বেশ অনেক বছর হয়ে গেল, তখন বন্য হাতির খোঁজে হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর টেকনাফের সাগর পাড়ের পাহাড়গুলো। প্রতিদিন ভোর বেলা বের হই স্থানীয় এক গাইড সহ। খুঁজে বেড়াই পাহাড় সমান হাতি। হাতি আকারে বিশাল হলেও পাহাড়ে সে আপনার কয়েক হাত দুরে থাকলেও আপনি অনেক সময় বুঝতেই পারবেন না যে এখান হাতি আছে কারণ ওরা এতটাই চুপচাপ ও ক্যামোফ্লেজ করে যায় ঝোপ ঝাড়ের সাথে। এটা ভয়েরও একটা বিষয় কারণ পাহাড় জঙ্গল যাই থাক হাতির কাছে সেসব মোটেও কোন বাধা নয় এবং সে দৌড়ায় মানুষের চেয়ে দ্রুত। তাই সে যদি ভয় পেয়ে যায় বা ক্ষিপ্ত হয় এবং চার্জ করে বসে তাহলে জীবন বিপন্ন হওয়া মুহূর্তের বিষয়। আমি নিজে এবং আমার গাইড তাই খুব সচেতন। আরও একটা ভয় আছে, সেটা হল ডাকাতের ভয়। যদিও সেটাকে আমরা খুব একটা পাত্তা দেই না তবে অবেলায় পাহাড়ে থাকি না। পাহাড়গুলোতে টানা বেশ কয়েকদিন খুঁজেও আমরা কোন হাতির দেখা পেলাম না।
পাহাড়ে ছবি তোলা বেশ শ্রম সাপেক্ষ। অনেক হাঁটতে হয় দুটো ক্যামেরা ও ডে-প্যাকের ভারী ওজন সহ যাতে থাকে নানা মাপের লেন্স, স্পেয়ার ব্যাটারী, পানি, রেইন প্রোটেক্টিভ গিয়ার ইত্যাদি। বেলা এগারোটা বেজে গেলে পাহাড়ে সূর্য্যের তাপ এত বেড়ে যায় যে কাজ করা কঠিন। তাই আমরা ভোর বেলা থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে বোথাও দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর বিকালটা স্থানীয় গ্রামে চলে যেতাম হাতি সংক্রান্ত নানা তথ্য, ঘটনা ও গল্প শুনতে। অসাধারণ সব ঘটনা, গল্প ও বিশ্বাসের কথা শুনতাম কিন্তু সে সব কথা আর একদিন বলা যাবে।
পাহাড়ে হাতির ছবি না পেলেও পাখি ও অন্যান্য প্রাণী বা গ্রামের ও পাহাড়ে কাজ করা মানুষদের অনেক ছবি পেতাম যেগুলো তেলাও আমার খুব প্রিয়। এমনই এক পাহাড়ে একবার দূর থেকে দেখলাম অনেকগুলো বাঙালি মেয়ে কোন একটা কাজ করছে। পাহাড়ের সবুজ ব্যাকড্রপে রঙীন সব পোশাকে মেয়েগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ ঘাসে অনেকগুলো রঙীন ঘাসফুল। আমার প্রধান ক্যামেরায় হাতির জন্য ওয়াইড লেন্স লাগানো। দ্বিতীয় ক্যামেরায় লাগানো জুম লেন্সটা নিয়ে মেয়েগুলোর বেশ কিছু শট নিলাম। শট নেবার সময় খেয়াল করলাম মেয়েগুলোর মধ্যে কয়েকজন হাত দিয়ে তাদের বুকের উপরের কাপড় টানা টানি করছে। বাংলাদেশে প্রান্তিক অঞ্চলে এটা নতুন কিছু নয়। ক্যামেরা দেখলেই মেয়েরা তাড়াতাড়ি হয় মুখ ঘুরিয়ে পেছনের দিকটা দেখায় অথবা শরীরের কাপড়টা দিয়ে শরীর বিশেষ করে বুকটা ঢাকার চেষ্টা করে।
যখনই কোন ফটো টুরে যাই রাতে রেষ্ট হাউজে এসে প্রথম কাজ হলো ক্যামেরার কার্ড থেকে ছবিগুলো ডাউনলোড করে কার্ড খালি করা ও ব্যাটারিগুলো চার্জ করে পরের দিনের জন্য সব রেডি করে রাখে। কার্ড খালি করতে গিয়ে দিনের তোলা ছবিগুলো একবার দেখার লোভ আমি কখনই সামলাতে পারি না যে কেমন হল, যত টায়ার্ডই থাকি। ঐ দিন পাহাড়ে ছবিগুলো ডাউনলোড করার পর ঐ মেয়েদের ছবিগুলো দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমার ৮ ফ্রেম পার সেকেন্ডে হাই ফ্রেম রেটে (তখনকার দ্রুততম ক্যামেরা) পরপর ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে মেয়েগুলো কাপড় টেনে তাদের বুক ঢাকছে না, কাপড় সরিয়ে সেগুলো খুলে এমন ভাবে রাখছে যাতে তাদের উন্নত বুকগুলো আরও ভালভাবে দেখা যায় এবং তাদের আরও ‘যৌন আকর্ষণীয়া’ লাগে।
আমরা যারা ফটোগ্রাফিকে আর্ট হিসাবে নিয়েছি, এর পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা ও প্রচুর সময় দিচ্ছি আমাদের ক্যামেরা, আমাদের ছবি এবং তার সাবজেক্ট আমাদের কাছে ‘পবিত্র’ কিছু। আমরা কোন যৌন আবেদনময়ী নারীর উলঙ্গ ছবি তুললেও সেটার কোন প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত যৌন অনুভূতির উপর পড়ে না। সেই ছবিটিও আমাদের কাছে একটা আর্ট পিস মাত্র, আমাদের তোলা ছবি আমাদের কাছে যৌন আনন্দের উৎস নয়। সেগুলো রক্ত মাংসের বস্তুজগতের প্রভাব ছাড়িয়ে একটি বিশুদ্ধ অনুভূতি বা জীবনের একটা অব্যক্ত গল্প বলে কিনা সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
পাহাড়গুলোতে আরও কয়েকদিন চেষ্টার পর একদিন পেয়ে গেলাম হাতির দল। সারাদিন ছবি তুললাম চমৎকার সব বন্য হাতির যারা দল বেঁধে এসেছিল। আমার কাজ শেষ, ফিরে যাব। পরের দিন সব কিছু গুছিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরে যাব, তখন ফোন এল বিমানে ফ্লাইট ক্যান্সেল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে, বিমান ঢাকা থেকেই আসেনি। এত জিনিষপত্র নিয়ে বাসে যেতে ইচ্ছা হল না যেহেতু আগে থেকে ভাল সিট বুকিং করা নেই। ভাবলাম আরও একদিন থেকে সেন্টমার্টিন থেকে ঘুরে আসি, দুই দিন পরের বিমানের টিকেট বদলে নিলাম।
পাহাড়ের থেকেও সাগর আমার অনেক বেশী পছন্দ। অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ ও গ্রাফিক্যাল সৌন্দর্যে পাহাড় অনবদ্য হলেও সব পাহাড়ই যেন অনেকটাই প্রাণহীন। জীবন মানে পানি এবং ক্ষুদ্র প্রাণী গুল্ম থেকে মানুষের কর্মকান্ড অর্থাৎ প্রাণ প্রাচুর্য যেন সমতলে, সাগর পাড়ে অনেক বেশী। সেন্টমার্টিন তাই আমার খুব প্রিয় একটি জায়গা। কিন্তু এখানে গেলে একটা বিষয়ে মন খারাপ হয়ে যায় যখন দেখি চার পাঁচ বছরের মেয়ে শিশুদেরও বোরকা-হিজাব পরিয়ে রাখা হয়েছে। শিশুদের ছবি তোলা আমার সবসময়ই প্রিয় কারণ শিশুদের মধ্যে একটা আশ্চর্য সজীবতা থাকে। তাদের চোখগুলো এত পরিষ্কার, এত স্পষ্ট। তাদের মুখমন্ডল এক পরিচ্ছন্ন মখমলের কোমলতা থাকে যা দেখে আমাদের মন প্রফুল্ল হয়, অনেকটা যেন শিশিরে সদ্য ফোটা ফুলের মত যা দেখে শিশুদের প্রতি আমাদের ভালবাসা বাড়ে। মেয়ে শিশুরা অনেক বেশি স্পষ্ট