আগের পর্ব:
গত পর্বে আমরা দেখেছি কিভাবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া-লেভেন্ট অঞ্চলে নানা জাতি ও ছোট ছোট ধর্ম বিশ্বাসের বিভিন্ন ধারণা সহযোগে ইহুদি ধর্মের প্রাথমিক ধারণাগুলো তৈরি হল যেটা শুধুই একেশ্বরবাদী ছিল না। এর পর প্রায় হাজার বছরের নানা সংঘাত, রাজনৈতিক চাপ ও যুদ্ধ বিগ্রহের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একেশ্বরবাদী ইহুদি ধর্মের প্রতিষ্ঠা শক্ত ভিত্তি পেল যেটা আব্রাহামিক ঐতিহ্য ও ধর্মতত্ত্বের একটি প্রবাহ হিসাবে খ্রিস্ট এবং ইসলাম ধর্মের ভিত্তি হিসাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই পর্বে আমরা দেখব প্রায় দুই হাজার বছর আগে জুডিয়ার বেথলেহেমে যিশু খ্রিস্টের জন্মগ্রহণের সময় সেখানকার ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজের কি এমন পরিস্থিতি ছিল যেখানে ইহুদি ধর্মের একটি সংস্কার জরুরী হয়ে পড়ে ছিল। একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে যিশু খ্রিস্ট একটি ইহুদি পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন এবং তিনি কোন ধর্মীয় পুস্তক রচনা করে যান নাই। ইহুদি ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ তোরাহ, যেটা হিব্রু বাইবেল নামে পরিচিত, তার ভেতরে যে পাঁচটি বই, যেগুলো হল জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বার্স, ডিউটেরোনমি, সেগুলোই ছিল যিশু খ্রিস্টের ধর্মগ্রস্থ। নতুন কোন ধর্ম নয়, যিশু খ্রিস্ট ইহুদি ধর্মের যে কঠোর, হৃদয়হীন ও আক্ষরিক প্রয়োগ সেই সময়ে শুরু হয়েছিল, তিনি তার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। ধর্মের লক্ষ্য তোরাহর আক্ষরিক প্রয়োগ নয় যা ঔ সময় একশ্রেনীর ধর্মপ্রচারক ফরিশীদের (Pharisees) মৌখিক তালমুদ ও তোরাহর অপব্যাখ্যা প্রয়োগ করে মানুষ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করত। যা বর্তমানের একশ্রেণীর ইসলাম প্রচারকদের ভুয়া হাদিস ও কোরানের অপব্যাখ্যা প্রচারের মত ছিল। ধর্মের লক্ষ্য তোরাহর আক্ষরিক প্রয়োগ নয়, ঈশ্বরই যে লক্ষ্য এবং ঈশ্বর যে অনিরাপত্তায় ভোগা একজন ক্ষুব্ধ শাসক নন, তিনি প্রেম ও দয়ার পিতা, সেটাই তিনি প্রচার করতে চেয়েছিলেন।
ইহুদি ধর্মের দ্বিতীয় মন্দির যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ - খ্রিস্টাব্দ ৭০) ধর্মীয়, রাজনৈতিক, এবং সামাজিক সংকট তীব্র আবার ধারণ করে। ফরিসীদের তোরাহর কঠোর আক্ষরিক প্রয়োগ, ধর্মীয় প্রদর্শনবাদ, এবং মানবিক বিবেচনার অভাব ধর্মকে জনগণের জন্য বোঝা করে তুলেছিল। বাইবেলের নতুন নিয়মে ফরিসীদের এই আচরণের প্রচুর সমালোচনা দেখা যায়। এই সংকটের প্রেক্ষাপটে যিশু ইহুদি ধর্মের মধ্যে একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, যা তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪ অব্দে যিশু খ্রিস্টের জন্ম জুডিয়ার দ্বিতীয় মন্দির যুগে ঘটে। ইহুদি ধর্ম তখন একেশ্বরবাদী প্রধান এবং তোরাহকেন্দ্রিক ছিল, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবাদগত বিভক্তিও ছিল। ফরিসীরা তোরাহর লিখিত ও মৌখিক ঐতিহ্য পালন করত এবং পুনরুত্থান ও পরকালে বিশ্বাস করত। