পর্ব ১ ও পর্ব ২ এর পর:
২০১৪ সালে যমুনা টেলিভিশনের ৩৬০ ডিগ্রিতে আবারো কাউন্সিলর একরামুল হককে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখানো প্রসঙ্গে অপূর্ব আলাউদ্দিন বলেন, ‘‘এই প্রতিবেদনটিও আমরা ২০১০ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার ভিত্তিতে দেখাই। তবে তখন তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়ে। আমরা তাঁকে এই অনুষ্ঠানে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে দেখাইনি। ইয়াবার ছোট ব্যবসায়ী এবং সহযোগী হিসবে দেখিয়েছি।’’ তালিকা থেকে বাদ পড়ার পরও কেন দেখানো হলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবেদনে বলেছি, এই তালিকা থেকে কারো কারো নাম বাদ পড়েছে।’’ একরামের নাম যে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তা প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে অপূর্ব বলেন, ‘‘না, তা বলিনি।’’
দ্বিতীয়বার প্রতিবেদন করার সময়ও একরামের কথিত সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান না করা এবং তাঁর সঙ্গে কথা না বলার কারণ জানতে চাইলে তারও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। শুধু বলেছেন, ‘‘সবার সঙ্গে তো আর কথা বলার সুযোগ থাকে না।’’
অপূর্ব আলাউদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যথাযথ অনুসন্ধানের পর যমুনা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে একরামুলের সম্পদের হিসাব উপস্থাপন করেছিলেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অনুসন্ধান করে তালিকা করেছিল। তবে আমরা অনুন্ধান করেছিলাম কিনা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।’’
কিন্তু কোনো সাংবাদিক কি কোনো রকমের অনুসন্ধান ছাড়া শুধু একটা তালিকার ভিত্তিতে একজনকে বারবার ‘ইয়াবা গডফাদার’ এবং অনেক বাড়ি-গাড়ির মালিক হিসেবে প্রচার করতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে অপূর্ব আলাউদ্দিনের স্বীকারোক্তি, ‘‘অবশ্যই আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত ছিল।’’
তবে তিনি বলেন, ‘‘যারা প্রতিবাদ জানিয়েছে, ৩৬০ ডিগ্রি তে আমরা পরে সেই প্রতিবাদ প্রচার করেছি। একরাম কোনো প্রতিবাদ দেননি।’’
‘তালাশ’-এর উপস্থাপক মঞ্জুরুল করিমের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কথা বলতে রাজি হননি। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি’র ‘দায়িত্বশীল’ কোনো ব্যক্তিকেও কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি। আর ৩৬০ ডিগ্রি’র সেই সময়ের উপস্থাপক সুপন রায়ও ফোন ধরেননি। যমুনা টিভির দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য জানাও সম্ভব হয়নি।
এই দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মতো বেশ কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়াও ২০১২-১৩ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার কথা বলে আরো অনেকের সঙ্গে একরামুল হককে ‘মাদক ব্যবসায়ী’ হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
একরাম নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন। সেই প্রসঙ্গে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিডিয়াকে দায়ী করা নয়। আমি যেটা বলতে চেয়েছি সেটা হলো: পারসেপশন তৈরি করা। কোনো লোক ভালো, না খারাপ সেই পারসেপশন মিডিয়া তৈরি করে। ২০১৩ সাল থেকে মিডিয়া বিভিন্নভাবে একরামুল হককে গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পারসেপশন তৈরি করেছে। আমি যেটা বলতে চেয়েছি, তাঁকে মাদকের গডফাদার বলে সামাজিকভাবে হত্যা করা হয়েছে বহু আগেই। আর ক্রসফায়ার তাঁকে শারীরিকভাবে হত্যা করেছে। আমি সেটাই বলতে চেয়েছি।’’
একরাম নিহত হওয়ার পর ওইসব সংবাদমাধ্যম বলছে, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার ভিত্তিতে প্রতিবেদন করেছে। এ প্রসঙ্গে আশরাফুল আলম খোকন বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা কেউ দেখিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সচিব বলেছেন, তাঁরা এরকম কোনো তালিকা করেননি। এরকম কোনো তালিকা তাঁরা মিডিয়াকে দেননি। র্যাব মহাপরিচালকও বলেছেন, এরকম কোনো তালিকার অস্তিত্ব নেই বা কেউ বলতে পারবে না যে মিডিয়াকে দেয়া হয়েছে।’’
যাঁরা প্রতিবেদন করছেন, তারা ২০১০ সালে করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তালিকার কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে আশরাফুল আলম খোকনের প্রশ্ন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এরকম কোনো তালিকার কোনো ভিত্তি কি আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পেরেছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সচিব বলেছেন? যারা দেয়ার অথরিটি, তারা তো বলেননি। তাহলে এটা কি মিডিয়ার বানানো তালিকা?’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন একাধিক সংস্থার তালিকা আছে। সেই সব তালিকা যাচাই-বাছাই করে গোপন তালিকার ভিত্তিতে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে বলেও দাবি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও একরামের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের একাংশের দায়িত্বশীলতা এবং পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম যার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য দেবে, তার বক্তব্য থাকা উচিত। তাকে না পাওয়া গেলেও চেষ্টা করা উচিত। চেষ্টা করা হয়েছে, তার প্রমাণ থাকতে হবে। আর যখন কোনো সম্পদের তালিকা দেয়া হবে, তা যে সূত্র থেকেই পাওয়া যাক না কেন, তা সত্য না মিথ্যা, মিডিয়ার দায়িত্ব হলো তা নিশ্চিত হওয়া। মিডিয়া যদি তা না করে মনগড়া প্রতিবেদন করে, তাহলে যারা এটা করে, তাদের নৈতিকতার ঘাটতি আছে।’’
