সাংবাদিকতা পেশাতেও প্রতিদিনের মানসিক চাপ নিতে হয়। প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটে, অল্প সময় সেগুলো থেকে প্রকৃত সত্য নির্ণয় সহজ নয়। সেগুলো থেকে দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টকে নিষ্কাশিত করে প্রচন্ড চাপের মধ্যে তাঁদের খবর পরিবেশন করতে হয়। এই স্বল্প সময় ব্যাপ্তির - যা আগে চব্বিশ ঘন্টার ছিল অনলাইন যুগে এখন সেটা এক ঘন্টায় পরিণত হয়েছে – তাঁরা আর ঘটনাক্রমকে দীর্ঘ সময়-কারণের সূত্রে বাঁধতে পারেন না। পেশাগত কারণে তাঁদেরও মস্তিষ্কের ভৌত গঠন পরিবর্তিত হয়ে যায় তাই এই সমস্যা। এই কারণেই জর্জ বার্নার্ড’শ বলেছিলেন “একজন সাংবাদিক এমন একজন ব্যক্তি যে একটি সাইকেল দুর্ঘটনা আর একটি সভ্যতার বিলুপ্তি – এ দুটি ঘটনার মধ্যে পার্থক্য বুঝেতে পারে না”। আমেরিকান লেখক গোর ভিদাল তাই বলেছেন “একজন লেখককে অবশ্যই সত্য তুলে ধরতে হবে, যদি সে সাংবাদিক না হয়”।
এই বিষয়টি প্রাচীন অর্থাৎ বেদিক ভারতীয় পন্ডিতরা জানতেন সেই চার হাজার বছর আগেই। এই কারণে তাঁরা মানুষকে পেশাভিত্তিক চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র অর্থাৎ এই চারটি কর্ম সংস্কৃতির বিভাজন ছিল যেখানে এক জনের কাজ. একজনের চিন্তা আর একজনকে দিয়ে হবে না বলেই তারা ঠিক করেছিলেন। যেখানে ব্রাহ্মণের কাজ ছিল ধর্মগুরু বা শিক্ষকের, ক্ষত্রিয়রা ছিল যোদ্ধা বা শাসনকর্তা, বৈশ্যরা ছিল কৃষিবীদ বা ব্যবসায়ী এবং শূদ্র হলো যারা কায়িক শ্রম দিয়ে থাকে। বেদ উপনিষদে বা রামায়ন মহাভারতেও সমাজ পরিচালনায় পেশাগত বিভাজন থাকলেও জন্মভিত্তিক কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণপ্রথা ছিল না, ছিল পেশা সংস্কৃতির বিভাজন। জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার প্রচলন হয়েছিল হিন্দু পুরোহিতেরা যখন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা হিন্দুত্বের বিলোপের ভয়ে ভীত এবং নিজেদের পেশা হারানোর শঙ্কায় তখন। সেটা ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হয়েছিল যখন তারা রাষ্ট্রিয় আইনের অনুকরণে মনুসংহিতা নামে ধর্মীয় আইনের একটি গ্রন্থ রচনা করে, সেই থেকে।
পেশাভিত্তিক এই মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন ও তার ফলে কগনিটিভ বা চিন্তাগত পরিবর্তন বা চারিত্রিক পরিবর্তন আমরা ইসলাম-খ্রিস্ট-ইহুদি তথা ইব্রাহিমের মিথগুলোর মধ্যেও দেখতে পাই। ইব্রাহিমিয় মিথের প্রথম মানুষ অ্যাডামের দুই পুত্র আবেল ও কেইন যাদের মধ্যে কেইন চাষবাদ করত এবং অ্যাবেলের কাজ ছিল পশুপালন। কেইন খুন করেছিল তার ভাই আবেলকে শুধু তাই নয়, অ্যাবেলের মৃত্য নিয়ে খোদ ঈশ্বরের কাছেই মিথ্যা বলেছিল কেইন। কৃষি সভ্যতা শুরুর যে সময়ে এই মিথ রচিত, তখন পশুচারণ ও কৃষিকাজ – এই দুই পেশার সহাবস্থান ছিল। পেশার সাথে তাদের চারিত্রিক প্রভেদ তাই স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে ইব্রাহিমিয় মিথগুলোতে যেখানে কৃষিজীবি হলো হন্তারক, মিথ্যাবাদী ও ঈর্ষান্বিত চরিত্রের।
আমাদের পেশা এবং সেটার প্রতি আমাদের একাগ্রতা আমাদের মস্তিস্ককে খর্ব করে দিতে পারে। সেই কারণে এর বিপক্ষে প্রত্যেকের কাজ করা উচিৎ। আর সেটা হল ছুটির দিনগুলোতে, অবসরে নেশা (শখ) আর খেলাধুলায় নিজেদের নিয়োজিত রাখা। এর ফলে মস্তিষ্কের অকার্যকারী অংশগুলোর যেমন কার্যকারিতা বাড়ে, তেমনই বিভিন্ন অংশের সংযোগ ঘটে। শুধু শুয়ে বসে থেকে, প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে বা ইগো স্যাটিসফেকশনের জন্য কোন দলকে সমর্থনের খেলাধুলা দেখে কোন উপকার হয় না, বরঞ্চ আরও ক্ষতি হয়। দলগত ইগো ভিত্তিক অসুস্থ আবেগ নির্ভরতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
আমাদের সময়ে মানব জ্ঞানের সাথে গভীর দার্শনিক সংযোগ আছে এমন সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তবে এমনই একজন সাংবাদিক হলেন আমেরিকার সাংবাদিক বিল ময়ার্স। পিবিএস এর ছয় খন্ডের টেলিভিশন “দি পাওয়ার অব মিথ” তথ্যচিত্রে যিনি খ্যাতনামা মিথতত্ববীদ জোসেফ ক্যাম্পবেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যা পরে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে জর্জ লুকাসের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারেও দেখা যায় কি অসাধারণ ক্ষমতা বিল ময়ার্সের যিনি সঠিকভাবে মানব জ্ঞানের জটিল বিষয়ে ঢুকে যেতে পারেন ও সাম্প্রতিকতার উত্থান পতনকে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। বিল ময়ার্স ও জোসেফ ক্যাম্পবেলের “দি পাওয়ার অব মিথ” এর তেমনই একটি অংশ:
ক্যাম্পবেল: পুরাকালে বীর যে বিশ্বে চলাফেরা করত তা এতটা যান্ত্রীক ছিল না। জীবন্ত ছিল পৃথিবী এবং তা বীরের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিরও ছিল সহায়ক। আজ বিশ্ব এমনই যান্ত্রিক হয়ে গেছে -পদার্থবিজ্ঞান, মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র এবং আচরণ মনস্তত্বের আলোক বিশ্লেষণের মাধ্যমে – যে আমরা এখন পরিষ্কার ছকে বাধা তার ছাড়া আর কিছু নই। নাড়া পেলেই কেবল যান্ত্রীকভাবে সাড়া দেই। ঊনবিংশ শতকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আধুনিক জীবন থেকে মানুষের ইচ্ছা বাসনার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
ময়ার্স: রাজনৈতিক অর্থে এইসব মিথের গল্পে কি কোন বিপদের আশঙ্কা রয়েছে? এই যে গল্পগুলি অন্যের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী বলে আর আমরাও অনেকটা অ্যাম্ফিথিয়েটার বা ক্যলিসিয়াম অথবা থিয়েটারে বসে সে সব দেখি আর নিজেদের নপুংসকতার দোহাই দেই?
ক্যাম্পবেল: আমার মনে হয় এই ব্যাপারটি খুব সম্প্রতি আমাদের সংস্কৃতিতে এসে ঢুকেছে। খেলাধুলায় অংশ না নিয়ে খেলাধুলা দেখে আনন্দ পাওয়াটা এক ধরনের পরকীয়া তৃপ্তি। কিন্তু আমাদের সভ্যতায় লোকে যে ভোগান্তির মধ্যে থাকে সে কথা একবার ভাবলে বুঝবেন আধুনিক মানুষ হয়ে জন্মানো কি ঝামেলার। অধিকাংশ লোক যাদের পরিবার আছে, যাদের এক গাদা পোষ্যের ভরণপোষণের জন্য দিনরাত খাটতে হয় গাধার খাটনি -বেশ, তো ব্যাপারটা জীবনপাতেরই বটে।
ময়ার্স: কিন্তু আমি এই অবস্থাকে দ্বাদশ ও পঞ্চদশ শতকের প্লেগের সাথেই তুলনা করব।
ক্যাম্পবেল: তাদের জীবনযাত্রার প্রণালী আমাদের চেয়ে অনেক সক্রিয় ছিল। আমরা তো অফিস ঘরে বসেই জীবন কাটাই।
শিশুকাল থেকে খেলাধুলা বাদ দিয়ে পড়াশোনার চাপ ও তারপর আমাদের পেশা এবং সেটার প্রতি আমাদের একাগ্রতা আমাদের মস্তিস্ককে খর্ব করে নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের মস্তিস্কগুলো পরিণত হচ্ছে যেন বিশাল সব কর্পোরেট বা রাষ্ট্রযন্ত্রের যন্ত্রাংশ মাত্র। এর ফলে আমরা আর বুঝছি না আমাদের যন্ত্রণাগুলো কোথায়, সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়, সমাধান কোথায় বা আমাদের পথপ্রদর্শক বা নেতা কে, আমাদের মুক্তির বীর নায়ক আসলে কারা। মুক্তির বীর বা নায়কের প্রতি আমাদের যে আবেগ ও ভালবাসা, সমর্থন – সেগুলোর অপচয় হচ্ছে শিল্পী খেলোয়ার অভিনেতার ছায়া নায়কদের প্রতি বিনিয়োগে যারা শুধুই কলাকার বা ক্র্যাফসটম্যান মাত্র - নায়ক বা বীর নন। জীবনের প্রকৃত নায়কেরা থেকে যাচ্ছে অচেনা যারা আমাদের আবেগ আর সমর্থন পেলে মুক্তি এনে দিতে পারত সহজেই।