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু বাইবেলের নতুন নিয়মে তাদের কঠোর আচার-নিষ্ঠা, ধর্মীয় প্রদর্শনবাদ, এবং পাপীদের প্রতি তাচ্ছিল্যের সমালোচনা পাওয়া যায়। তাদের শুষ্ক ধর্মীয় নিয়ম কানুন জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করত। ধর্মীয় এলিট সদ্দুকীরা (Sadducees) শুধু লিখিত তোরাহর মূল্য দিত এবং পুনরুত্থানে বিশ্বাস করত না। তারা ইহুদি মন্দিরের পুরোহিত শ্রেণী ও অভিজাতদের প্রতিনিধিত্ব করত। এসিনরা (Essenes) তপস্বী জীবনযাপন করত এবং মশীহের (একজন ত্রাণকর্তা) আগমনের প্রত্যাশা করত। ডেড সিতে পাওয়া পাথরের খোদাই বা স্ক্রল তাদের অবস্থানের প্রমাণ দেয়। জেলটরা (Zealots) রোমান শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে বিশ্বাসী ছিল। পরবর্তীতে ইশাইয়া ও ড্যানিয়েলের লেখায় জানা যায় মশীহের ধারণা তখন জনপ্রিয় ছিল। অনেকে একজন ত্রাণকর্তার আগমণের মাধ্যমে রোমান শাসন থেকে মুক্তি ও ঈশ্বরের রাজ্য প্রত্যাশা করত।
তখন ইহুদি ধর্মের যে সংকটগুলো দেখা দেয় সেগুলো বেশিরভাগই ধর্ম প্রচারের ধরণ ও ধর্ম প্রচারকদের আচরণ সম্পর্কে। ফরিসীদের কঠোর নিয়ম এবং ধর্মীয় প্রদর্শনবাদী আচরণ ধর্মকে জটিল, অমানবিক ও মানুষের অন্তর থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল। তখন মন্দিরের দুর্নীতি বেড়ে যায়। সদ্দুকীদের নিয়ন্ত্রণে মন্দিরে অর্থ তছরুপ ও রোমানদের সঙ্গে সহযোগিতা করে দুর্নীতি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। এর সাথে রোমান শাসকদের অতিরিক্ত কর এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হুমকি মশীহীয় জনপ্রিয়তা ও সেটা থকে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বাড়ায়। সেই সময় ধর্মীয় বিভক্তি বেড়ে যায়। ফরিসী, সদ্দুকী, এবং এসিনদের দ্বন্দ্ব ইহুদি সমাজে ব্যপক বিভাজন তৈরি করেছিল।
বাইবেলের নতুন নিয়মের ম্যাথু ও লুক অনুসারে, ঐ সামাজিক পরিস্থিতিতে যিশু খ্রিষ্ট জুডিয়ার বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করেন এবং গ্যালিলির নাজারেথে তিনি বড় হন। তাঁর মা মরিয়ম এবং আইনগত পিতা যোসেফ ছিলেন ইহুদি। যিশু একটি সাধারণ ইহুদি পরিবারে বেড়ে ওঠেন। নাজারেথ ছিল একটি ছোট, কৃষিভিত্তিক গ্রাম। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে নাজারেথে সিনাগগ ও ইহুদি ধর্মীয় জীবনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যিশু সিনাগগে তোরাহ, নবীদের লেখা, এবং ইহুদি আইনগুলো শিখেছিলেন। ১২ বছর বয়সে তিনি জেরুজালেম মন্দিরে রাব্বিদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন, যা তাঁর ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা নির্দেশ করে। নতুন নিয়মের মার্ক ৬:৩ অনুসারে, যিশু একজন কাঠমিস্ত্রি বা নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন, যা তাঁর নিম্ন-মধ্যবিত্ত পারিবারিক পটভূমি নির্দেশ করে। নাজারেথে ফরিসী ধর্মপ্রচারকদের প্রভাব ছিল। যিশু তাদের কঠোর নিয়ম ও ধর্মীয় প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যা তাঁর পরবর্তী শিক্ষায় তাদের সমালোচনার ভিত্তি হয়।
জুডিয়া খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ অব্দ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে হেরোদ দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর জুডিয়া রোমান প্রকিউরেটর পন্টিয়াস পিলাতের অধীনে আসে। রোমানদের আরোপিত অতিরিক্ত কর জনগণের মধ্যে ক্রমেই অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জেলটরা সেই সুযোগে রোমানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করত। সদ্দুকীরা সেখানে অভিজাত সম্প্রদায় ছিল, প্রচুর মধ্যবিত্ত কৃষক বা কারিগর, এবং দরিদ্র শ্রেণী যেমন ভূমিহীন শ্রমিকও ছিল। জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়াল, রোমান মুদ্রা, এবং কফরনাহুমের সিনাগগ যিশুর সময়ের পরিস্থিতির ঐতিহাসিক সত্যতা নিশ্চিত করে।