২০১৮ ডয়েচে ভ্যালে অনলাইন উক্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল যেটি এখনও অনলাইনে বিদ্যমান।
অক্টোবর ২০১২ সালে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ‘তালাশ’ অনুষ্ঠানের ৫ সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারে সাড়ে ৫ কোটি টাকার মানহানি মামলা দায়ের করা হয়। কক্সবাজার যুগ্ম-জেলা জজ ২য় আদালতে উখিয়া-টেকনাফের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুস শুক্কুর বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ‘তালাশ’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মনজুরুল করিম, প্রযোজক (নাম উল্লেখ নেই), সম্পাদক মোহাম্মদ রাসেল হোছাইন, অনুসন্ধান সদস্য অপূর্ব আলাউদ্দিন, সালাহ উদ্দিন কমল এবং টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। মামলার বিবরণীতে বলা হয়, গত ৩১ আগস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ‘তালাশ‘ অনুষ্ঠানে ইয়াবা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনে বাদীকে ইয়াবা ব্যবসায়ী উল্লেখ করায় তার মানহানি হয়েছে। উক্ত মামলাও সরকারী অভিযুক্তদের বিষয়ে সত্য প্রকাশে ব্যর্থ হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে সেই বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ‘তালাশ’ অনুষ্ঠানকে বার বার পুরস্কৃত করে চলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এবার নিয়ে এ নিয়ে পাঁচ বার টিআইবি পুরস্কার বিজয়ী ‘তালাশ’। ২০২৩ সালের টিআইবি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরষ্কারও পায় ‘তালাশ’। বাদ যাননি অপূর্ব আলাউদ্দিনও। ২০২২ সালের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ‘টিআইবি পুরস্কার’ পেয়ছেন ৩ সাংবাদিক যার মধ্যে টেলিভিশন ক্যাটাগরিতে যমুনা টেলিভেশনের অনুসন্ধানী সেলের প্রধান অপূর্ব আলাউদ্দিনও আছেন। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন ২০২২ এর টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পুরস্কার জিতেছিল। পুরস্কারের সনদ, ক্রেস্ট ও অর্থ প্রদান করা হয় যমুনা টিভির ইনভেস্টিগেটিভ এডিটর অপূর্ব আলাউদ্দিনের হাতে।
উক্ত অনুষ্ঠানে অপূর্ব আলাউদ্দিন বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এমনিতেই কঠিন। আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে, লেগে থাকতে হবে। যারা অপরাধী তারা কখনোই আপনাকে তথ্য দিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। তারা তথ্য লুকাতে চাইবে। এখান থেকেই আপনাকে তথ্য বের করে নিয়ে আসতে হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সফলতায়ই হচ্ছে যেখানে লুকানো তথ্য থাকবে, সেখান থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমাদের নিজেদের পেশাগত উৎকর্ষ, সততা ও শুদ্ধাচার বজায় রেখে কাজ করা, কোনো পক্ষ না নেয়া এবং কাজ করার সময় একটু সাহসী হওয়া। যখন কোনো প্রতিকূলতা আসে তখন অবশ্যই আমাদের আইনি আশ্রয় নিতে হবে। টিআইবি আগামী দিনে ডেটা জার্নালিজমের ওপর সাংবাদিকদের দক্ষ করতে কাজ করবে বলেও জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
তাহলে পুরো বিষয়টা কি দাড়াল? অসত্য তথ্য ও ভুয়া ভিজ্যুয়াল ও ডেটা জার্নালিজম করে এমনকি আওয়ামী লীগের শাসনকালেই আওয়ামী রাজনীতিবীদদের মিথ্যা অপরাধী করা, সেই ভুয়া অপরাধে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই বিচারবহির্ভূত হত্যায় প্ররোচিত করা দুর্নীতি বা মাদকের নামে। তার পর উক্ত মিথ্যা তথ্য বা সাংবাদিকতাকে বার বার পুরস্কৃত করা যাতে তারা এতে উৎসাহিত হয়। এর পর সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকে কাজে লাগিয়েই সরকার পতনের ক্ষেত্র তৈরি করা। এমনকি একরামুলের মেয়েদের ও পরিবারের এই করুণ কাহিনীটিকেই তার বাবার দলকে হেয় করতে ও তাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রচারণায় ব্যবহার করা।
এই পুরো বিষয়টির লক্ষ্যই হচ্ছে ভূরাজনৈতিক চালে দেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করা যাতে অন্য দেশ ও তাদের দালালেরা দেশটিকে শোষণ ও ইচ্ছে মতো লুটপাট করে নিঃশেষ করতে পারে যেখানে আদালতও অসহায়। মিডিয়া, এনজিও ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিলেই এই দেশী ডিপ স্টেট যারা ভূরাজনৈতিক ডিপ স্টেটের অংশ। আমার এই বক্তব্যটিকে যাদের কাছে নিছক ভুল বোঝাবুঝি বা কষ্টকল্পনা বলে মনে হচ্ছে, তারা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবীদ ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের বর্ণনায় ব্রিটেনের ডিপ স্টেটর কথা শুনে দেখতে পারেন। তিনি বৃটিশ মিডিয়া, বিবিসির রিপোর্ট এবং তার সাথে বৃটেনের রাষ্ট্র যন্ত্র মিলিয়ে যে চিত্র তুলে ধরেছেন যার কাছে রাজনীতিবীদেরা অসহায়, সেটা হুবহু একই।