ছোটবেলায় আমরা যে পাড়ায় বড় হয়েছি সেটাকে একটা হিন্দু-প্রধান পাড়াই বলা চলে। যদিও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার হিন্দু নিধন ও হিন্দু বিতাড়নের ফলে অনেক হিন্দু নিহত হয়েছিল এবং অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছিল। ১৯৭১ সালের শুরুতেই আমাদের বাড়ির সামনের হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিল শুধুই হিন্দু বাড়ি বলে। আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং ভদ্র ও মেধাবী ছেলেমেয়েদের ঐ পরিবারের বড় ভাই ছাড়া আর সবাই ভারতে চলে গিয়েছিল আশির দশকে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করলেও অনেকেই ফিরে এসেছিল এবং স্বাধীনতার পর সকল ক্ষতি সয়েও তারা বাপ দাদার ভিটায় নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছিল। ঐ সময় প্রতি সন্ধ্যায় শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনি ও মন্ত্র-আরতির সূর ভেসে আসত, আবার মধুর কন্ঠে আজানও একই সময় শোনা যেত। এতে কেউ কখনও উত্যক্ত বা বিরক্ত বোধ করত না। তখন টেলিভিশন মানুষের বাসায় ছিল না বললেই চলে। ছিল রেডিও যেখানে মানুষ খবর শুনত আর শুনত শ্রীলংকার রেডিও শিলং এর হিন্দি সিনেমার হিট সব গানের অনুষ্ঠান বিনাকা গীতমালা। পুজার সময় হিন্দি আশা, লতা, কিশোরের সিনেমার সেই সব গানগুলো মাইকে দিন রাত বাজত। পুজার সময় যেমন পুরো পড়াতে একটা উৎসবের ভাব বিরাজ করত সবার মনে, ঠিক তেমনই ঈদ ও কোরবানী ঈদের উৎসবও সারা পাড়াকে ঘিরে ধরত। আমরা ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যেমন ধর্ম নির্বিশেষে বেড়ানোর ও খাবার আনন্দ এবং বন্ধুত্বে মেতে রইতাম। বড়রাও তাই করত। কখনও শুনিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন শ্লোগান, মিছিল, দোষারোপ, চক্রান্ত বা আল্লাহু আকবর বলে জিহাদ করাবার ঘোষণা। তখন পাড়ায় সব মানুষ যে ফেরেশতা ছিল সেটা নয়। প্রতিটি মানুষকে তার ধর্ম নয়, তার ব্যক্তিগত চরিত্র দিয়ে বিচার করা হত। সচ্ছল হিন্দুদের বাড়ির মন্দিরটি বা মুসলমানদের নামাজের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি মানুষের ব্যাক্তিগতভাবে সৎ ও আদর্শ হবার চেষ্টা করা।
১৯৭৫ সালের শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ব্যাক্তিগতভাবে সৎ ও আদর্শ হবার পরিবর্তে, যে যত বেশি দেখতে মুসলিম সে তত ভাল এবং যে যত বেশি দেখতে বা আচরণে অমুসলিম সে তত মন্দ এই মানসিকতা বাড়তে থাকে। ইসলাম ধর্ম একটি ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণের ধর্ম থেকে পরিবর্তিত হয়ে একটি আচার-অনুষ্ঠান, মানে রিচ্যুয়াল বা পূজাবিধি পালনের ধর্মে পরিণত হয়। যারা ইসলাম এবং ইব্রাহিমের ধর্মগুলো (ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম) সম্পর্কে জানে, তারা জানে ইব্রাহিমের ধর্মগুলোর উদ্ভবই হয়েছে আচার-অনুষ্ঠান বা পূজাবিধির ধর্মগুলোর থেকে মানুষকে বের করে এনে ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণের ধর্ম পালনের মাধ্যমে একটি উন্নততর এবং ন্যায় বিচার ভিত্তিক ও মানুষের অধিকার ভিত্তিক সমাজ তৈরির লক্ষ্যে। এর কারণ হচ্ছে পূজাবিধি পালনের ধর্মগুলো হলো গ্রামে উদ্ভাবিত, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ভালমন্দ গ্রামের মানুষের কাছে লুকানো যায় না। অপরদিকে এবং ইব্রাহিমের ধর্মগুলো শহরে উদ্ভাবিত, যেখানে মানুষের চরিত্র বোঝা ভার।
হিন্দু ধর্ম ও ইব্রাহিমের ধর্মগুলো তাই এক নয়। হিন্দু ধর্ম বলে আসলে কোন ধর্ম নেই। অনেকে বলে হিন্দু ধর্ম বহুঈশ্বরবাদী, সেটাও ঠিক নয়। দশ হাজার বছর আগে ইরানের জার্গোজ এলাকা থেকে কৃষি সভ্যতার যখন বিস্তার ঘটে তখন সেই সমাজে দুনিয়ার সকল প্রাণী, উদ্ভিদ এবং বস্তুগুলো বিশেষ কিছু নিয়ম বা ছক মেনে চলে এটা তারা খেয়াল করেন। এর সাথে সাথে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে তারা খেয়াল করেন দুনিয়ার সকল প্রাণীর মধ্যে একটি বিচারবোধ ও ন্যায্যতা পরিমাপের ক্ষমতা বিদ্যমান। এই থেকেই তারা ধারণা করেন যে একটি আদর্শিক শক্তি (ও আর একটি অপশক্তি) সকল