যিশু ছিলেন ইহুদি এবং ইহুদি ধর্মের একেশ্বরবাদী ধর্ম তিনি পালন করতেন। তিনি ঈশ্বর ইয়াহওয়েকে একমাত্র স্রষ্টা এবং ইসরায়েলের ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ করতেন। তবে, তিনি ফরিসীদের কঠোর আচার-নিষ্ঠার সমালোচনা করতেন। নতুন নিয়মের ম্যাথু ৫:১৭-১৮ অনুসারে যিশু বলেন, 'তিনি তোরাহ বাতিল করতে নয়, তা পূর্ণ করতে এসেছেন'। তিনি শাব্বাত, পাসওভার, এবং সিনাগগে প্রার্থনা পালন করতেন। যিশু ফরিসীদের আচার-নিষ্ঠা এবং ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতার সমালোচনা করেন, বলেন যে তারা “বাইরে ধার্মিক কিন্তু ভিতরে অশুচি” (ম্যাথু ২৩:২৭-২৮)। তিনি তোরাহর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অর্থের উপর জোর দেতেন।
যিশু ঈশ্বরের নিয়মের কঠোর প্রয়োগ এবং ফরিসীদের কঠোর ধর্মীয়তা এবং ধর্মীয় অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় একটি নতুন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলেন। নতুন নিয়মের ম্যাথু ৩:১৩-১৭ অনুসারে, যোহনের কাছ থেকে বাপ্তিস্ম গ্রহণ যিশুর প্রচারের সূচনা করে। বাপ্তিস্ম নেওয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্যদের সামনে এটা দেখান যে, তিনি তার পাপের জন্য অনুতপ্ত এবং ঈশ্বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, তার জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, তিনি তাঁর ইচ্ছা পালন করবেন। যোহনের প্রায়শ্চিত্তের বার্তা ফরিসীদের আচারবাদের বিরুদ্ধে ছিল। ফরিসীদের শাব্বাতের সময় নানা নিষেধাজ্ঞা এবং পাপীদের প্রতি তাচ্ছিল্য যিশুকে তোরাহর মানবিক অর্থের উপর জোর দিতে প্ররোচিত করে। যিশু মন্দিরে অর্থ তছরুপকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন, যা ফরিসী ও সদ্দুকীদের ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান নির্দেশ করে। দরিদ্র ও প্রান্তিকদের কষ্ট যিশুকে সামাজিক ন্যায় ও ঈশ্বরের ভালোবাসার শিক্ষা দিতে প্রভাবিত করে। ফলে ফরিসীদের কঠোর ধর্মীয় নির্দেশ এবং মানবিকতার অভাব যিশুকে ঈশ্বরের রাজ্যের একটি মানবিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রচার করতে উদ্বুদ্ধ করে।
খ্রিস্টধর্ম ইহুদি ফরিসীদের কঠোর ধর্মীয়তার বিরুদ্ধে যিশুর শিক্ষা, তাঁর মৃত্যু, এবং শিষ্যদের পুনরুত্থানের বিশ্বাসের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়। যিশু গ্যালিলি ও জুডিয়ায় ঈশ্বরের রাজ্যের কথা প্রচার করেন। তিনি ফরিসীদের আচার-নিষ্ঠার সমালোচনা করে বলেন, “করুণাই চাই, বলিদান নয়”। তাঁর শিক্ষা প্রেম, ক্ষমা, এবং সকলের জন্য ঈশ্বরের ভালোবাসার উপর কেন্দ্রীভূত ছিল। এটাই যিশুর শিক্ষা ছিল খ্রিস্টাব্দ ৩০ পর্যন্ত। যিশু বারোজন শিষ্য (Apostles) এবং অনেক অনুসারী গড়ে তোলেন, যারা তাঁকে মশীহ হিসেবে গ্রহণ করে। যিশুর কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন ছিল না। যিশু ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে শিষ্যদের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন।
যিশুর জীবিত অবস্থায় যিশুর প্রচার ও প্রচলিত ইহুদি ধর্মের মধ্যে পার্থক্য ছিল সামান্য। যা ছিল মূলত তোরাহর ব্যাখ্যা, ঈশ্বরের রাজ্য, পাপীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও মন্দিরের ভূমিকার বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা। ইহুদি ধর্মের কঠোর ও আক্ষরিক প্রয়োগে জোর যেমন, শাব্বাতের সময় কাজ করা নিষেধ এবং ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতা পরিহার করে যিশু তোরাহর আদর্শগত ও নৈতিক অর্থ, যেমন প্রেম ও করুণার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, “ঈশ্বর ও প্রতিবেশীকে ভালোবাসা” যেটা তোরাহর সারাংশ।
