রাষ্ট্র শাসনে মাটির নিচের শক্তি আর দৃশ্যমান শক্তি এক নয়। রাজার শক্তি থাকতে হয় কিন্তু শক্তির কখনও রাজা হতে নেই। রাজার শক্তি প্রয়োজন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায়। অপরদিকে মাটির নিচের শক্তি যদি রাজা হয়ে যায় তাহলে বিশৃঙ্খলায় ছেয়ে যায় রাজ্য। গত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে মাটির নিচের শক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। বাইরে কিছু খর্ব বুদ্ধি ক্লাউনদের বসিয়ে তাদের ক্যারিকাচারের আড়ালে বসে রাষ্ট্র চালাচ্ছে মাটির নিচের শক্তি যার পরিণতি হচ্ছে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা।
প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক যুগে, জিউস তার পিতা ক্রোনোস এবং টাইটানদের বিরুদ্ধে টাইটানোম্যাকি নামে দীর্ঘ দশ বছরের যুদ্ধ জিতে অলিম্পাস পর্বতের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তিনি তার ভাই-বোন হেডিস, পসাইডন, হেরা, ডেমিটার এবং হেস্টিয়া এদের নিয়ে বিশ্বের শাসন ভাগ করে নিয়েছিলেন। জিউস আকাশ ও পৃথিবীর শাসক হয়ে জগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলেন। তার হাতে ছিল শক্তিশালী অস্ত্র বজ্র, যা একচোখা দৈত্য সাইক্লপসরা তাকে উপহার দিয়েছিল। কিন্তু এই শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হলো না।
গায়া, ভূ-মাতৃদেবী, তার সন্তান টাইটানদের পরাজয়ে ক্রুদ্ধ ও শোকাহত ছিলেন। তিনি জিউসের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একটি নতুন শক্তি সৃষ্টি করলেন। গায়া মাটির নিচের শক্তি দেবতা টারটারাসের সাথে মিলিত হয়ে জন্ম দিলেন টাইফনকে। যে একটি দানব যার চেহারা ও শক্তি এতটাই ভয়ানক ছিল যে তাকে দেখে দেবতারাও ভয়ে কেঁপে উঠত। টাইফনের শরীরের উপরের অংশে ছিল শতাধিক সাপের মাথা, প্রতিটি মাথা থেকে আগুন ও বিষাক্ত ধোঁয়া বের হতো। তার চোখ দুটি ছিল জ্বলন্ত লাভার মতো, এবং তার গর্জন এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে সে তাকালে পাহাড় ধসে পড়ত। তার কোমর পর্যন্ত শরীর মানুষের মতো হলেও, নিচের অংশে ছিল বিশাল সাপের লেজ, যা পৃথিবীকে চাবুকের মতো আঘাত করত।
গ্রিক পুরাণের পাতাল বা নরকের নামও টারটারাস ছিল, যেখানে পাপাত্মারা পৃথিবীতে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি পেত। এই টারটারাস ছিল অতি ভয়ানক এক স্থান। জীবিত মানুষেরা এখানে প্রবেশ করতে পারত না। সের্বেরুস নামে ভয়ংকর এক তিন মাথাওয়ালা কুকুর ছিল টারটারাসের প্রহরী। কোন জীবিত মানুষ যদি এখানে প্রবেশ করার চেষ্টা করত অথবা কোন আত্মা যদি এখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করত তাহলে সের্বেরুস তাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করত। টারটারাসের অর্থাৎ নরকের রাজা ছিল মৃত্যুর দেবতা হেডিস।
একদিন টাইফন টারটারাসের গভীর অন্ধকার থেকে উঠে এল। তার পদচারণায় পৃথিবী কেঁপে উঠল, সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল, এবং আকাশে ঝড়ের কালো মেঘ জমতে শুরু করল। সে যেখানে যেত, সেখানে আগ্নেয়গিরি জেগে উঠত, এবং তার শত মুখ থেকে বের হওয়া গর্জন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে শোনা যেত। অলিম্পাসের দেবতারা তার আগমন দেখে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা বুঝতে পারল যে টাইফন এসেছে জিউসের শাসনকে উৎখাত করতে।
টাইফন অলিম্পাসের দিকে এগিয়ে আসার সময় তার বিশাল ছায়া আকাশকে ঢেকে ফেলল। সে গর্জন করে বলল, "জিউস, তুমি টাইটানদের পরাজিত করেছ, কিন্তু আমার কাছে তুমি হারবে। আমি পৃথিবী ও আকাশের নতুন শাসক হব।" তার কথায় দেবতারা এতটাই ভীত হলেন যে তারা তাদের দেবত্বপূর্ণ রূপ ত্যাগ করে পশু-পাখির ছদ্মবেশে নানা স্থানে পালিয়ে গেলেন। অ্যাপোলো একটি ডলফিনে, হার্মিস একটি ইবিস পাখিতে, আর্টেমিস একটি বিড়ালে, এবং পসাইডন একটি ঘোড়ায় রূপান্তরিত হয়ে মিশরের দিকে পালালেন। কিন্তু জিউস পালালেন না। তিনি তার সোনালি পোশাক পরে, বজ্র হাতে নিয়ে অলিম্পাসের শীর্ষে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, "আমি এই বিশ্বের শাসক, এবং কেউ আমার সিংহাসন কেড়ে নিতে পারবে না।"