করে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে ছেলেদের চেয়ে। তাদের মনের আবেগ ছবিতে ফুটে ওঠে অনেক স্পষ্ট হয়ে। তাই তাদের ছবি তোলা মানে মানবিক আবেগকে আরও বেশী করে ফ্রেমে ধরতে পারা। কিন্তু সেন্টমার্টিনে এগুলো সম্ভব হয় না। এখানে এখন শিশুরা থাকে সম্পূর্ণ ঢাকা এবং মেয়ে শিশুরা ক্যামেরা দেখলেই হয় পেছন ফিরে যাবে অথবা দৌড়ে দুরে চলে যাবে। আগে কিন্তু এমন ছিল না। বোরকা হিজাব পরার পেছনে যুক্তি হল নারীর শরীরের কোন অংশ দেখে যেন পুরুষের মনে কাম বা যৌন ইচ্ছা জাগ্রত না হয়। শিশুদের দেখে যদি কারও মনে কাম বা যৌন ইচ্ছা জাগ্রত হয় তবে সে হয় মানসিক বিকারগ্রস্থ অথবা পশুপ্রবৃত্তির ধারক একজন আস্ত শয়তান। একটি শিশু উলঙ্গ থাকলেও কোন সুস্থ মনে কাম বা যৌন ইচ্ছা জাগ্রত হয় না। তবে কৈশোর মন কৌতুহলী হতে পারে বিপরীত লিঙ্গের যৌন অঙ্গগুলোর প্রতি। সেই কারণেই যৌন অঙ্গগুলো ঢেকে রাখা সমাজে প্রচলিত। কিন্তু তাই বলে পুরো মানুষটা? শিশুরা কি মেসেজ পায় সমাজ সম্পর্কে এই পোশাকের মাধ্যমে?
হাতির ছবি তোলার এই প্রজেক্টের পর পরই সুযোগ হল পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি ফটো ট্যুরের। সাধারণ টুরিস্টরা যেখানে যায় আমরা সাধারণত সেখানে গিয়ে খুব একটা ভাল কিছু পাই না যেহেতু আমরা প্রকৃতি ও সমাজকে তার চিরায়ত রূপে দেখতে চাই, টুরিস্টদের জন্য সাজগোজের কৃত্তিমতায় নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে গহিনে যাওয়া সহজ নয় যেখানে মানুষ এখনও তাদের আদিম সময়ের জীবন যাপনের সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। সেখানে যাবার পথের দুর্গমতা প্রচুর কিন্তু সেটা আমাদের কাছে বাধা নয়, এর চেয়েও বড় বাধা আমাদের সামরিক বাহিনী ও সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে সবুজ সংকেত সংগ্রহ। এবার সেই সুযোগটা হল। আমার সাথে যে স্থানীয় গাইড সে কিছুটা পাগলা ধরনের। তার সাথে পরিচয়ের পর আমাকে তার মনে ধরল তাই সে বলল দাদা আপনাকে সুন্দর একটা পাড়ায় নিয়ে যাব, আপনি যেমন চাচ্ছেন, তেমন পাড়া পাবেন।
ছড়ার মধ্য দিয়ে সারা দিন দীর্ঘ পথ হেঁটে আমরা সেই পাড়ায় পৌঁছালাম। আমার গাইড সেই পাড়ার হেডম্যানকে কি বলেছে কে জানে, গিয়ে দেখি রাজকীয় আপ্যায়ন। এর জন্য কিছু পরীক্ষাও দিতে হল আমি যে তাদের সাথে একাত্ম এর প্রমাণ হিসাবে। পাশ করার ফলে লাভ হল যে আমাকে কেউ আর আগন্তুক ভাবল না। বেশ কয়েকদিন ঐ পাড়ায় আমি থাকলাম এবং আমার কাছে মনে হল দশ হাজার বছর আগে আমাদের পুর্বপুরুষেরা কিভাবে জীবনযাপন করত তার জীবন্ত নিদর্শন যেন এই পাড়াটা। সেই সংস্কৃতিকে আজও ধরে রেখে তারা এবং এখনও আমাদের চেয়ে যেন অনেক ভাল আছে তারা।
পাড়ার ভেতরে থাকলে এই পাড়াটিতে মেয়েরা শরীরের উপরের অংশে কোন কাপড় পড়ে না। নিচের অংশেও যেটা পরে সেটা খুবই সামান্য যা শুধু কোমরের অংশটুকু ঢেকে রাখে। রেওয়াজ অনুযায়ী হেডম্যানের (গ্রাম প্রধান) বাড়িতেই আমার আশ্রয় যেটি একটি যৌথ পরিবার। সবাই খুব আন্তরিকতার সাথেই আমাকে তাদের পরিবারে আপন করে নিল। আমি তাদের সাথে একসাথে পান করলাম, আহার করলাম, তাদের বিষয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম। মেয়েরা তাদের নিজেদের দৈনন্দিন কাজে নিয়জিত হলে তাদের ছবি তুললাম। পরের দিনগুলো পাহাড় প্রকৃতির ছবি তুললেও বিভিন্ন ঘর (বাড়ি) আমাদের আমন্ত্রণ জানাল। সেইসব ঘরে নারী পুরুষ ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে বসে গল্প করলাম যেখানে ঘরের মধ্যে মেয়েরা কোন পোশাক পরে আছে বলেই মনে হয় না। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের সমতলের সংস্কৃতি অনুযায়ী অত্যন্ত আকর্ষনিয়া শরীরের অধিকারি। তাদের শুধু খোলা বুকই নয়, উরু জানু এগুলোও দৃশ্যমান এবং এই বিষয়ে তাদেরও কোন রকম বিব্রতবোধ নেই। অতিথিদের সাথে দুপুরে এবং রাতে খাবার আগে এখানে সবাই সুরা পানে অভ্যস্ত, তাই শুধু সচেতন অবস্থায় নয়, মদের আবেশেও তারা কেউ ‘উলঙ্গ’ নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না বা তার দেহের প্রতি আপত্তিকর দৃষ্টিও দেয় না। আমি যেহেতু ইউরোপিয়ন সামাজিকতার সাথে অনেক মিশেছি, আমি জানি যৌন ইচ্ছা এমনকি যৌন দৃষ্টিও একটি পূর্ব অনুমতির বিষয়। যে নারী তার দেহের দিকে অপরকে যৌন দৃষ্টিতে তাকানোর অনুমতি দেয় নি, সে উলঙ্গ থাকলেও তার প্রতি যৌন দৃষ্টিতে তাকানো যাবে না, এটাই সভ্য জগতের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। এটা জানি বলেই আমিও তাদের দেহ বা পোশাকের দিকে কোন নজরই দেই নি আমার ফটোগ্রাফিক আগ্রহ ছাড়া। তাই আমার মনে তাদের শরীর কোন ছাপও তৈরী করেনি। ওখানে যে পুরুষেরা বাস করে নারীর খোলা শরীর বা তাদের স্তনের প্রতি তাদের কোন নজরই নাই। নারীরাও তাদের দেহের গঠন বা স্তনের আকার আকৃতি নিয়ে কোন ভাবেই চিন্তিত নয়।
মাত্র একশ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে একটি সমাজ পাঁচ ছয় বছরের শিশুদের বোরকা পরিয়ে রেখেছে, আর এক সমাজের মেয়েরা নিজেদের পোশাক খুলে ফেলছে যাতে নিজেদের সুগঠিত স্তনগুলো আগন্তুকের দৃষ্টিগোচর করানো যায় যাদের সরকার মদকে মাদক ঘোষণা করে মদ খাওয়াকে ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি বানিয়ে ফেলেছে। ক্রসফায়ারে দিয়েও যে সমাজে যেখানে ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না আর সেই মাটিরই এক আদিম সংস্কৃতিতে একই ঘরে প্রায় ‘উলঙ্গ’ নারী ও পুরুষেরা একসাথে বসে মদ্যপান করছে অথচ কোন যৌন দৃষ্টি নেই, কোন অপরাধবোধ নেই, নারীরা সম্পূর্ণ মুক্ত তাদের দেহকে যৌন বস্তু হিসাবে দেখার মানসিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে। এখানে সভ্য তাহলে কারা?