জীবিত আত্মায় বিদ্যমান। এই আদর্শ শক্তির সম্মিলিত অবস্থিতিকেই তারা ঈশ্বর মনে করতেন। এর প্রভাবে ইরানে জরাস্ত্রিয়ান ধর্মের সূচনা হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে বেদ উপনিষদের হিন্দু ধর্মের সূচনা হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে আমরা দেখছি নানা প্রক্রিয়ায় হিন্দুদের দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। এর ফলে সমাজে হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান বা পূজাবিধির যে কলরব, সেটা নেই বললেই চলে। সমাজ পুরোটাই মুসলিমদের দখলে। এই সমসত্ত্বতার মধ্যেও সমাজে ইসলামের প্রচণ্ড রকম উগ্র প্রদর্শনবাতিকতা বা শোভিনিজম প্রকাশ পেয়েছে। জরাস্ত্রিয়ান বা বেদ উপনিষদের হিন্দু ধর্মে যেমন একটি শুভ ও আর একটি অপশক্তির সমান ক্ষমতার বিপরীত আদর্শের দেবতাদের ধারণা করা হয়, ইব্রাহিমের ধর্মগুলোতে সেইরকম বিপরীত আদর্শের ক্ষমতার সমতা নেই। ইব্রাহিমের ধর্মগুলোতে শয়তানের কোন বাস্তব রূপ নেই। ইব্রাহিমের ধর্মের শয়তান ইশ্বরেরই আরো বহু ফেরেশতাদের মত একজন ফেরেশতা যে ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় ছিল। ইব্রাহিমের ধর্মের শয়তান ঈশ্বরকে লড়াইতে আহ্বান করে না। সে শুধু মানুষের মনের উপর কাজ করতে পারে। শয়তান হিসাবে তার জন্মই হয়েছে আদমকে সেজদা না করার সময় থেকে।
বহু পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইলের জ্ঞানী ব্যক্তিরা আবিষ্কার করেছিলেন যে মানুষ যতই উন্নত হোক, শিক্ষিত হোক এবং যত ভাল রাজ্য, দল বা সংগঠনই তারা তৈরি করুক, ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণের চর্চা যদি তারা না করে, তাহলে তারা শয়তানের প্ররোচনায় চালিত হবে। সমাজ অন্যায় অবিচার ও অপরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মামলা, হামলা ও হানাহানির কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে। আজ আমরা দেখছি চারিদিকে সবাই মুসলিম, শুধুই আল্লাহু আকবর আর জিহাদ কোতল করার শ্লোগান। কিন্তু সততা, ন্যায্যতা, ও পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস একেবারে উঠে গেছে। যত বেশি ইসলাম তত বেশি চুরি, জোচ্চুরি, লাম্পট্য এবং অসহিষ্ণুতা। এর কারণ ইসলাম ধর্মের ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণ থেকে বের হয়ে এসে আচার-অনুষ্ঠান বা পূজাবিধি পালনের ধর্মে পরিণত হওয়া। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা মুক্ত সমাজের উয়োক মাইন্ড ভাইরাস। যেটা নিজেকে ও নিজের আধ্যাত্মিক সঙ্কট নিয়ে চিন্তা করার চাইতে সামাজিক ক্ষমতা ও দলাদলির মূল্যবোধকে অনুসরণ করার শিক্ষা দেয়।
ইসলামের বিপথগামীতার বিষয়টি বুঝতে হলে ইব্রাহিমের ধর্মের ইতিহাসটা সম্পর্কে জানতে হবে। সেটা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল (পরবর্তী পর্বগুলোতে)। একথা মনে রাখতে হবে যে ইহুদি ধর্ম থেকে খ্রিস্ট ধর্ম ও সেখান থেকে ইসলাম একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা। যেন একই ঈশ্বর মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে সমাজকে বাসযোগ্য করার জন্য কিছু নিয়ম কানুন পাঠাচ্ছেন, মানুষ সেগুলোর অপ্রয়োগ করে আবার বিপথে যাচ্ছে। এখানে আরো খেয়াল করতে হবে ইব্রাহিমের ধর্মগুলো যেমন ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম বলতে যেমন আমরা তিনটি ধর্ম মনে করছি, আসলে এগুলোর মধ্যে আরও নানা পরিবর্তন ও বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসের নানা সময়ে। সেই বিভাজনের সাথে তাল মিলিয়েই বিষয়টাকে দেখতে হবে।
এর সাথে আর একটি বিষয় বুঝতে হবে। ধর্মের ঐতিহাসিক ধারা চর্চা করতে গেলে দুই ধারায় চিন্তা করতে হয়। ধর্মগুলোর একটি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাস বা মিথলজিক্যাল ইতিহাস থাকে, আবার থাকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেটা প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞান প্রয়োগ করে নির্ণিত হয়। দুটো যে সবসময় মিলবে সেটা নয়, তবে দুটোই মাথায় রাখতে হবে।
পরের পর্ব: