আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে আমেরিকা ও ভারত যখন বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে দেশে আইন, শৃঙ্খলা ও সু-শাসন ফিরিয়ে আনার চাপ দিচ্ছে ঠিক তখনই দেশের অবৈধ সরকারের একটি অংশ সেই চেষ্টা করতে গেলে সশস্ত্র বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। দুর্নীতি ও অপশাসনের দায়ে সরকার পরিবর্তন হলে এর পর সু-শাসন প্রতিষ্ঠা ও নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ঠেকাতে সেই দেশে গৃহযুদ্ধ কেন লাগাতে হবে সেই প্রশ্ন দেশের গণমাধ্যম, গণ আলোচনা বা সামাজিক মাধ্যমের বিতর্কে তেমনটা নেই। বিতর্ক চলছে তুচ্ছ নগণ্য জিনিস নিয়ে, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কতক্ষণ সময় দিলেন, কত সময়ব্যাপী হাত মেলালেন এইসব।
দেশে গৃহযুদ্ধ কেন লাগাতে হবে তার উত্তর আছে কেন জুলাই সন্ত্রাস হয়েছে তার নীল নকশায়। সেই নীল নকশায় গৃহযুদ্ধই পরিকল্পিত ছিল। গত বছর অগাষ্টের ৫ নয়, ৬ তারিখে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে অস্ত্রশস্ত্র সহ গণভবন অভিমূখে যাত্রা করার কথা ছিল। গণভবনে হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার লাশ সারা শহরে টেনে নিয়ে বেড়াবার ছিল পরিকল্পনা। যার ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে হাজার হাজার আওয়ামী কর্মী রাস্তায় নেমে আসত। শুরু হত রাস্তায় অলিতে গলিতে মারামারি যেটা পরিণত হত একটি গৃহযুদ্ধে। এবং তখন নামত সরকারী নানা বাহিনী এবং জেল ভেঙ্গে ও জেল থেকে ছাড়া পাওয়া সন্ত্রাসীরা। তাদের সাথে যুক্ত হত জামাত বিএনপির ক্যাডার ও প্রতিটি মহল্লার স্থানীয় অপরাধীর দল ও ছাত্র নিয়ন্ত্রিত কিশোর গ্যাং। সেই গৃহযুদ্ধে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হত আওয়ামী কর্মী-সমর্থক এ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরব কর্মীদের।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। সাক্ষাৎকারে ডেভিড ফ্রস্ট শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলেন পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের হত্যার ধরণ দেখে:
ডেভিড ফ্রস্ট: কি আশ্চার্য! আপনি বলছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বের করে, খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ এমনিভাবে গুলি করে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: কোন মানুষকে মারলো, তারা কোন পরোয়া করলো না?
শেখ মুজিবুর রহমান: না, তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি।
ডেভিড ফ্রস্ট: কেবল হত্যা করার জন্য হত্যা-যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।
সেই শেখ মুজিবের মানুষদের হত্যা করাই ৬ অগাস্ট ২০২৪ এর লক্ষ্য ছিল। যেটা শোনা যায় অগাস্টের ৪ তারিখ রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বার্তা পরিকল্পনার অনেকটাই ভণ্ডুল করে দেয়। ভারত থেকে বার্তা দেওয়া হয় বাংলাদেশে যা হচ্ছে সেটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু তারা স্পষ্ট করে দেয় শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেটা করতে হবে। ভারত থেকে এই বার্তা ফাঁস হয়ে যায় এবং একদিন এগিয়ে ৬ অগাস্টের পরিবর্তে ৫ অগাস্ট গণভবন অভিমূখে সন্ত্রাসী মিছিল যাত্রা করে। সেই হিসাবে ৫ তারিখ সকালেই শেখ হাসিনাকে সামরিক বিমানে করে ভারতে পৌছে দেওয়া হয়।
সেটা না হলে কি হত? এর পর ব্যাপক পরিবর্তন হত রাষ্ট্রের। রাতারাতি হত সংবিধান পরিবর্তন, আওয়ামী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী নতুন আইন কানুন। রুজু করা হত হাজার হাজার গণ খুনের মামলা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং আওয়ামী কর্মী ও সমর্থকদের দায়ী করে নতুন খুনের মামলা। এর পর বছর ধরে চলত মব কিলিং ও মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করে গুপ্তহত্যা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও বাসাবাড়িতে আগুন দেওয়া ঠিক যেমন ৭১ সালে ঘটেছিল পাক মিলিটারি ও রাজাকার আলবদর দ্বারা। শুধু এবার মিলিটারি না থেকে থাকত মব ও মিলিশিয়া বাহিনী যাদের নেতৃত্বে থাকত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তারা এবং দেশী বিদেশী ইসলামী মৌলবাদী নেতারা। তার সাথে শুরু হয়ে যেত জুডিশিয়াল কিলিং। বিচারের নামে প্রহসন করে চলত ফাঁসী ও জেল যাবজ্জীবন। এভাবেই দেশকে আওয়ামী শূন্য করার পরিকল্পনা ছিল ২৪ এর সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এটা সিআইএ-আইএসআই এর কোন দেশকে অকার্যকর করার এসওপি বা সাধারণ কার্য পরিকল্পনা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সোচ্চার শক্তি এবং আওয়ামী নিধন শেষ হলে এর সাথে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করে তাদের সশস্ত্র করে যুক্ত করা হত মব মিলিশিয়াদের সাথে। তৈরি করা হত ইসলামিক বাহিনী। ঘোষণা করা হত খিলাফতী শাসন কায়েমের। ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সুতিকাগার হত বাংলাদেশ।