নারীর দেহকে বিশেষ করে তার স্তনগুলোকে পুরুষের যৌন ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখা একটি নতুন পশ্চিমা আবিষ্কার। গ্রীক দেবতাদের এমনকি আফ্রিদিতি বা ভেনাসের মুর্তিগুলোকে দেখলে দেখা যাবে তাদের স্তনগুলো প্রমিনেন্ট নয় এবং খোলা। এর কারণ হলো সকল প্রাচীন সমাজে নারীর স্তনকে মাতৃত্বের সিম্বল ও সেগুলো শিশুর আনন্দের উৎস হিসাবেই পরিগনিত হয়েছে, পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসাবে নয়। উনিশ’শো একান্ন সালে অ্যানথ্রোপোলজিস্ট ক্লিল্যান ফোর্ড ও এথনোলজিস্ট ফ্র্যংক বিচ ১৯১টি জাতী-সংস্কৃতির উপর গবেষণা করে লিখেন যে ১৯১ টির ভেতরে মাত্র ১৩ টি জাতী-সংস্কৃতিতে নারীর স্তনকে পুরুষের যৌন উপলক্ষ হিসাবে গণ্য করা হয়। রেঁনেসার সময় ও তার আগের নগ্ন নারীদেহের যত শিল্পকর্ম, তার বেশিরভাগেই নারীর স্তন মাতৃত্বের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবেই প্রদর্শিত, পুরুষের যৌন আগ্রহের বস্তু হিসাবে প্রদর্শনযোগ্য করে নয়। ইওরোপে খ্রীষ্টীয় রাখঢাক ও রক্ষণশীলতা সমাজে যত বাড়তে থাকে, নারীর স্তন ততই পুরুষের যৌন আগ্রহের বস্তু হিসাবে পরিগনিত হতে থাকে। আবেদনময়ী দেহ ও উন্নত স্তনের নারীরাও এটাকে লালন করতে থাকে সমাজে তাদের মূল্য বৃদ্ধি করতে ও অবস্থান দৃঢ় করতে।
নারীর বুদ্ধি, আবেগ ও তার মানবিক গুণগুলো বাদ দিয়ে তার দেহ বা স্তনদুটোকে বড় করে দেখা ও সেগুলো দিয়ে তাকে বিচার করাকে কোন কোন গবেষক নাম দিয়েছেন মনরো সিনড্রোম (মেরিলিন মনরো থেকে)। মেরিলিন মনরো যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ও সাম্প্রতিক জাগতিক জ্ঞানসম্পন্ন ছিল। অথচ সে মুল্যয়ীত ছিল কেবল তার দৈহিক রূপ, গ্ল্যামার ও সুউন্নত স্তনজোড়ার জন্য। যখন একজন নারী তার মানসিক সামাজিক গুণগুলোর চেয়ে তার দৈহিক রূপের জন্য বেশী মুল্যায়ীত হয়, তখন সে রং অ্যাসোসিয়েশন বা ভুল গোষ্ঠীর সংশ্রবের ফাঁদে পড়ে যায়। একাধিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আমেরিকায় পুরুষেরা নারীর বড় স্তনের প্রতি সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত বা অবসেসিভ। মনবৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে নারীর বড় স্তনের প্রতি অবসেশন পুরুষের শিশুকালের অপ্রাপ্তির উদ্বেগ বা ইনসিকিউরিটির সাথে সংযুক্ত। এই ইনসিকিউরিটির সাথে ব্যবসায় উন্নয়ন তথা অর্থ উপার্জনও জড়িত। তারাই সম্পদের পাহাড় গড়ে যারা কখনও সন্তুষ্ট হয় না।
আমি যখন আমার প্রথম স্টার্টআপটা শুরু করি তখন যেখানে আমাদের অফিস ছিল তার পাশে থাকত একটা ছেলে আমাদের চেয়ে একটু বয়সে বড়। তার সাথে একরকমের বন্ধুত্ব ছিল এই যেমন সে অফিসে আসত, আড্ডা দিতে মাঝে মাঝে (স্টার্টআপ অফিসগুলো এমনই হয় দীর্ঘ সময় অফিস চলে, আড্ডা সামাজিকতা ও কাজ সবই একসাথে চলে)। মাঝে মাঝে সে আমাদের বিজ্ঞান ক্লাবনির্ভর যে অনুষ্ঠানগুলো হতো সেগুলোতে যেত। তখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পিছনে দুর শিক্ষণ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড: খান মো: সিরাজুল ইসলামের অফিস ছিল। তিনি তার আগে বিজ্ঞান জাদুঘরের পরিচালক ছিলেন ও আমাদের মত বিজ্ঞানকর্মীদের খুব উৎসাহ দিতেন। উনার অফিসে নতুন নতুন সব মিডিয়া যন্ত্রপাতি (ক্যামেরা ভিটিআর) ও কনটেন্ট (ডক্যুমেন্টরি) আসত। তখনও ডিটিএস বা সরাসরি স্যাটেলাইট টিভি চালু হয়নি তাই সেন্সর করা বিটিভিই ছিল একমাত্র এডুকেশন এবং রিক্রিয়েশন। তো সেই দুর শিক্ষণ ইন্সটিটিউটে ড: ইসলাম আমাদের একবার ডাকলেন নতুন কিছু ডকুমেন্টরি এসেছে আফ্রিকার আদিবাসীদের সম্পর্কে। আমরা সবাই দেখতে গেলাম। খুবই ভাল লাগল আফ্রিকার আদিম সমাজের মানুষদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও সংস্কৃতিগুলো দেখতে। পরের দিন অফিসে আসতে অফিসের পাশে থাকা ঐ ছেলেটির সাথে দেখা। সে আমাকে বলল কাল দেখেছ? জিনিষ? আমি বললাম কোন জিনিষ? তখন সে বলল ঐ যে কালা মহিলাদের জিনিষগুলা? আমি বললাম দেখেছি কিন্তু এতে উৎসাহিত হবার মত কি আছে? সবই তো নানা বয়সের নারীদের ক্যানডিড জীবনযাপনের চিত্র, তারা পোশাক পরে নাই, কিন্তু তাতে এত উৎসাহিত উত্তেজিত হবার মত তো কিছু নাই। আমরা মনে হল সে আমার কথায় বেশ দমে গেল।
এই যে ছেলেটির মন, সে আসলে নারীর নগ্নতা, নারীর স্তনের প্রতি অবসেসড। পুরো ডকুমেন্টরির আর কিছুই সে দেখেওনি, সে বোঝেওনি। কোন বিষয়ে অবসেসড যারা তারা শুধু তাদের মনের ধারণায় অবসেসড হয়ে থাকে তার অতীত আবেগ ও সেটার আবেগতাড়িত অক্ষম চিন্তা বা নষ্টালজিয়া দ্বারা। নারীদেহ বা তার অঙ্গ নিয়েও এমন হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে খুব নামকরা একটি নভেল হচ্ছে ভ্লাদিমির নভেকভের লোলিটা। সেটি এতই জনপ্রিয় যে আমাদের দেবদাসের মত কতজন পরিচালক যে সেটা নিয়ে ছবি নাটক বানিয়েছে আর দুনিয়ায় কত ভাষায় যে সেটা অনুবাদ হয়েছে তান যেন হিসাব নাই। এই গল্পে নায়ক মধ্য বয়সি হামবার্ট (বয়স ৩৭) তার ১২ বছর বয়সি সৎ কন্যা ডলোরসের (লোলিটা যার গোপন নাম) প্রেমে পড়ে ও তার সাথে যৌন সম্পর্ক চালিয়ে যায়। নোভেল লোলিটা কোনভাবেই বইয়ের পাতায় পর্নোগ্রাফি নয়, সেখানে বিস্তারিত কোন যৌনকর্মের বিবরণ নাই, কিন্তু সেটা যেন খুবই আছে তার পাঠকদের মাথায়। মনোবিজ্ঞানী ও সাহিত্যবিশারদদের মতে ১২ বছরের মেয়ের সাথে কোন পরিণত পুরুষের প্রেম, যৌনতা কিছুই হতে পারে না। এটা আছে শুধুই লেখকের মাথায়। সে যখন কিশোর ছিল এবং সে উৎসাহী ছিল তার এক কিশোরী সহপাঠীর প্রতি, সহপাঠীর প্রতি আকর্ষণ দেখে তাকে যখন সেই সহপাঠির কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, তার