ঈশ্বরের রাজ্য বলতে ইহুদি ধর্ম প্রচারকারী ফরিসীরা মশীহকে রাজনৈতিক মুক্তিদাতা হিসেবে দেখত এবং আইন পালনের মাধ্যমে ধার্মিকতা অর্জনের চেষ্টা করত। অপর দিকে যিশুর শিক্ষা ছিল ঈশ্বরের রাজ্যকে হৃদয়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা। এর সাথে পাপীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও তিনি পরিবর্তনের শিক্ষা দেন। ইহুদি ধর্মপ্রচারকারী ফরিসীরা পাপীদের তাচ্ছিল্য করত এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলতে নির্দেশ দিত। যিশুর শিক্ষা ছিল পাপীদের ক্ষমা ও প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ দেয়া। এছাড়া মন্দিরের ভূমিকা নিয়েও তার ভিন্ন নির্দেশ ছিল।
যিশুর শিক্ষা, ফরিসীদের সমালোচনা, এবং মশীহ সংক্রান্ত দাবি ফরিসী, সদ্দুকী ধর্মীয় নেতাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। তাঁর মন্দির সংস্কার তাদের ক্ষুব্ধ করে। এর ফলে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইস্কারিওতের যিহূদা যিশুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। ইস্কারিওতের যিহূদা ছিলেন যীশুখ্রীষ্টের বারোজন শিষ্যদের একজন। সেই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারিক পরিষদ সানহেদ্রিন তাঁকে ঈশ্বরকে নিন্দার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। ফরিসীরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। বিচারে পন্টিয়াস পিলাত তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ক্রুশবিদ্ধ করার নির্দেশ দেন। পন্টিয়াস পিলাত জুডিয়ার রোমান প্রদেশের পঞ্চম গভর্নর ছিলেন, যিনি সম্রাট টাইবেরিয়াসের অধীনে জুডিয়া শাসন করতেন। এর পর যিশুকে গলগথায় ক্রুশে বিদ্ধ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ট্যাসিটাস এবং জোসেফাসের লেখা ইতিহাস যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের উল্লেখ করে। জোসেফাস এবং ট্যাসিটাস ছিলেন অ-খ্রিস্টান লেখক ও ইতিহাসবিদ যারা ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণে যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের কথা উল্লেখ করেছেন যেটার উৎস বাইবেল বা খ্রিস্টিয় নয়।
খ্রিস্টান বিশ্বাসে, যিশুর মৃত্যু পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবং ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য বলিদান। তাঁর পুনরুত্থান তার মৃত্যু পরবর্তী খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় বিশ্বাস। যিশুর জীবিত অবস্থায় খ্রিস্টধর্ম ও তাঁর মৃত্যুর পরের খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। জীবিত অবস্থায় যিশু ইহুদি ধর্মের সংস্কার আন্দোলন, ফরিসীদের কঠোর আচারবাদের বিরুদ্ধে প্রেম ও ভালবাসা দিয়ে ঈশ্বরকে পরিচিত করতে চেয়ছেন। তার মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিশ্বাসে খ্রিস্টধর্ম একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হয়, যা অ-ইহুদিদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়ায়। তিনি জীবিত অবস্থায় যা ফরিসীদের আচার-নিষ্ঠার বিরুদ্ধে নৈতিকতা ও প্রেমের উপর জোর দিয়েছিল মৃত্যুর পর সেটা যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান পাপ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে প্রচারিত হয়। তিনি জীবিত অবস্থায় সংবেদনশীলতার সাথে ইহুদি আইন পালন যেখানে তার ধর্মে মুখ্য ছিল মৃত্যুর পর বাপ্তিস্ম ও প্রভুর ভোজ প্রতিষ্ঠিত হয়; তোরাহর কিছু আইন শিথিল হয় যেমন, খৎনা, নতুনদের খিস্টধর্ম গ্রহণ ইত্যাদি।