কিন্তু এই পরিকল্পনার পরের অংশও পুরোটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বাইডেন সরকারের পতন ও ট্রাম্প সরকারের বিজয়ের ফলে। আমেরিকায় ট্রাম্প সরকার মার্কিন ডিপ স্টেট ও জর্জ সোরোস-ক্লিনটন চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের মনোভাব ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যায়।
কিন্তু এর পরেও থেমে থাকে না সরকার ও সামরিক বাহিনীর ভেতরের একাংশের গৃহযুদ্ধ ও খিলাফতী শাসন কায়েমের খায়েশ। সামরিক বাহিনীর ভেতরের অংশ আপাতত দমিত হয়েছে মনে হলেও সরকারের একটি বড় অংশ ও ছাত্ররা সেটি বাস্তবায়নে সক্রিয়।
সামরিক কর্মকর্তা ও পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের লেখা একটি প্রবন্ধ দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেটিতে তিনি লেখেন আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে এই সম্ভাবনা দেখা দিলে কি ঘটে। জিয়া লেখেন:
সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে চার মাসের জন্য আমি পশ্চিম জার্মানী যাই। এই সময়ে বাংলাদেশের সর্বত্র এক রাজনৈতিক বিক্ষোভের ঝড় বয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থানকালে আমি একদিন দেখি সামরিক এ্যাটাচি কর্নেল জুলফিকার সে সময়ের পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কারিগরি এ্যাটাচির সাথে কথা বলছিল। এই ব্যক্তিটি ছিল এক সরলমনা পাঠান অফিসার। তাদের সামনে ছিল করাচীর দৈনিক পত্রিকা ডনের একটা সংখ্যা। এতে প্রকাশিত হয়েছিল ইয়াহিয়ার ঘোষণা, ১৯৭০ সালেই নির্বাচন হবে। সরলমনা পাঠান অফিসারটি বলছিল,নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে, আর সেখানেই হবে পাকিস্তানের সমাপ্তি।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরনোস্মুখ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম, তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারীদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরো জানলাম,কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারী বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারীদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু থেকে এরা যে ভয়ানক রকমের অশুভ একটা কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাসই আমরা পেলাম। তারপর এলো ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে, এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো।
এই সময়ে আমার ব্যাটেলিয়নের এনসিওরা আমাকে জানালো প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতিতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে, বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতি রাতেই তারা যায় কতকগুলো নির্দিষ্ট বাঙালী পাড়ায় নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালীদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালীকে হাসপাতলে ভর্তি হতেও শোনা যায়।
জিয়া ঠিকই আঁচ করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে এই সম্ভাবনা দেখা দিলে পাকিস্তানের গোপন সামরিক কৌশল কি হবে এবং নিজের অনুসন্ধানে তিনি সেটার প্রমাণও পেয়েছিলেন। আবার কিন্তু আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে এই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
একটি গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। একবার এক লোক গেছে চিড়িয়াখানায় পশু পাখি দেখতে। টিকেট কেটে ঢুকে সে সামনেই দেখে বানরের খাঁচা। ক্ষুধা লাগলে সে কয়কটি কলা কিনে খেতে খেতে বানরের খাঁচার সমানে গেল। সেটা দেখে একটি বানর করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটি দেখে লোকটির দয়া হলে সে একটি কলা ছিঁড়ে বানরটির দিকে ছুঁড়ে দিল। বানরটি একটি ভেংচি কেটে কলাটি নিয়ে দুই হাতে ধরে সুন্দর করে ছিলে তড়িৎ তার পশ্চাদ্দেশে প্রবেশ করিয়ে দিল। এতে লোকটি খুবই অপমানিত বোধ করল। ক্ষুব্ধ হয়ে সে নিকটেই থাকা চিড়িয়াখানার কর্মচারীর কাছে বানরের এই চুড়ান্ত বেয়াদবীর জন্য অভিযোগ জানাল। চিড়িয়াখানার কর্মচারী বলল বেচারা বানরের প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন না। আমি তার হয়ে আপনার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আসলে কিছুদিন আগে তাকে এক দর্শনার্থী একটি কৎবেল খেতে দিয়েছিল। মজাদার খাবার মনে করে সে চট করে গিলে ফেলে। কিন্তু বিপদ টের পায় পরের দিন সকালে। সেই থেকে সে কাউকে বা কোন কিছুকেই আর বিশ্বাস করে না। সবকিছুতেই বিপদ দেখে। এবং সেই থেকে সকল খাবার আগে নিষ্ক্রান্ত হবে কিনা সেটা নিজে পরীক্ষা করে তার পর গলধঃকরণ করে।
বাংলাদেশে যে সব স্টেট ননস্টেট অ্যাক্টররা ২৪ এর জুলাই সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী বা সমর্থক ছিল, তারা ঐ চিড়িয়াখানার বানরটির মত না বুঝে কৎবেল গিলে ফেলেছে। এখন এই কৎবেল তারা উগলে দেবে নাকি ত্যাগ করবে এবং কীভাবে করবে সেটা তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই কাজে স্টেকহোল্ডার যত বড় ও শক্তিশালী, তাদের কষ্ট হবে তত বেশী হবে।