যুদ্ধ শুরু হলো। জিউস তার বজ্র ছুঁড়ে টাইফনের দিকে আঘাত হানলেন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো, এবং বজ্রের শব্দে পৃথিবী কেঁপে উঠল। টাইফনের বেশ কয়েকটি সাপের মাথা পুড়ে ছাই হয়ে গেল, কিন্তু সে দমল না। সে তার বিশাল হাত দিয়ে পাহাড় ছুঁড়ে জিউসের দিকে আক্রমণ করল। জিউস দ্রুত সেগুলো ধ্বংস করে দিলেন, কিন্তু টাইফনের শক্তি অপ্রতিরোধ্য ছিল। সে তার সাপের লেজ দিয়ে জিউসকে জড়িয়ে ধরল এবং তাকে মাটিতে ফেলে দিল।
টাইফন একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে জিউসের শরীরের পেশী রজ্জুগুলো কেটে ফেলল, যাতে জিউস নড়তে বা তার বজ্র ব্যবহার করতে না পারেন। তারপর সে জিউসের বজ্র কেড়ে নিয়ে সেগুলো একটি গুহায় লুকিয়ে রাখল। টাইফন জিউসকে সেই গুহায় বন্দি করে দিল এবং গুহার প্রবেশপথে দৈত্যাকার ড্রাগন ডেলফিনকে পাহারায় রাখল। জিউসের পরাজয়ে পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গেল, এবং টাইফনের বিশৃঙ্খলা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। সারা দুনিয়া হয়ে উঠল অন্যায়, দাপট ও বলপ্রয়োগের ক্রীড়াক্ষেত্র।
কিন্তু জিউসের ভাগ্য সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। হার্মিস, যিনি ইবিস পাখি হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং প্যান, যিনি ছিলেন প্রকৃতির একটি ছোট দেবতা, গোপনে ফিরে এলেন। তারা জিউসকে উদ্ধার করার পরিকল্পনা করলেন। প্যান তার বাঁশির সুর বাজিয়ে প্রহরী ডেলফিনকে ঘুম পড়িয়ে দিলেন, আর হার্মিস তার দ্রুতগতির পাদুকা পরে গুহায় প্রবেশ করলেন। তিনি জিউসের বজ্র বল ফিরিয়ে আনলেন। হার্মিস জিউসের শরীরে পেশী রজ্জুগুলো পুনরায় সংযোজন করলেন, এবং জিউস তার পূর্ণ শক্তি ফিরে পেলেন।
জিউস গুহা থেকে বেরিয়ে এসে আকাশে উঠলেন। তার চোখে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। তিনি টাইফনের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারনি, টাইফন। এখন তোমার শেষ সময় এসেছে।" টাইফন হাসল এবং বলল, "তোমার বজ্র আমাকে থামাতে পারবে না। আমি এখন মাটির নিচের নয়, পৃথিবীর সন্তান, আমার শক্তি অসীম।"
দ্বিতীয় যুদ্ধ আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। জিউস তার বজ্র দিয়ে টাইফনের উপর একের পর এক আঘাত হানতে লাগলেন। আকাশে বিদ্যুতের ঝড় উঠল, এবং প্রতিটি আঘাতে টাইফনের সাপের মাথাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করল। টাইফন পাহাড় ও পাথর ছুঁড়ে জিউসকে আক্রমণ করল, কিন্তু জিউস তার বজ্র দিয়ে সেগুলো ধূলিসাৎ করে দিলেন। যুদ্ধের তীব্রতায় সমুদ্র ফুটতে শুরু করল, এবং পৃথিবীর গভীর থেকে লাভা উঠে এল।
টাইফন তার শেষ চেষ্টা হিসেবে জিউসের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু জিউস দ্রুত সরে গিয়ে তার সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্র ছুঁড়লেন। এই আঘাত টাইফনের বুক ভেদ করে গেল। টাইফন একটি চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল, এবং তার বিশাল দেহ পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিল। জিউস তাকে তুলে এটনা পর্বতের নিচে চাপা দিলেন। টাইফনের শেষ নিঃশ্বাসের সাথে পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এল, কিন্তু তার ক্রোধ এখনও এটনা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রকাশ পায়।
জিউস অলিম্পাসে ফিরে এলেন। তিনি অন্য দেবতাদের ডেকে বললেন, "টাইফন পরাজিত হয়েছে। আমাদের শাসন এখন অটুট।" দেবতারা তাদের আসল রূপে ফিরে এলেন এবং জিউসের বিজয়ে উৎসব শুরু করলেন। পৃথিবীতে আবার শৃঙ্খলা ফিরে এল। মানুষেরা জিউসের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করল, এবং তারা ঝড় ও বজ্রকে জিউসের শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখতে লাগল।
গ্রীক পুরাণের এই গল্প রাজ্য শাসনে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার চিরন্তন লড়াইয়ের প্রতীক। জিউসের বিজয় দেখায় যে ন্যায় নিয়ন্ত্রিত শক্তির মাধ্যমেই শুধু রাজ্য বা বিশ্ব শাসনে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। টাইফনের পরাজয় প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য শক্তির বিরুদ্ধে দেবতাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক প্রেক্ষাপটে, এটি ন্যায্য শাসন ব্যবস্থা ও বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার মধ্যে সংঘর্ষের একটি রূপক।