মনে তৈরী হয়েছে ট্রমা। তার মনে তার প্রেমিকা সেই কিশোরিই রয়ে গেছে যা উঠে এসেছে বাইয়ের পাতায় নভেল হয়ে। ঘটনাটি এই পর্যন্ত হয়ে থেমে গেলে সমস্যা ছিল না। পাঠকেরাও বেশীরভাগ এমনই অতীত ধারণ করে তাই একই আবেগ তাদেরও গ্রাস করে। লেখকের মনের সেই অবসেশন পাঠককেও একই ভাবে উত্তেজিত করে তোলে যেখানে পুরো মিথস্ক্রিয়াটাই সেরিব্রাল – যা লেখক পাঠকের চিন্তাতেই শুধু ‘বাস্তব’। প্রকৃত ১২ বছরের মেয়ের বাস্তবতার সাথে এর কোন যোগাযোগ নেই। এটা কালেক্টিভ সাইকোসেক্সুয়াল অবসেশন। কিন্তু সমস্যা হল নারীরা যখন ডমিনেন্ট কালচারের পুরুষদের সেই কালেক্টিভ সাইকোসেক্সুয়াল অবসেশনকে নির্ভর করে নিজেদের জীবন রচনা করে পরিচালিত করে।
বর্তমানের হলিউড নির্ভর যে মিডিয়া ও সংস্কৃতি সেটা লক্ষ লক্ষ মানুষের এই কালেক্টিভ অবসেশনকেই কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করে। সমস্যাটা এতই জটিল যে নারীরাও এতে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করে এবং সে তার দেহ সৌন্দর্যের এই পুরুষ অবসেশন দ্বারা মুল্যায়িত হতে চায়। এর ফলে সে যাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে বা যাদের প্রণয়ী হিসাবে গ্রহণ করে সবাই এই ফিমেল বডির মেল কালেক্টিভ অবসেশনে নিমজ্জিত ব্যক্তিবর্গ। সেই নারী যখন একসময় আত্মিক যোগাযোগ ও তার নিজের মনকে বিকশিত করার তৃষ্ণায় ভোগে তখন তার নিজের শরীরই যেন তার মানবিক সংযোগের পথ সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন যে যদি সেই আত্মিক সংযোগ পেতে চায়, তাহলে তার দেহকে এতদিন যা ভেবে এসেছে, সেটাকে বিসর্জন দিতে হবে। সেই সাহস খুব কম নারীরই থাকে। বেশীরভাগ বেছে নেয় শরীরকেই আজকাল, কৃত্তিমভাবে চেষ্টা করে বয়স থামিয়ে রাখতে, চীরকাল কিশোরী তরুণী থাকতে।
এরই প্রকৃষ্ট একটি উদাহরণ হল লেবানিজ-আমেরিকান এক্স পর্নস্টার মিয়া খলিফা। সাত বছর বয়সে যখন সে বৈরুত থেকে মাইগ্রেট করে আমেরিকার মেরীল্যান্ডে আসে তখন সে বুদ্ধিমান ও স্মার্ট একজন ছাত্রী যে হয়েছিল ইতিহাসে স্নাতক। স্কুল-কলেজে শারীরিক দিক থেকে সে কিছুটা স্থুলকায় ছিল ও ছিল সাদাদের তুলনায় ডার্ক স্কিনের। নাইন ইলেভেনের পরবর্তিতে স্কুলে তাকে অনেক মন্দ কথা বা বুলি শুনতে হত। এতে নিজেকে আকর্ষনীয় করতে সে ডায়েটিং শুরু করে ও নিজের ওজন অনেকটা কমায়। কিন্তু এর ফলে তার শরীর হালকা হলেও তার স্তনগুলো অনেক ছোট হয়ে যায় যেটা নিয়ে সে নিজেই লজ্জিত হতে থাকে ও তার সামাজিক কনফিডেন্স হারাতে থাকে। সে ক্রমেই হতাশাগ্রস্থ হতে থাকে ও জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। বিশ বছরের মিয়া খলিফা সিদ্ধান্ত নেয় ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের। এটিই তাকে ক্রমে ক্রমে নিয়ে যায় এমন এক জগতে যেটা তার মোটেই পছন্দ ছিল না। স্বল্পদিনেই সে সেটা বুঝতে পারে ও স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে। দেড় বছরের মধ্যেই সে সেই জগত ছেড়ে দেয় কিন্তু এতেই দুনিয়ার সবাই তার নাম জেনে যায় পর্ন আইকন হিসাবে।