ফরিসীদের কঠোর আচার-নিষ্ঠা এবং ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতা ইহুদি ধর্মকে জটিল ও অপ্রিয় করে তুলেছিল। নতুন নিয়মে ফরিসীদের “হিপোক্রিট” বলা হয়, কারণ তারা ধর্মকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার করেছিল। তাদের নিয়ম দরিদ্রদের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছিল।
যিশুর মৃত্যুর পর শিষ্যরা যেমন পিতর, যোহন, পল খ্রিস্টধর্ম প্রচারে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। পিতর জেরুজালেমে ইহুদি খ্রিস্টানদের নেতৃত্ব দেন, আর পল অ-ইহুদিদের মধ্যে প্রচার করে খ্রিস্টধর্মকে বিশ্বজনীন করেন। জেরুজালেমে খ্রিস্টানরা প্রার্থনা, প্রভুর ভোজ, এবং সম্পত্তি ভাগ করে নিত। তারা ফরিসীদের আচারবাদের বিপরীতে যিশুর মানবিক শিক্ষা পালন করত। খ্রিস্টাব্দ ৫০-এর দশকে জেরুজালেম কাউন্সিল অ-ইহুদি খ্রিস্টানদের জন্য তোরাহর কিছু নিয়ম শিথিল করে, যা খ্রিস্টধর্মকে ইহুদি ধর্ম থেকে আলাদা করে।
ইহুদি ধর্মের সংকট, বিশেষ করে ফরিসীদের কঠোর আচার-নিষ্ঠা ও ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতা, ধর্মকে জনগণের জন্য জটিল ও জীবন বিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল। যিশু এই সংকটের প্রতিক্রিয়ায় ঈশ্বরের রাজ্যের একটি মানবিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেন। তাঁর জীবিত অবস্থায় খ্রিস্টধর্ম ছিল ইহুদি ধর্মের একটি সংস্কার আন্দোলন, যা ফরিসীদের জটিলতার বিরুদ্ধে প্রেম ও ক্ষমার বার্তা দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর শিষ্যদের প্রচারে এটি একটি স্বতন্ত্র ধর্মে রূপান্তরিত হয়, যা ফরিসীদের আচারবাদ থেকে মুক্ত ছিল।
দুই হাজার বছর আগে খ্রিস্টের জন্মের সময় ইহুদি ধর্মে ধর্মপ্রচারক ফরিসীদের কঠোর আচার-নিষ্ঠা ও ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতা যে সমস্যা তৈরি করেছিল যা ধর্মকে অমানবিক ও সমাজবিচ্ছিন্ন করে সমাজে একটি বিপর্যয় তৈরি করেছিল। ধর্মকে ব্যবহার করে তারা ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীতা ও দলবাজীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ধর্মপ্রচারক সদ্দুকীরা একটি ধর্মীয় এলিটতন্ত্র তৈরি করেছিল এবং সেগুলোকে ব্যবহার করে ধর্মপ্রচারক জেলটরা সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য তৈরি ছিল। বর্তমানের ইসলাম ধর্ম যেন সেই একই পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত। নকল ও মনগড়া হাদিস এবং কোরানের বানীর উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার করে ধর্মীয় প্রদর্শনবাদীরা ধর্মকে কঠোর আচার-নিষ্ঠা ও শত্রু তৈরির হাতিয়ার করে ফেলেছে। যে দেখতে তাদের মত নয় সেই যেন ইসলাম বিরোধী, যারা ভিন্ন ধর্মের, তাদের যেন কোন সম্মান ও অধিকার নেই – ধর্মকে ব্যবহার করে ও অপব্যাখ্যা করে এই নাফরমানি ও ইশ্বরবিরোধীতা তারা প্রচার করে চলেছে। এবং আশ্চর্য যে রাষ্ট্রের সামরিক বেসামরিক বিভিন্ন অংশ, এই মিথ্যা এবং পাপকর্মের এজেন্ট হয়ে রাষ্ট্রীয় সহাযোগীতায় জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চলেছে। এরা সকলে শয়তানের দোসর এবং এটা চলতে থাকলে এই দেশের পতন কেউ রোধ করতে পারবে না।