নারীর স্তন, নারীর দেহ পুরুষের অবসেসিভ আগ্রহের বস্তু বানালে সেটা শুধু পর্ণ নয়, সকল ব্যবসায় সহায়ক। শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা এর সাথে জড়িত। এর ফলে অর্থ ও ক্ষমতায় লাভবান হয় প্রচুর সংখ্যক নারীও যারা শারীরিকভাবে মার্কেট ডিম্যান্ডের সাথে মেলে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেটা বেশিদিন টেকে না এবং বেশীরভাগ নারীই এতে হয় বঞ্চিত। তার সাথে সাথে তৈরী হয় নারীর প্রতি পসেসিভ ও ডোমিন্যান্ট পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গীর যেহেতু তারা বস্তুগুনে সমাদ্রিত। তৈরী হয় সামাজিক হীনতার ও নারীর নিরাপত্তার অভাব।
যদি আমরা ধরে নেই নারীর যে স্তন আছে সেটা মাতৃত্বের সম্পদ এবং বেশীরভাগ আদি সংস্কৃতির মত নারী যদি এটা ঢেকে না রাখত তবে এর অবসেসিভ ‘বাজারমূল্য’ বেড়ে এমন হত না। বাজারমূল্য সবসময় ডিম্যান্ড ও সাপ্লাইয়ের উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি পাতিলকে সিলভারের হাঁড়ি পাতিল বলা হয়ে থাকে। এটা কেন? এর কারণ একসময় সিলভারের বা রূপার জিনিষ অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে সস্তা ছিল। অ্যালুমিনিয়াম ছিল সোনার কাছাকাছি দামী। তখন মানুষ অ্যালুমিনিয়ামের গহণা বানাত, অ্যালুমিনিয়ামের মুদ্রা তৈরী হত, দামী মুর্তি তৈরী হত। কারণ অ্যালুমিনিয়াম দুনিয়াতে অনেক থাকলেও বিদ্যুৎযুগের আগে অ্যালুমিনিয়াম সহজে তার খনিজ থেকে আলাদা করা যেত না। নারীর স্তন আধুনিক যুগে তেমনই, এটা আছে কিন্ত ঢেকে রাখা তাই এটার বাজার মুল্য এখন অনেক। যার ভারে নারীর বুদ্ধি, শিক্ষা, আবেগ, মনুষত্ব আজ চাপা পড়ে গেছে, হয়ে গেছে যেন মুল্যহীন।
নারীর পোশাক নিয়ে আজকের বাংলাদেশ এমন এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে যেটা সেই মধ্যযুগেও কখনও ঘটেনি। এক হলিউড-ইন্টারনেটের খোলামেলা অবজেক্টিফিকেশন অব ফিমেল বডি। আর এক সৌদি-মালয়েশিয়া প্রবাসী ইসলামী অর্থনীতির চাপে পোশাকী রাখঢাক ও ভুয়া রক্ষণশীলতা। আর তৃতীয় সহজ সরল বাঙালী সংস্কৃতি যেখানে শাড়ি পরা হত ব্লাউজ ছাড়াই। পানির তিনটি রূপ যথা কঠিন, তরল ও বায়বীয়। পানি এই তিনরূপে একসাথে থাকতে পারে না। যে কোন সমাজে তার মুল্যবোধ কি হবে সেটাও এমন ত্রিশঙ্কু হলে তারা শান্তিতে থাকতে পারে না। হয় সেখানে সাংস্কৃতিক বিভাজন থাকতে হয় নয়ত যে কোন একটিকে বেছে নিতে হয় সাধারণ মুল্যবোধ হিসাবে – নইলে চলতেই থাকবে দমন, নিপিড়ণ, অপমান, ধর্ষণ – নারী যতই উপরের চেয়ারগুলোতে বসুক না কেন।